গুর্জর প্রতিহার বলিতে কাহাদের বোঝায় ? গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের ইতিহাস
প্রশ্ন। গুর্জর প্রতিহার বলিতে কাহাদের বোঝায় ? গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস বর্ণনা কর।
অথবা,
ভারতের ইতিহাসে গুর্জর প্রতিহার রাজত্বকালের গুরুত্ব নির্ণয় কর।
উত্তর ।
গুর্জর প্রতিহারগণের উৎপত্তি :
গুপ্ত সাম্রাজ্যের অবসান ও হর্ষবর্ধনের মৃত্যুর পর উত্তর-ভারতীয় রাজনীতিতে গুর্জর-প্রতিহারদের ভূমিকা ছিল বিশেষ উল্লেখযোগ্য । হর্ষ-পরবর্তী যুগে যে সকল রাজপুত রাজ্যগুলির উত্থান হইয়াছিল, তাহাদের মধ্যে গুর্জর-প্রতিহারগণ ছিলেন সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী । কিন্তু তাহাদের প্রাচীন ইতিহাস রহস্যাবৃত । প্রতিহারবংশীয় রাজাগণ তাঁহাদের শিলালিপিতে আপনাদিগকে প্রাচীন ইতিহাস রহস্যাবৃত সূর্যবংশীয় ক্ষত্রিয় এবং রামচন্দ্রের অনুজ ও প্রতিহারী (দ্বাররক্ষক) লক্ষ্মণের বংশধর বলিয়া আত্মপরিচয় দিয়াছেন।
তবে আধুনিক ঐতিহাসিকগণের মতে গুর্জরগণ হূনজাতির একটি শাখা এবং সম্ভবত ষষ্ঠ শতকের প্রথম দিকে মধ্য-এশিয়া হইতে তাহারা ভারতে প্রবেশ করিয়াছিল । কালক্রমে ইহারা ভারতীয় সমাজে মিশিয়া গিয়া ক্ষত্রিয় নামে পরিচয় লাভ করে। প্রতিহারগণ ইহাদের শাখা। প্রথমে ইহারা রাজপুতানায় বসবাস আরম্ভ করিয়াছিল ; পরে বিভিন্ন দিকে ছড়াইয়া পড়িয়া নানাদিকে বহু রাজ্য স্থাপন করে।
গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্য :
হরিচন্দ্র ছিলেন এই রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা। রাজপুতানার
মারবাড় অঞ্চলে ভিনমালে ছিল তাঁহার রাজধানী। ৭২৫ খ্রীষ্টাব্দে প্রথম নাগভট্ট মালবে এক নূতন গুর্জর-প্রতিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন । উজ্জ্বয়িনী ছিল তাঁহাদের রাজধানী। তিনি সিন্ধুর আরবগণকে পরাজিত করিয়া তাঁহাদের অগ্রগতি প্রতিহত করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া, তিনি কয়েকটি অঞ্চল জয় করিয়াছিলেন ।
গুর্জর প্রতিহার বংশের পরবর্তী শক্তিশালী রাজা ছিলেন বৎসরাজ (৭৭৫-৮০০ খ্রীঃ)। তিনি গুর্জরদের বিভিন্ন শাখার উপর প্রভুত্ব স্থাপন করিয়া শক্তিশালী হইয়া উঠেন । তাঁহার সময় হইতে উত্তর ভারতের আধিপত্য লইয়া দাক্ষিণাত্যের রাষ্ট্রকূট-বংশ, বাংলার মধ্যে পালবংশ এবং রাজপুতনার গুর্জর-প্রতিহার বংশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা আরম্ভ হয় । বৎসরাজ বাংলার ধর্মপালকে পরাজিত করিয়াছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে রাষ্ট্রকূট-রাজ ধ্রুবের হস্তে পরাজিত হইয়াছিলেন ।
বৎসরাজের পুত্র দ্বিতীয় নাগভট্ট এই বংশের একজন শক্তিশালী রাজা ছিলেন। তিনি বাংলার রাজা ধর্মপালের মনোনীত চক্রায়ুধকে পরাজিত করিয়া কনৌজ অধিকার করিয়াছিলেন । সেই সময় তাঁহার সাম্রাজ্য পশ্চিমে পূর্ব-পাঞ্জাব হইতে পূর্ব-বাংলার সীমান্ত পর্যন্ত বিস্তৃত হইয়াছিল । কিন্তু পরে রাষ্ট্রকূট রাজ তৃতীয় গোবিন্দ তাঁহাকে পরাজিত করিয়া নাগভট্টের সাম্রাজ্যবিস্তার প্রতিহত করেন ।
মিহির ভোজ বা প্রথম ভোজ :
৮৩৬ খ্রীষ্টাব্দে দ্বিতীয় নাগভট্টের পৌত্র মিহির ভোজ গুর্জর-প্রতিহার রাজ্যের সিংহাসনে আরোহণ করেন । তিনি এই বংশের একজন শ্রেষ্ঠ রাজা বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা : ছিলেন এবং প্রতিহারবংশের বিনষ্ট গৌরব পুনরুদ্ধার করিয়াছিলেন । চতুর্দিকে সাম্রাজ্যবিস্তার রাষ্ট্রকূটরাজ্যের বিশৃঙ্খল অবস্থার সুযোগ লইয়া তিনি উত্তর-ভারতে তাঁহার প্রাধান্য স্থাপন করেন এবং কনৌজ দখল করেন।
সমসাময়িক পালরাজকে পরাজিত করিয়া তিনি মগধ পর্যন্ত তাঁহার সীমান্ত বিস্তৃত করেন। তিনি বুন্দেলখণ্ডের চন্দেলদিগকে পরাজিত করিয়া ঐ রাজ্যটি স্বীয় সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিয়া লন । অবশেষে রাষ্ট্রকূট-রাজ আরব পর্যটক সুলেমানের অমোঘবর্ষের নিকট পরাজিত হইলে দক্ষিণ-ভারতে তাঁহার বিবরণ সাম্রাজ্যবিস্তার প্রতিহত হয় ।
আরব পর্যটক সুলেমান মিহির ভোজের সামরিক বল, প্রতিপত্তি ও সুদক্ষ শাসনক্ষমতার উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করিয়া গিয়াছেন । তাঁহার সময়ের মুদ্রা হইতে জানা যায় যে, তিনি বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন ।
প্রথম ভোজের মৃত্যুর পর ৮৮৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁহার পুত্র মহেন্দ্র পাল সিংহাসনে আরোহণ করেন ; তিনি বাংলার পালবংশের রাজা নারায়ণ পালকে পরাজিত করিয়া তাঁহার সাম্রাজ্য আরও বিস্তৃত করিয়াছিলেন এবং তাঁহার সময়েই প্রতিহার সাম্রাজ্য গৌরবের চরম শিখরে আরোহণ করিয়াছিল । তিনি শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ; কবি রাজশেখর তাঁহারই সভাকবি ছিলেন ।
তাঁহার পরবর্তী শক্তিশালী রাজা ছিলেন মহীপাল । তিনি ৯১২ হইতে ৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব মহীপাল রাষ্ট্রকূট-রাজের করিয়াছিলেন । তিনি কিছুকাল পর্যন্ত সাম্রাজ্যের গৌরব বজায় রাখিতে সক্ষম হইয়াছিলেন। অবশেষে রাষ্ট্রকূট-রাজ তৃতীয় ইন্দ্র কর্তৃক পরাজিত হইয়া তিনি কনৌজ পরিত্যাগ করিতে বাধ্য হন । এই সময় হইতেই প্রতিহার উপনীত নিকট পরাজিত সাম্রাজ্যের পতন আরম্ভ হয় ।
মহীপালের উত্তরাধিকারীগণের রাজত্বকালে প্রতিহার সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হইয়া যায় । তাঁহার পর দেবপাল, বিজয়পাল এবং জয়পাল যথাক্রমে রাজত্ব করেন। তাঁহাদের দুর্বলতার সুযোগে একাধিক রাজপুতবংশ উত্তর-ভারতে স্বাধীন রাজ্য স্থাপন করে। এইরূপে বিশাল গুর্জর প্রতিহার সাম্রাজ্য এক অতি ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয় । অবশেষে এই বংশের শেষ রাজা জয়পাল ১০১৯ খ্রীষ্টাব্দে সুলতান মামুদ কর্তৃক পরাজিত হন।
গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের গুরুত্ব :
ভারত-ইতিহাসে গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের গুরুত্ব যথেষ্ট ছিল । এই সাম্রাজ্যই ছিল উত্তর-ভারতের সর্বশেষ হিন্দুসাম্রাজ্য । কয়েকটি কারণের জন্য গুর্জর-প্রতিহার বংশের গুরুত্ব আরও বৃদ্ধি পায় ।
(১) তাঁহারাই সিন্ধুর আরবগণের আক্রমণ প্রতিহত করিয়া কয়েক শতাব্দীর জন্য ভারতবর্ষকে মুসলমান আধিপত্য হইতে রক্ষা করিয়াছিলেন। আরব পর্যটক সুলেমান স্পষ্টই লিখিয়াছিলেন যে, “ভারতে প্রতিহার রাজগণের ন্যায় ইসলামের প্রবল শত্রু আর কেহ ছিল না।”
(২) হর্ষবর্ধনের পরবর্তী যুগে ভারতে যে অনৈক্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা যায় তাহা দূর করিয়া উত্তর-ভারতে তাঁহারা রাজনৈতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিলেন ।
(৩) প্রতিহার রাজগণ সুদক্ষ শাসক ছিলেন; তবে তাঁহাদের শাসনব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক । সেইজন্য কেন্দ্রীয় শাসন দুর্বল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন হইয়া ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে পরিণত হয় ।
(৪) গুর্জর-প্রতিহার রাজগণ শিক্ষা ও সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক ছিলেন ; এই সময় হইতেই ভারতের বিভিন্ন আঞ্চলিক ভাষাসমূহ রূপ গ্রহণ করিতে থাকে ।
(৫) গুর্জর-প্রতিহারগণ বিদেশী আক্রমণকে প্রতিহত করার যে ঐতিহ্য সৃষ্টি করিয়াছিলেন পরবর্তী রাজপুত রাজবংশগুলি সেই ঐতিহ্য অনুসরণ করিয়া মুসলমান আক্রমণের বিরুদ্ধে অপূর্ব বীরত্ব প্রদর্শন করিয়াছিল ।