চাঁদ সদাগর কবিতার প্রশ্ন উত্তর
চাঁদ সদাগর কবিতার প্রশ্ন উত্তর
চাঁদ সদাগর ॥
কালিদাস রায় ॥
চাঁদ সদাগর কবিতার উৎস
‘চাঁদ সদাগর’ কবিতাটি কবির বিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ ‘বৈকালী’ থেকে নেওয়া।
• চাঁদ সদাগর কবিতার সংক্ষিপ্তসার
→ মনসামঙ্গল কাব্যের চাঁদ সদাগর ছিলেন শৈব। শিবের ভক্ত। -মনসাকে তিনি পূজার অযোগ্য দেবী বলে প্রত্যাখান করেছিলেন। এই প্রত্যাখান দেবী মনসা মেনে নিতে পারেন নি। চাঁদ সদাগরকে করার জন্য মনসা তাই তাঁর সাত পুত্রের জীবন এবং সব ধনসম্পদ কেড়ে নিয়েছিলেন। চাঁদ সদাগরকে নিঃস্ব করে ছেড়ে ছিলেন। জর্জরিত করেছিলেন তাকে পুত্রশোকে। কিন্তু চাঁদসদাগর এমনই অসাধারণ মানুষ ছিলেন যে, ওই লাঞ্ছনা সত্ত্বেও তিনি মনসার কাছে নতি স্বীকার করেন নি।
চাঁদ সদাগরের এই অজেয় পৌরুষ যুগ যুগ ধরে বাঙালিদের কাছে বন্দিত হয়ে এসেছে। সবাই যখন দেবতার পায়ে মাথা লুটিয়ে দিয়েছে, তিনি তখনো অবিচলিত, মাথা উঁচু করেই থেকেছেন। এই কবিতায় কবি কালিদাস রায় চাঁদ সদাগরের অজেয় পৌরুষকে শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তাঁর অনুপম কাব্যভাষায়। কবিতাটি চাঁদ সদাগরের উদ্দেশেই লেখা।
মঙ্গল কাব্যে দেব-দেবীদের বন্দনার মাঝে হঠাৎ দেখা গেল ওই একজন মানুষ, যিনি মনসা-স্তুতি ছেড়ে দিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছেন। ইনি হলেন সাধু চন্দ্রধর। অর্থাৎ চাঁদ সদাগর। কবি ওই চাঁদ সদাগরকে সম্বোধন করে বললেন, তুমি দেবতারো বড়ো।
তাই এ যুগের বন্দনার অর্ঘ্য তাঁকে কবি পাঠিয়ে দিচ্ছেন। এই সমতল বঙ্গভূমির তৃণলতাগুল্মের মধ্যে বজ্রজয়ী বনস্পতি হলেন ওই মানুষটি। এখন মানুষ কোথায়? জ্ঞানই হল ওঁর অস্ত্র, তিনি সত্যদ্বারা পালিত । সর্প ফণাকে তিনি জয় করেছেন। এমন শালপ্রাংশু মহাভুজ রথী আর কে আছে!
সান্তালী পর্বতের ওপর ঘর। হাতে হিন্তালের লাঠি। চাঁদের পৌরুষ দৃপ্ত-দীপ্ত। চাঁদের পাশে কোটি কোটি ভীরু অমানুষ। মরণ-বাঁচনের ত্রাসে তারা সবাই কম্পিত। চাঁদ কিন্তু নিজের প্রতিজ্ঞায় অটল। মাথায় যমদণ্ড পড়ল। কিন্তু সেই দণ্ড তাঁকে স্পর্শ করল না। সাত খণ্ড হয়ে সাত ছেলেকে গ্রাস করল। শ্মশানেশ্বরকে স্মরণ করে সাতপুত্রের শবের ওপর দাঁড়িয়ে চাঁদ হয়ে গেলেন বামাচারী কাপালিক।
সনকার কান্নায় চম্পকনগর কাঁদে। ডুবে যায় চোদ্দ মধুকর। চাঁদ নিঃস্ব হয়ে যান, কিন্তু তাঁর পুরুষাকার অনাহত। দারুণ শোকে শুকিয়ে যায় চোখের জল। আগুন ছোটে চোখ থেকে। চাঁদের এই ভয়ংকর গরল তাঁর উপাস্য শিব ধরে নেন তাঁর কন্ঠে। চারদিক বিষ আর বিষ। সহস্রফণা উদ্যত। তারই মাঝে নাগ বৈরী বৈনতেয় মত চাঁদের অজেয় পৌরুষ বিরাজমান।
নশ্বর-ঐশ্বর্য কেড়ে নিয়ে এমন মানুষকে ‘কে নিঃস্ব করবে’, এমন স্পর্ধা কার আছে? পুরুষার্থ যার শিরোভূষণ, অমন চিরকালীন ধনে যিনি ধনী, সারা বিশ্বে তিনি নমস্য। নানা ফন্দি এঁটেও দেবতারা তাঁকে বন্দী করতে পারেন নি। শেষে মানুষের সঙ্গে ওই দেবতারাও সন্ধি করলেন। যাঁরা দণ্ড বিধান করেন, সেই দণ্ডদাতা দেবতারাই তাঁর কাছে হলেন প্রার্থী।
নিয়তির যাঁরা জয়গান গায়, মাথা নত করাতে যাঁরা সর্বদা অগ্রসর, তাঁরা বুঝেছেন ওই মানুষটি বড়ো কঠিন। দম্ভভরা দৈব এঁর কাছে পরাভূত। কেঁপে উঠেছে পাথরের মন্দির। যুগ যুগ ধরে মানুষ দৈবকে মেনে এসেছে। এখানে তার বিপরীত কাণ্ড ঘটল। রুদ্র কন্ঠে বিদ্রোহী হলেন চাঁদ সদাগর। তিনি দেবতাদের টেক্কা দিলেন।
চাঁদকে দেখেই বোঝা গেল দেবত্বের থেকে মনুষ্যত্ব কম কিছু নয়। বরং ‘দেব নয়, মানুষই অমর’। মানুষই নির্মাণ করছে দেবতাকে, আর দেব-মহিমা মানুষের ওপরই নির্ভরশীল। এই অমোঘ সত্যটি ভোলা কী কখনো সম্ভব? চাঁদ সদাগর কোনো রকমেই আপশ করতে চাননি সত্যের সঙ্গে।
সুখ দুঃখ এবং সবরকম দ্বন্দ্বকে অতিক্রম করেই তিনি ‘মৃত্যুর শাসন’কে জয় করেছিলেন। আজ এ সব ইতিহাস। কালদণ্ডে গুঁড়ো হয়ে গেছে সহস্ৰ দেউল, চূর্ণ হয়ে গেছে কনকঘট, কিন্তু মৈনাকের চূড়োর মত গরল-সিন্ধুর মাঝে চাঁদ সদাগরের শৌর্য আজো অভ্রভেদী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
চাঁদ সদাগর কবিতার বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন: ১। চাঁদ ‘ চাঁদ সদাগরের চরিত্র কবি যে ভাবে চিত্রিত করেছেন তা বুঝিয়ে লেখো।
অথবা, ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতায় চাঁদ সদাগরের যে পরিচয় ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় প্রকাশ
অথবা, ‘তুমি দেবতারো বড়ো’—কাকে কবি দেবতার বড়ো বলেছেন? এ কথা বলার কারণ নির্দেশ কর।
অথবা, ‘বজ্র-জয়ী তুমি বনস্পতি’—কাকে লক্ষ্য করে কবির এই মন্তব্য? এ কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা কর।
অথবা, কালিদাস রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতায় চাঁদ সদাগরের যে পৌরুষ-দৃপ্ত চরিত্রের পরিচয় ফুটে উঠেছে তা আলোচনা করো। তাঁকে দেবতার চেয়েও বড় বলা হয়েছে কেন বুঝিয়ে দাও।
• উত্তর : মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যের এক অনন্যসাধারণ দেব-দ্রোহী নায়ক হলেন চাঁদ সদাগর। মনসামঙ্গল কাব্যের বনস্পতি সদৃশ এই চরিত্রটি নানাভাবে আলোচনার অবকাশ রাখে। অনমনীয় পৌরুষ এবং দুর্জয় তেজস্বিতার মূর্ত প্রতীক তিনি। যেখানে দেবতা মন্দির এবং সিন্দূর চন্দনে লিপ্ত, অগণিত দেব বিগ্রহের সর্বত্র ছড়াছড়ি, সেখানে চম্পক নগরের পরম শৈব চাঁদের মতো দেব-দ্রোহী উন্নত পুরুষকারের মূর্তি সত্যই বিরল ও বিস্ময়কর।
→ মধ্যযুগের কাব্য ছিল সম্পূর্ণ দেবনির্ভর ও দেবতাপ্রধান; সেখানে মানুষ ছিল অবহেলিত ও অপাংক্তেয়। চাঁদ সদাগর চরিত্রেই প্রথম মানুষের ও মনুষ্যত্বের মর্যাদা স্বীকৃত হয়েছে। যুগ-যুগান্তর ধরে জীব সাধারণ দেবদণ্ড ভোগ করে এসেছে। সেই নির্যাতিত জীব সাধারণই যেন সংহত হয়ে চাঁদের রুদ্রকণ্ঠের মধ্য দিয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল। নিয়তিলাঞ্ছিত অসহায় দুর্বল চিত্ত বাঙালি ছিল যেন তৃণলতার মতো, অপরপক্ষে অজেয় পৌরুষ ও অবিচল আত্মবিশ্বাসে মহীয়ান চাঁদ সদাগর ছিলেন ‘বজ্রজয়ী বনস্পতি’ এবং বিচারে তিনি দেবতার থেকে বড়ো।
পরম শৈৱ চাঁদ পূজা প্রার্থিনী মনসাদেবীকে প্রত্যাখ্যান করায় মনসার কোপে চাঁদ সর্বস্বহারা হন। মনসা একের পর এক তাঁর সাত পুত্র, ধন-রত্নপূর্ণ সপ্তডিঙ্গা মধুকর এবং যাবতীয় বিষয় ঐশ্বর্য বিনষ্ট করে চাঁদকে সর্বস্বান্ত করেন। নিঃস্ব অসহায় চাঁদ সর্বস্ব হারিয়ে এক বস্ত্রে পথে পথে ঘুরে বেড়ান, তবুও মনসার কাছে একবারের জন্যও নতিস্বীকার করেননি। শুরু হয়েছিল চরমভাবে দেবী ও মানবের সংগ্রাম। পুত্রশোকে কাতরা সনকার বুক ফাটা আর্তনাদে চম্পক নগরের আকাশ-বাতাস কেঁপে ওঠে। এসব মানবিক শোক-যন্ত্রণা উপেক্ষা করে চাঁদ আপন সংকল্পে অবিচল ও অটল থাকেন; মনসার কাছে মাথা নত করেন না।
এরপর মনসার নিষ্ঠুরতায় চাঁদের অষ্টম পুত্র লখিন্দরের বাসর ঘরে মৃত্যু হয়। তখনও চাঁদ অনমনীয় এবং প্রতিজ্ঞায় অটল। তাঁর চোখ শুষ্ক, হৃদয় পাষাণ। তিনি তখন গরুড়ের মতো চরম সর্পদ্বেষী। সমস্ত ঐশ্বর্য ও বিষয়-আশয় হারালেও চাঁদের পৌরুষকে ছলে-বলে ও কৌশলে কোন দৈবীশক্তি পরাভূত করতে পারেনি। ‘কালের দণ্ডের আঘাতে কত মন্দির ধূলিসাৎ হয়েছে, চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়েছে কত কনক ঘট, কিন্তু চাঁদ সদাগর মৈনাকের চির উন্নত শীর্ষের মতো অপরাজেয় শৌর্য নিয়ে মানুষের মনের মন্দিরে চির বিরাজমান।’
দৈবের সঙ্গে সংগ্রামে পাষাণ মন্দিরের ভিত্তি কেঁপে উঠেছে। তিনি মানুষকে প্রকৃত শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়েছেন যে,
“মানুষ দেবতা গড়ে, তাহারই কৃপার ‘পরে,
করে দেব-মহিমা নির্ভর।”
দেবতার বিরুদ্ধে নিরন্তর সংগ্রাম করে চাঁদ সদাগর এই সত্য শিখিয়েছেন যে, মানুষের কল্পনাতেই দেবতার প্রতিষ্ঠা, এবং মানুষের করুণার উপরই দেবমহিমা নির্ভর করে। দেবতার মহিমা বা গৌরব মানুষই প্রচার করে।
→ মানুষকেও চাঁদ মনুষ্যত্ব শিক্ষা দিয়েছেন এবং বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছেন
—’মানুষেরও চাই যজ্ঞ ভাগ।’ সকল ভোগবাসনাকে তিনি জয় করতে পেরেছিলেন বলেই দৈবদণ্ডকে নিয়তির বিধান বলে মেনে নেননি। দেবদ্রোহী এই নায়কই মানুষকে অমরত্ব দিয়ে গেছেন। বজ্রের নির্মম আঘাত সহ্য করে বনস্পতি যেমন উন্নতশির, তেমনি দেবতার কঠোর শাসন ও দণ্ডকে উপেক্ষা করে চাঁদ সদাগর আপন মহিমায় আজও ভাস্বর হয়ে আছেন সাহিত্যের ‘বাণীতীর্থে’।
প্রশ্ন : ২। ‘বাণীতীর্থে উচ্চে তুলি শির। তুমি দেবতারো বড়ো।’—কার সম্পর্কে এই মন্তব্য করা হয়েছে? ‘বাণীতীর্থ বলতে কবি কী বোঝাতে চেয়েছেন?
• উত্তর :
কালিদাস রায়ের ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতার অন্তর্গত উদ্ধৃতাংশে পৌরুষদৃপ্ত ব্যক্তিত্বময়
বিদ্রোহী চরিত্র চাঁদ সদাগর সম্পর্কে এই মন্তব্য করা হয়েছে। → আলোচ্যাংশে ‘বাণীতীর্থ’ বলতে বাংলা সাহিত্যের কাব্যের জগৎ, বিশেষ করে মধ্যযুগের কাব্যকাননকে বোঝান হয়েছে। তীর্থ বলার বিশেষ তাৎপর্য হল,—মধ্যযুগের কাব্যকাননের সর্বত্রই ছিল দেবমাহাত্ম্যের ছড়াছড়ি। ধর্মচর্চার আশ্রয় ও দেবনির্ভর ভাবনায় মধ্যযুগের সাহিত্য প্রাঙ্গণ পূর্ণ ছিল। ভাষা ও সাহিত্য দিয়ে সৃষ্ট ‘তীর্থ’ বলেই তা কবির ভাষায়, ‘বাণীতীর্থ’।
প্রশ্ন : ৩। ‘মানুষই দেবতা গড়ে তাহারই কৃপার ‘পরে/করে দেব-মহিমা নির্ভর’—চাঁদ সদাগর’ কবিতা অবলম্বনে এই মন্তব্যের যাথার্থ্য বুঝিয়ে দাও।
উত্তর : কবি কালিদাস রায় তাঁর ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতায় চাঁদ সদাগর সম্বন্ধে এই মন্তব্য করেছেন। [এর সঙ্গে ১নং প্রশ্নোত্তরের ১ম ও ২য় অনুচ্ছেদ (‘মানুষই প্রচার করে’ পর্যন্ত) যোগ কর।]
চাঁদ সদাগর কবিতার ছোট প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন : ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতার রচয়িতা কে?
উত্তর : কবিশেখর কালিদাস রায় হলেন ‘চাঁদ সদাগর’ কবিতার রচয়িতা।
প্রশ্ন : কাকে দেবতারো বড়ো বলা হয়েছে?
– উত্তর : চাঁদ সদাগরকে ‘দেবতারো বড়’ বলা হয়েছে।
প্রশ্ন : ‘জ্ঞানায়ুধ’ বলতে কী বোঝ?
উত্তর : জ্ঞান যাঁর অস্ত্র, সেই ব্যক্তিকে জ্ঞানায়ুধ বলে।
প্রশ্ন : ‘সান্তালী পর্বত’ কাকে বলে?
উত্তর : সপ্ততাল পর্বতকে ‘সান্তালী পর্বত’ বলা হয়েছে। প্রশ্ন : ‘হিন্তালের যষ্টি’ কী?
উত্তর : হেঁতালের তৈরি লাঠিকে, বলা হয়।
প্রশ্ন : বামাচারী কাপালিক’ কাকে বলা হয়েছে?
উত্তর : চাঁদ সদাগরকে ‘বামাচারী কাপালিক’ বলা হয়েছে।
প্রশ্ন : ‘সনকা’ কে?
উত্তর : চম্পকনগরবাসী চন্দ্রধর বণিকের স্ত্রী হলেন ‘সনকা’।
প্রশ্ন : নাগবৈরী বৈনতেয় কে?
উত্তর : নাগবৈরী বৈনতেয় বলতে সর্পের চিরশত্রু বিনতানন্দন গরুড়কে বোঝানো হয়েছে।
প্রশ্ন: মৈনাক নাম হলো কেন?
উত্তরঃ হিমালয় এবং মেনকার পুত্র বলে তার নাম মৈনাক হয়েছে