মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলী আলোচনা কর
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা :
উত্তর। বিশ্বের গণতান্ত্রিনক দেশগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা ক্ষমতা ও মর্যাদার অধিকারী হলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি। অধ্যাপক স্ট্রং (C. E. Strong)-এর মতে, “পৃথিবীর অন্য কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ন্যায় ক্ষমতাধর রাষ্ট্রপ্রধান দেখা যায় না।”। তিনি একাধারে রাষ্ট্রের প্রধান এবং সরকারের প্রধান। তিনি ইংল্যাণ্ডের রাজার মত রাজত্ব করেন, আবার ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর মত শাসনও করেন। তাই ব্রোগান বলেছেন, “He is the formal head of the nation; he is also the effective head of the executive.” বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্রপতিই হলেন মার্কিন শাসন ব্যবস্থার কেন্দ্রীয় চরিত্র’ ।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ও কার্যাবলীকে নিম্নলিখিত কয়েকটি ভাগে ভাগ করে আলােচনা করা হল :
১) মার্কিন রাষ্ট্রপতির শাসন সংক্রান্ত ক্ষমতা :
(ক) আইন প্রয়োেগ : শাসন বিভাগের প্রধান হিসাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতির প্রধান দায়িত্ব হল আইন বিভাগ প্রণীত আইনসমূহ এবং বিচারালয়গুলির রায়গুলিকে যথাযথভাবে কার্যকর করা। এই উদ্দেশ্যে তাঁকে নীতি নির্ধারণ করতে হয়, প্রশাসনিক আদেশ জারী করতে হয়, বিভিন্ন বিভাগের প্রধান ও কর্মচারীদের প্রয়ােজন মত নির্দেশ দিতে হয়।
(খ) নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির হাতে ব্যাপক নিয়ােগ সংক্রান্ত ক্ষমতা ন্যস্ত আছে। তিনি সরকারী কর্মচারীদের, যুক্তরাষ্ট্রীয় আদালতসমূহের বিচারকদের, ক্যাবিনেট সদস্যদের, দেশের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের নিয়ােগ করেন। উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রপতিকে সিনেটের অনুমতি নিতে হয়। বর্তমানে সিনেট প্রচলিত সৌজন্যবিধির জন্য সাধারণত এইসব নিয়ােগগুলিকে অনুমােদন করে দেয়।
(গ) সামরিক ক্ষমতা:
রাষ্ট্রপতি দেশের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সর্বাধিকনায়ক। সৈন্যবাহিনী সংগঠন, বিদেশে সৈন্য প্রেরণ, কোন দেশ আক্রমণ, যুদ্ধবিরতি ঘােষণা প্রভৃতি রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতার অন্তর্ভুক্ত। যুদ্ধকালীন অবস্থায় রাষ্ট্রপতির সামরিক ক্ষমতা উল্লেখযােগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।
(ঘ) বৈদেশিক ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতি হলেন দেশের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণে চূড়ান্ত ক্ষমতার অধিকারী এবং তিনিই আন্তর্জাতিক বিষয়ে দেশের একমাত্র মুখপাত্র। তিনি যে কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন বা চুক্তি সম্পাদন করতে পারেন। তবে এরূপ সন্ধি বা চুক্তি কার্যকর মার্কিন করার জন্য সিনেটের দুই-তৃতীয়াংশ সদস্যের অনুমােদন প্রয়ােজন। তিনি কোন দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করতে পারেন, আবার ছিন্ন করতেও পারেন।
(ঙ) জরুরী অবস্থা-বিষয়ক ক্ষমতা; সংবিধানে উল্লেখ না থাকলেও মার্কিন রাষ্ট্রপতি দেশের সংকটজনক অবস্থায় জরুরী ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন। কংগ্রেস তথা জনসাধারণ রাষ্ট্রপতির এই ক্ষমতাকে স্বীকার করে নিয়েছেন। গৃহযুদ্ধের সময় আব্রাহাম লিঙ্কন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় উড্রো উইলসন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় টুম্যান ও আইজেন হাওয়ার, ত্রিশের দশকে দেশের অর্থনৈতিক সংকটের সময় রুজভেল্ট প্রভৃতি রাষ্ট্রনায়করা এই ক্ষমতা ব্যবহার করেছিলেন।
২) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির আইন সংক্রান্ত ক্ষমতা :
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতিটি প্রয়ােগ করা হয়েছে। তাই তত্ত্বগত বিচারে রাষ্ট্রপতি যেহেতু শাসন বিভাগের প্রধান, সেহেতু আইন সংক্রান্ত বিষয়ে তাঁর কোন ক্ষমতা না থাকারই কথা। তিনি কংগ্রেসের সদস্য নন। তিনি আইনসভার অধিবেশন আহ্বান করতে, স্থগিত রাখতে বা আইন সভার নিম্নকক্ষকে ভেঙে দিতে পারেন তিনি আইনসভায় বিল উত্থাপন করতে বা বিতর্কে অংশগ্রহণ করতে পারেন না। তাই অধ্যাপক ল্যাস্কি বলেছেন, স্বাভাবিক অবস্থায় মার্কিন রাষ্ট্রপতি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর আইন বিষয়ক ক্ষমতাকে ঈর্ষা করতে বাধ্য।
কিন্তু তত্ত্বগতভাবে বিচার না করে বাস্তবের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে দেখা যাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি আইন সংক্রান্ত বিষয়েও উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে থাকেন। অধ্যাপক ফাইনার যথার্থই মন্তব্য করেছেন, “He has become a very active legislative leader.” যে সমস্ত উপায়ে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের আইন সংক্রান্ত কার্যাবলীর ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেন সেগুলি নিম্নে আলােচনা করা হল :
(ক) বাণী প্রেরণ : সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি মাঝে মাঝে কংগ্রেসের কাছে দেশের অবস্থা সম্পর্কে বাণী (Presidential message) পাঠাতে পারেন। এই সকল বাণীর মধ্যে শুধু দেশের অবস্থা সম্পর্কে সংবাদই থাকে না, বিভিন্ন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়ােজনীয় সুপারিশও থাকে। উদাহরণস্বরূপ ১৯৫৪ সালে রাষ্ট্রপতি আইজেনহাওয়ার কংগ্রেসের নিকট যে বাণী প্রেরণ করেন তাতে দেশের কৃষি সমস্যা, অর্থ সমস্যা, শ্রম সমস্যা, পররাষ্ট্রনীতি প্রভৃতি ৬৫টি বিষয়ে নতুন আইন প্রণয়নের জন্য সুপারিশ করা হয়। কংগ্রেসের পক্ষে এই সমস্ত সুপারিশগুলিকে অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয় না, কারণ এগুলির পিছনে জনগণের সমর্থনও থাকে।
(খ) ভিটো প্রয়ােগের ক্ষমতা : রাষ্ট্রপতির সম্মতি ছাড়া কংগ্রেস কর্তৃক গৃহীত কোন বিল আইনে পরিণত হতে পারে না। সংবিধান অনুসারে রাষ্ট্রপতি কোন বিলে সম্মতি দিতে পারেন, নাও দিতে পারেন অথবা সম্মতি দান স্থগিত রাখতে পারেন। একে বলা হয় রাষ্ট্রপতির ভিটো ক্ষমতা। বস্তুত এই ভিটো ক্ষমতা প্রয়ােগের মাধ্যমে অথবা প্রয়ােগের হুমকি দেখিয়ে তিনি কংগ্রেসের আইন সংক্রান্ত ক্ষমতাকে যথেষ্ট প্রভাবিত করতে পারেন।
(গ) বিশেষ অধিবেশন আহ্বান : সাধারণভাবে কংগ্রেসের অধিবেশন আহ্বান করতে না পারলেও রাষ্ট্রপতি জরুরী কোন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রয়ােজনে বিশেষ অধিবেশন আহ্বান করতে পারেন। জনমত তাঁর পক্ষে থাকলে, এবং কংগ্রেসে তার দলীয় সদস্যরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হলে, এই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতি তাঁর উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারেন।
(ঘ) প্রশাসনিক নির্দেশ দান; সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে অর্ডিন্যান্স (Ordinance) বা ‘শাসন বিভাগীয় আদেশ’ (executive order) জারি করার যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে তার মাধ্যমেও তিনি আইন সংক্রান্ত ব্যাপারে যথেষ্ট প্রভাব খাটাতে পারেন।
(ঙ) চাকুরি বিতরণ: চাকুরি প্রদান ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধা বিতরণের (distribution of spoils) মাধ্যমে রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের অনেক সদস্যকে নিজ বশে রাখতে সমর্থ হন।
(চ) জনমতের ওপর প্রভাব: রাষ্ট্রপতি কংগ্রেসের নিকট যেসব সুপারিশগুলি পাঠান সেগুলি বেতার, দূরদর্শন, সংবাদপত্র প্রভৃতি যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করে থাকে। রাষ্ট্রপতির ইচ্ছা অনুযায়ী আইন প্রণয়ন না করলে জনসমর্থন হারাতে হবে—এই ভয়ে কংগ্রেস রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধাচারণ করতে পারে না।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতাস্বতন্ত্রীকরণ নীতি অনুসৃত হলেও রাষ্ট্রপতি বিভিন্নভাবে কংগ্রেসের আইন সংক্রান্ত ক্ষমতার ওপর প্রভাব খাটাতে পারেন।
(৩)মার্কিন রাষ্ট্রপতির বিচার সংক্রান্ত ক্ষমতা :
রাষ্ট্রপতি সুপ্রীম কোর্টের বিচারপতিদের নিয়ােগ করেন। তবে তাদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির নেই। রাষ্ট্রপতি দণ্ডাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তির দণ্ডাদেশ হ্রাস করতে পারেন, দণ্ডাদেশ স্থগিত রাখতে পারেন অথবা দণ্ডিত ব্যক্তিকে ক্ষমা প্রদর্শন করতে পারেন।
(8) মার্কিন রাষ্ট্রপতির অর্থ সংক্রান্ত ক্ষমতা;
১৯২১ সালের বাজেট ও হিসাব রক্ষা আইন অনুসারে রাষ্ট্রপতি সরকারী ব্যয় নির্বাহের জন্য কংগ্রেসের নিকট প্রয়ােজনীয় অর্থ দাবি করতে পারেন, বিভিন্ন বিভাগের আনুমানিক ব্যয় বরাদ্দ বৃদ্ধি করতে, হ্রাস করতে অথবা সংশােধন করতে পারেন। তিনি বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব বা বাজেট পেশ করেন কংগ্রেসের নিকট। এছাড়া বিভিন্ন পরিপূরক ব্যয় বরাদ্দের দাবিও তিনি কংগ্রেসের নিকট উত্থাপন করতে পারেন।
৫ে ) বিশ্ব-নেতা হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ভূমিকা :
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে বিশ্ব রাজনীতিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়, ৯০-এর দশকে এসে তা চূড়ান্ত আকার ধারণ করে। ঐ সময় থেকে সােভিয়েত রাশিয়া তথা আরও কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশের বিপর্যয়ের পরিপ্রেক্ষিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্ব-রাজনীতির নিয়ামক শক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। বলাবাহুল্য বিশ্বরাজনীতির এই নতুন প্রেক্ষাপটে মার্কিন রাষ্ট্রপতির ভূমিকা ও তৎপরতা আগের থেকে বহুগুণ বেড়ে গেছে।
উপরােক্ত আলােচনা থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতির ব্যাপক ক্ষমতা ও পদমর্যাদা সম্পর্কে সহজেই অনুমান করা যায়। অগ এবং রে মন্তব্য করেছেন যে, “কেবলমাত্র ইউরােপের স্বৈরাচারী শাসকদের বাদ দিলে অন্য কোথাও মার্কিন রাষ্ট্রপতির মত ক্ষমতা সম্পন্ন শাসকপ্রধানের সন্ধান পাওয়া যায় না। অনুরূপভাবে স্ট্রং (C. F. Strong) বলেছেন, “মার্কিন রাষ্ট্রপতির ন্যায় ক্ষমতাসম্পন্ন রাষ্ট্রপ্রধান পৃথিবীর আর কোন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে দেখা যায় না। অবশ্য রাষ্ট্রপতি পদের ক্ষমতা ও মর্যাদা অনেকখানি নির্ভর করে পদাধিকারীর ব্যক্তিত্ব ও কর্মদক্ষতার ওপর।