ভারতের ইতিহাসের উপাদান গুলি কি কি আলোচনা করো

  ভারতের ইতিহাসের উপাদান গুলি কি কি আলোচনা করো

ভারতের-ইতিহাসের-উপাদান-গুলি-কি-কি-আলোচনা-করো

 

 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের উপাদান :

 

প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের অনুসন্ধান করতে গিয়ে অনেকেই বিজ্ঞানসম্মত ঐতিহাসিক গ্রন্থের স্বল্পতার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রাচীন ভারতের কোনো লিপিবদ্ধ ইতিহাস পাওয়া যায় নি। ফলে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায় কয়েকটি উপাদান বা নিদর্শনের উপর নির্ভর করতে হয়। এই উপাদানগুলাে হল – (১) সাহিত্য, (২) বৈদেশিক বিবরণ, (৩) প্রত্নতত্ত্ব।

 

 • সাহিত্য :

 

ধর্মগ্রন্থ ও সাহিত্য 

 

প্রাচীনকালে ভারতে রচিত ধর্ম পুস্তক ও সাহিত্য থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানা যায়। বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত এবং বিভিন্ন বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মগ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতির অবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক, সিংহলের দীপবংশ ও মহাবংশ, অশ্বঘােষের বুদ্ধচরিত, জৈন গ্রন্থ পরিশিষ্ট পার্বণ, ভগবতীসূত্র প্রভৃতি ধর্মগ্রন্থ থেকে উত্তরভারতের প্রাচীন ইতিহাসের পরিচয় পাওয়া যায়। বিশাখ দত্তের মুদ্রারাক্ষস, পাণিনির অষ্টাধ্যায়ী, কালিদাসের বিভিন্ন নাটক, ভারত ইতিহাসের অমূল্য উপাদান। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে মৌর্যযুগের রাজনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। বৈদিক সাহিত্যে পুরাণ বলতে প্রাচীন কাহিনি বােঝাতাে। পুরাণগুলির মধ্যে উল্লেখযােগ্য হল বায়ু, বিষ্ণু, ব্ৰত্মাণ্ড ও ভাগবত পুরাণ।

 

ভারতের ইতিহাসের উপাদান জীবন কাহিনি :

 

 ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে জীবনচরিতগুলিও বিশেষ মূল্যবান। সপ্তম শতক থেকে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত কাশ্মীরের ইতিহাস জানা যায় কলহনের রচিত রাজতরঙ্গিণী থেকে। এই গ্রন্থকে ভারতের প্রথম ইতিহাস গ্রন্থের মর্যাদা দেওয়া হয়। আর্যভট্টের সূর্য সিদ্ধান্তে বিজ্ঞান চর্চার তথ্য পাওয়া যায়। বাকপতির গৌড়বহাে গ্রন্থে যশােবর্মনের গৌড়বিজয় কাহিনি জানা যায়। শূদ্রকের মৃচ্ছকটিক, হর্ষবর্ধনের রত্নাবলী, মেরুতুঙ্গের প্রবন্ধ চিন্তামণি, বাংলার চর্যাপদ প্রভৃতি প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনার মূল্যবান উপাদান। এছাড়া বিভিন্ন রাজাদের জীবন কাহিনি নিয়ে রচিত সন্ধ্যাকর নন্দীর রামচরিত, বানভট্টের হর্ষচরিত, বিহলন রচিত বিক্রমাঙ্কদেবচরিত প্রভৃতি গ্রন্থ থেকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাস সম্বন্ধে জানা যায়। এই জীবন কাহিনিমূলক স্মৃতিকথা কিছু অতিরঞ্জিত হলেও এর থেকে তৎকালীন সমাজ, ধর্ম, রাজনৈতিক চিত্র ফুটে উঠেছে। 

 

 বৈদেশিক বিবরণ ঃ

 

 গ্রিকদের বিবরণ:

   প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল বিদেশিদের লিখিত বিবরণ। প্রাচীনকালে বিভিন্ন দেশের পর্যটকরা ভারতে এসেছিলেন এবং ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বিবরণ লিখেছিলেন। এছাড়া বিদেশী ঐতিহাসিকদের লেখা থেকে ভারতের ইতিহাসের অনেক তথ্য পাওয়া গেছে। এক অজ্ঞাত গ্রিক নাবিক রচিত “পেরিপ্লাস অফ দ্য ইরিথ্রিয়ান সী” নামক গ্রন্থ থেকে খ্রিস্টিয় প্রথম শতকের ভারতের বন্দর, বাণিজ্য, অর্থনীতি ও ভৌগােলিক অবস্থার বিবরণ পাওয়া যায়। এছাড়া জাষ্টিন, প্লুটার্ক, কার্টিয়াস প্রভৃতির রচনা থেকে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের বর্ণনা পাওয়া যায়। গ্রিকদূত মেগাস্থিনিস রচিত ইণ্ডিকা গ্রন্থ থেকে মৌর্যযুগের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক অবস্থার বিবরণ জানা যায়। চীনা পর্যটক ফা-হিয়েনের বর্ণনায় গুপ্তযুগের সম্বন্ধে জানা গেছে। হিউয়েন-সাঙ হর্ষবর্ধনের সময়কালে ভারতের সম্পর্কে ঐতিহাসিক তথ্যসমৃদ্ধ বিবরণ রেখে গেছেন। চিন দেশের ই-সিং এবং তিব্বতী ঐতিহাসিক তারানাথের রচিত গ্রন্থ থেকে ভারতের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে।

 

() আরবীয় বিবরণ :

  আরবীয় পর্যটক আলবেরুনি সুলতান মামুদের ভারত আক্রমণের সময় ভারতে এসে বহুদিন ভারতে ছিলেন এবং সংস্কৃত ভাষা শিখে তহকিক-ই-হিন্দ নামে একটি গ্রন্থ লেখেন। এই গ্রন্থে ভারতের দর্শন, বিজ্ঞান, জ্যোতিষশাস্ত্র, রীতিনীতি সম্বন্ধে লিখেছিলেন। এছাড়া হাসান নিজামী, আলবিলাদুরী, আল মাসুদী প্রভৃতি আরব লেখকদের গ্রন্থে রয়েছে ভারত সম্পর্কে অনেক তথ্য।

 

ভারতের ইতিহাসের উপাদান প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানঃ

 

প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান প্রাচীন ভারতের ইতিহাস রচনায় সর্বাপেক্ষা মূল্যবান উপাদান। প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানে হরপ্পা সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে। প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান হল – লিপি, মুদ্রা, সহাপত্য, ভাস্কর্য প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ প্রভৃতি। 

ভারতের ইতিহাসের উপাদান গুলি কি কি আলোচনা করো

 লিপি : 

 

লিপি হল প্রাচীন ভারতের অত্যন্ত মূল্যবান উপাদান। ভারতের বিভিন্ন স্থানের পর্বতগাত্রে স্তম্ভে, তামা, ব্রোঞ্জ ও সােনার পাতে খােদাই করা লিপি আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে শিলালিপি ও তাম্রলিপি হল গুরুত্বপূর্ণ। লিপি দুই ধরণের হয় সরকারি লিপি ও বেসরকারি লিপি। সরকারি লিপিতে– যুদ্ধবিগ্রহ, ভূমিদান, ধর্মপ্রচার, রাজার আদেশ, এবং রাজার কীর্তি স্মরণীয় করার জন্য লিপি উৎকীর্ণ করা হত। এই লিপিগুলিতে রাজার নাম, রাজত্বকাল, রাজ্যজয়, ধর্মবিশ্বাস, দানপত্র প্রভৃতি শিলমােহর বিষয়ে জানা যায়। বেসরকারি লিপি পাথরে মন্দিরের গায়ে স্তম্ভে লেখা হত। 

 লিপিগুলি সংস্কৃত, পালি, খরােষ্ঠী, ব্রাক্ষ্মী প্রভৃতি হরফ ও ভাষায় লেখা হয়েছিল। সম্রাট অশােকের শাসনকালে ব্রাক্ষ্মী লিপি, উত্তর পশ্চিম ভারতে খরােষ্ঠী লিপি ও গুপ্ত যুগে সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার হত। অশােকের শিলালিপি ভারতে বহুস্থানে পাওয়া গেছে। ১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দে জেমস প্রিন্সেপ নামে এক ইংরেজ অশােকের শিলালিপি পাঠোদ্ধার করেছিলেন। এছাড়া গৌতমীপুত্র সাতকর নাসিক প্রশস্তি, সমুদ্রগুপ্তের এলাহাবাদ প্রশস্তি, কলিঙ্গরাজ খারবেলের হস্তীগুম্ফা লিপি, দ্বিতীয় পূলশেীর আইহােল লিপি ও শকরাজ রূদ্রদামনের জুনাগড়লিপি ঐতিহাসিক তথ্যে সমৃদ্ধ ছিল। 

 

 বহির্ভারতের আবিষ্কৃত লিপি :

 

 ভারতের বাইরে আবিষ্কৃত লিপি থেকে ভারতের ইতিহাসজানা যায়। এশিয়া মাইনরের বােঘােজকোই লিপি থেকে ভারতের আর্যদের সম্বন্ধে জানা যায়। নক-ই-রুস্তম, পার্সেপােলিস, যবদ্বীপ, সুমাত্রা, ইন্দোচীন প্রভৃতি স্থানে আবিস্কৃত লিপি থেকে এই স্থানের সঙ্গে ভারতের ব্যবসা-বাণিজ্য ও সাংস্কৃতিক সম্পর্কের পরিচয় পাওয়া যায়।

 

ভারতের ইতিহাসের উপাদান গুরুত্ব :

ইতিহাস প্রণয়নে লিপিমালা খুবই গুরুত্ব পূর্ণ। (১) লিপি থেকে রাজার নাম, বংশ, কার্তিকলাপ জানা যায়। (২) প্রচলিত ভাষা, (৩) ভূমি ব্যবস্থা, (৪) রাজনৈতিক সামাজিক ও ধর্ম বিষয়, (৫) প্রাপ্তিস্থান থেকে রাজ্যের সীমানা, (৬) খােদিত লিপি অবিকৃত থাকে। ফলে লিপিগুলি হল নির্ভরযােগ্য উপাদান।

 

মুদ্রা :

 

 প্রাচীন ভারতের ইতিহাস জানার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল মুদ্রা। মুদ্রাগুলিতে রাজার নাম, সন-তারিখ, রাজার মূর্তি, নানা দেবদেবীর মূর্তি খােদাই করা থাকত। মুদ্রার প্রাপ্তিস্থান থেকে রাজ্যের সীমানা অনুমান করা যায়। মুদ্রা থেকে ধাতু শিল্প, শিল্পকলা, লিপিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক অবস্থার পরিচয় পাওয়া যায়। কণিষ্কের মুদ্রায় দেবদেবীর মূর্তি থেকে রাজার ধর্মীয় আদর্শের কথা জানা যায়। সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রায় বীণাবাদনরত মুর্তি তাঁর সঙ্গীতানুরাগের পরিচয় দেয়। মুদ্রার সাহায্যে শক, গ্রিক, কুষাণদের ইতিহাস জানা সম্ভব হয়েছে। গুপ্তযুগের মুদ্রায় রােমের প্রভাব দেখা যায়। মৌর্যদের তাম্র, সীসা ও ব্রোঞ্জের মুদ্রার গুরুত্ব যথেষ্ট। পাল যুগের নারায়ণী মুদ্রা’, পুরাণ, কড়ি প্রভৃতি মুদ্রা আবিষ্কৃত হয়েছে।

 

 মুদ্রা থেকে বহু সময়কাল জানা গেছে – যথা বিক্রমসম্বৎ (৫৭ খ্রিঃ পূর্ব), শকাব্দ (৭৮ খ্রিঃ), হর্ষাব্দ (৬০৬ খ্রিঃ)। আর্যদের স্বর্ণমুদ্রা ‘মনা’, ‘নিষ্ক’, চোলদের স্বর্ণমুদ্রা ক্যাসু’ ঐসব জাতির আর্থিক সমৃদ্ধির প্রমাণরূপে পরিগণিত। মুদ্রা বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক যােগাযােগের পরিচয় বহন করেছে।

 

 ভারতের ইতিহাসের উপাদান স্থাপত্য ও ভাষ্কর্য :

 

  প্রত্নতাত্ত্বিক খনন কার্যের ফলে ভারতের নানা স্থানে প্রাচীন মন্দির, অট্টালিকা, দুর্গ, পথঘাট, দেবদেবীর মূর্তি, আসবাবপত্র, মৃৎপাত্র ও অন্যান্য ব্যবহৃত দ্রব্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন রূপে পাওয়া যায়। এই খনন কার্যের ফলে ভারতে তিন হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দের হরপ্পা সভ্যতার কথা জানা যায়। স্থাপত্য ও শিল্পকলার নিদর্শন কোনাে যুগের সমাজজীবন, অর্থনৈতিক জীবনের চিত্র উদঘাটিত করে। তক্ষশিলা, সারনাথ পাটলিপুত্র, হস্তিনাপুর প্রভৃতি স্থানের স্থাপত্য ও ভাষ্কর্যের নিদর্শন ভারতীয় সভ্যতার উৎকর্ষের ইতিহাস ফুটিয়ে তুলেছে। ভারতের বাইরে তুর্কীস্থান, বেলুচিস্তান, কম্বােজের আঙ্কোরভাট, জাভায় বরােবুদুর মন্দির প্রভৃতি ভারতীয় উপনিবেশ, সভ্যতা, সংস্কৃতি বিস্তারের কাহিনির সাক্ষ্য বহন করেছে।

 

 খনন কার্যের ফলে জানা যায় দ্রাবিড়রা সিন্ধুনদের তীরে হরপ্পা সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। দ্রাবিড় ও আর্য সভ্যতার মিশ্রণের বহু তথ্য খনন কার্যের ফলে পাওয়া গিয়েছে। তক্ষশিলার ভীরমাউন্ট, সিরমুখ ও সিরকাপ নগরে পারসিক ও গ্রিক সভ্যতার প্রসার ঘটেছিল তা খননকার্যের ফলে জানা গিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *