বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা
বৈদিক যুগ বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য
বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন
বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের সূচনা |
বৈদিক যুগ: হরপ্পা সভ্যতার পরবর্তীকালে ভারতে আর্য সভ্যতা বা বৈদিক সভ্যতা গড়ে উঠেছিল। এই সভ্যতা গড়ে ওঠার সময় থেকেই ভারতবর্ষে ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়েছে। আর্যরা এই সভ্যতার স্রষ্টা। আর্যদের প্রাচীন সাহিত্য বেদ থেকে আর্যসভ্যতার কথা জানা যায় বলে এই সভ্যতাকে বৈদিক সভ্যতা বলে। আর্য কথাটি ভাষাবাচক, জাতিবাচক নয়। যারা এই ভাষায় কথা বলে তাদের আর্য বলে। ইন্দো-ইয়ােরােপীয় ভাষা হল আর্যভাষা। আর্য শব্দের অর্থ হল সৎবংশজাত সভ্য মানুষ।
বৈদিক যুগ: আর্যদের আদি বাসভূমি ঃ
আর্যদের আদি বাসস্থান নিয়ে মতভেদ আছে। অনেক পণ্ডিত মনে করেন আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল ভারত এবং ভারত থেকেই আর্যরা বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল। গঙ্গনাথ ঝা, ডি.এস.ত্রিবেদী, এল.ডি.কল্লা প্রভৃতি ঐতিহাসিকরা ভারতবর্ষেই আর্যদের আদি বাসস্থান বলে যুক্তি দেখিয়েছেন। তাদের যুক্তিগুলি হল– (১) বৈদিক সাহিত্য ভারতের বাইরে অন্য কোথাও বিকাশিত হয়নি। (২) বৈদিক সাহিত্যে ভারতের পাঞ্জাব ও সপ্তসিন্ধু অঞ্চলের বর্ণনা রয়েছে। ভারতের বাইরে আর্যদের বাসস্থান হলে বৈদিক সাহিত্যে আর্যদের ছেড়ে আসা অঞ্চলের ভৌগােলিক বর্ণনা থাকত। কিন্তু বৈদিক সাহিত্যে তা নেই। (৩) ইওরােপীয় অন্য কোনাে ভাষা অপেক্ষা সংস্কৃত ভাষাতে মূল আর্যভাষার অধিক শব্দ সমষ্টি পাওয়া যায়। (৪) আর্যরা যে বহিরাগত তার সুনিশ্চিত কোন প্রমাণ নেই। ভারতে আর্যদের আদি বাসস্থান এই তত্ত্বের সমালােচনা করে অনেকে বলেন।(১) বিশ্বের অন্যত্র আর্যরা ছড়িয়ে পড়ার আগে সমগ্র ভারতে আর্যরা প্রভাব বিস্তার করেনি কেন? (২) ভারত আর্যদের আদিবাসভূমি হলে ভারতে অনার্য ভাষা কিভাবে প্রচলিত ছিল ? (৩) আর্য সভ্যতার পূর্বে হরপ্পা সভ্যতা ছিল উন্নত নগর সভ্যতা। কিন্তু আর্যদের ভারতে আদি বাসভূমি হলে কি করে আর্যসভ্যতায় গ্রামীণ সভ্যতা থেকে যায় ? Home
বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন
অধিকাংশ ঐতিহাসিক মনে করেন আর্যদের আদি বাসভূমি ভারতের বাইরে। কিছু ঐতিহাসিক মনে করেন বেদে উল্লেখিত গাছপালা ও পশুর সঙ্গেইওরােপের গাছপালা ও পশুর সাদৃশ্য থাকায় ইওরােপ ছিল আর্যদের আদি বাসভূমি। কেউ বলেন আর্যদের আদি বাসস্থান ছিল কাস্পিয়ান সাগর ও মধ্য এশিয়ার স্তেপ অঞ্চলে। কিছু গবেষক মনে করেন আর্যদের আদি বাসস্থান রাশিয়ার উরাল পর্বত অঞ্চলে। এইসব পণ্ডিতদের মতে ভারতের বাইরে আদি বাসভূমি থেকে আর্যদের একটি শাখা ইরাণে ও অপর শাখা ২০০০ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ভারতে সপ্তসিন্ধু অঞ্চলে বসতি স্থাপন করে।
বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যঃ
আর্যদের প্রাচীনতম সাহিত্য ঋকবেদ থেকে আর্যদের বসতি বিস্তার, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় জীবন সম্বন্ধে জানা যায়। ঋকবেদে উল্লিখিত সপ্তসিন্ধু অর্থাৎ পাঞ্জাবের পাঁচটি নদী – বিপাশা, ইরাবতী, চন্দ্রভাগা, বিতস্তা, শতদ্রু এবং সিন্ধু ও সরস্বতী নদনদী উপত্যকায় আর্যরা বসতি স্থাপন করার পর উত্তর ও পূর্ব ভারতে বৈদিক সভ্যতার বিস্তার হয়েছিল। বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্যগুলি ভারতীয় জীবনধারায় প্রভাব বিস্তার করেছে। এই সভ্যতার উল্লেখযােগ্য বৈশিষ্ট্যগুলি হলাে বৈদিক সাহিত্য, সামাজিক জীবন, রাজনৈতিক জীবন, অর্থনৈতিক জীবন ও ধর্মীয় জীবন।
বৈদিক যুগ: বৈদিক সাহিত্য :
বেদের অর্থ ঃ বেদ ও বেদাঙ্গ নিয়ে বৈদিক সাহিত্য গঠিত। আর্যদের সাহিত্য-সম্ভার হল বেদ। বেদ শব্দের অর্থ হল জ্ঞান। ঋক্, সাম, যজুঃ ও অথর্ব- এই চারটি বেদের মধ্যে ঋক্ বেদ প্রাচীনতম। অন্য তিনটি বেদ পরে রচিত হয়েছিল। হিন্দুরা বিশ্বাস করে বেদ অপৌরুষেয় অর্থাৎ ঈশ্বরের মুখনিঃসৃত বাণী। এই বাণী গুরুর মুখে শুনে শিষ্যরা মুখস্থ করতেন। বংশ পরম্পরায় মুখে মুখে প্রচলিত ছিল। এইজন্য বেদকে শুতি বলা হত। প্রথমে বেদ অলিখিত ছিল পরে লিখিত হয়।
চতুর্বেদ : প্রাচীনতম ঋকবেদের বিষয়বস্তু ছিল দেবদেবীর স্তুতি। সামবেদের স্তোত্রগুলি গানের মত সুরযুক্ত ছিল। যজু বেদে যাগ-যজ্ঞ, মন্ত্রতন্ত্রের কথা আছে। অথর্ববেদে সৃষ্টিরহস্য, চিকিৎসা পদ্ধতি, বশীকরণ প্রভৃতি রয়েছে। প্রত্যেক বেদে ৪টি ভাগ আছে। ব্রাত্মণ, সংহিতা, আরণ্যক ও উপনিষদ। সংহিতা ভাগটি পদ্যে রচিত। এতে রয়েছে দেবতাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য স্তুতি, প্রার্থনা, গাথা। ব্রাক্ষ্মণ ভাগ গদ্যে রচিত। এতে যাগযজ্ঞ ও ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের বর্ণনা রয়েছে। আরণ্যক ভাগে বানপথে জীবনযাপন ও ধর্ম আচরণের বিষয়ে বর্ণনা রয়েছে। বেদের শেষ ভাগ হল উপনিষদ। এটি বেদান্ত নামে পরিচিত। উপনিষদে গভীর দার্শনিক তত্ত্ব আলােচিত হয়েছে। বৈদিক সাহিত্য যখন বিশাল ও জটিল আকার ধারণ করে তখন বেদের মূলতত্ত্বকে সংক্ষেপে ও সরলভাবে বােঝার জন্য সুত্র-সাহিত্য রচিত হয়। সূত্র-সাহিত্য ছটি বেদাঙ্গ ও ছটি দর্শনে বিভক্ত। বেদাঙ্গগুলি হল শিক্ষা, ছন্দ, ব্যাকরণ, নিরুক্ত, জ্যোতিষ ও কল্প।
বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের সামাজিক জীবনঃ
পরিবার : ঋক বৈদিক যুগে আর্যসভ্যতা ছিল গ্রাম কেন্দ্রিক। সমাজের ভিত্তি ছিল পরিবার। পরিবার ছিল পিতৃতান্ত্রিক। পিতা ছিলেন পরিবারের কর্তা। পরিবারকে বলা হত কুল। পরিবারের প্রধান বা বয়ােজ্যেষ্ঠ পুরুষকে গৃহপতি বা কুলপ বলা হত। যৌথ পরিবার প্রচলিত ছিল।
বৈদিক যুগের নারীর মর্যাদা :
সমাজে নারীরা মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত ছিল। তারা পুরুষের সহকর্মিণী ও সহধর্মিণী হতেন। গৃহস্থালীর ব্যাপারে নারীরা সর্বময় কত্রী ছিল। পুত্র সন্তান হলে কাম্য কন্যা সন্তান অবহেলিত হত না। নারীরা পতি নির্বাচন করতে পারত এবং পুরুষের সমান শিক্ষা সুযোেগ পেত। ঘােষা, অপালা, মমতা, বিশ্ববারা, লােপামুদ্রা প্রভৃতি নারী বৈদিক যুগে উচ্চতর শিক্ষার কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। নারীরা বৈদিক মন্ত্র রচনা করতেন, সভা সমিতিতে, অধ্যাপনা, নৃত্যগীতে অংশ গ্রহণ করতেন। বেদপাঠ ও উপনয়নে নারীরা অধিকারিণী ছিলেন। বিবাহিতা নারী যাগযজ্ঞে অংশ নিতেন। সতীদাহ প্রথা ও বাল্যবিবাহ প্রচলিত ছিল না।
বৈদিক যুগ: বর্ণপ্রথা :
ঋক্ বৈদিক যুগে বর্ণভেদ প্রথা ছিল। আর্যরা ছিল গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা ও দীর্ঘকায় আর অনার্যরা ছিল কৃষ্মবর্ণ খর্বাকৃতি। অনার্যদের পরাজিত করে আর্যরা তাদের দাস বা দস্যু নামে অভিহিত করত। কর্ম ও গুণ অনুসারে সমাজে ব্রাত্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র – এই চারটি বর্ণের আবির্ভাব হয়। ব্রাত্মণরা ঈশ্বর উপাসনা, বিদ্যাচর্চা ও অধ্যাপনা করতেন। যারা রাজকার্য, রাজ্যশাসন, যুদ্ধ বিগ্রহ করত তাদের ক্ষত্রিয় বলা হত। কৃষিকার্য, ব্যবসা-বাণিজ্যে রত ব্যক্তিগণ বৈশ্য নামে পরিচিত ছিলেন। অনার্যরা শূদ্র নামে পরিচিত হল। এরা উচ্চ তিন বর্ণের সেবা করত। বিভিন্ন বর্ণের মধ্যে মেলামেশা, ভােজন ও বিবাহ নিষিদ্ধ ছিল না।
চতুরাশ্রম:
আর্যদের সামাজিক জীবনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল চতুরাশ্রম। ব্রাত্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এই তিন বর্ণের জীবন প্রবাহ চতুরাশ্রম দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত। প্রথম জীবনে গুরু গৃহে বিদ্যার্জনে শিক্ষা লাভের সময় কালকে ব্ৰত্মচর্যাশ্রম বলা হত। গুরুগৃহ থেকে শিক্ষালাভের পর বিবাহ ও সংসার ধর্ম পালনের সময়কে গার্হস্থ্য জীবন বলা হত। প্রৌঢ় বয়সে সংসার ত্যাগ করে অরণ্যে গিয়ে ঈশ্বর সাধনা ও ধর্মকর্ম পালন করাকে বানপ্রস্থ বলা হত। সবশেষে সাংসারিক বন্ধন ত্যাগ করে সন্ন্যাসীর ন্যায় তপস্যা করে জীবন যাপন করাকে সন্ন্যাস বলা হত।
বৈদিক যুগ: পােষাক, খাদ্য, বিনােদন:
ঋকবৈদিক যুগে সূতি ও পশমের বস্ত্র ব্যবহৃত হত। পুরুষরা ঊর্ধ্বাঙ্গে ও নিম্নাঙ্গে দুটি পৃথক বস্ত্র পরিধান করত। নারীরা নিম্নাঙ্গে নিবি নামক অন্তর্বাস পরত। নারী পুরুষ উভয়ই অলংকার ব্যবহার করত। খাদ্য হিসাবে গম, যব, চাল, বার্লি, শাক সবজি, দুধ, মাছ, মাংস খেত ও সােমরস পান করত। নৃত্যগীত, পাশাখেলা, শিকার, দ্বন্দ্বযুদ্ধ রথদৌড় প্রভৃতি ছিল। বিনােদনের উপায়।
বৈদিক যুগ: বৈদিক যুগের অর্থনৈতিক জীবনঃ
কৃষি ও পশুপালন ঃ
বৈদিক যুগে মানুষের জীবন ছিল গ্রামকেন্দ্রিক। কৃষি ছিল তাদের প্রধান বৃত্তি। এই যুগে প্রথমে আর্যরা যব এবং পরে অনার্যদের সংস্পর্শে গম ও ধান চাষ করতে শুরু করে। পশুপালনও ছিল আর্যদের অন্যতম উপজীবিকা। গােধন ছিল তাদের সম্পদ। গােসম্পদ দখলের জন্য তারা যুদ্ধ করত। এই যুদ্ধকে বলা হত গাভিষ্টি। ঋকবেদে গােরুকে বলা হয় অ অর্থাৎ যাকে হত্যা করা যায় না। গােরুকে বিনিময় মাধ্যম হিসাবেও ব্যবহার করা হত। যুদ্ধে ঘােড়ার প্রয়ােজন হত বলে ঘােড়ার মর্যাদা গােরুর সমান ছিল। পশমের জন্য ভেড়ার গুরুত্বপূর্ণ স্থান ছিল।
পেশা ও শিল্প ঃ
এই যুগে বিভিন্ন শ্রেণির পেশার কথা ঋকবেদে উল্লেখ আছে। তাঁতী, চর্মশিল্পীতক্ষণ (ছুতাের), মৃৎশিল্পী, ধাতুশিল্পী প্রভৃতি পেশায় নিযুক্ত মানুষ কুটির শিল্পের মাধ্যমে পণ্য উৎপাদন করত। ধাতু শিল্পীরা তামা ব্রোঞ্জের দ্রব্য নির্মাণ করত। ঋকবৈদিক যুগে লােহার প্রচলন ছিল না ছুতাের শিল্পীদের সমাদর ছিল। ছুতাের শিল্পীরা তারা রথ, নৌকা কৃষির সরঞ্জাম তৈরি করত।
ব্যবসা-বাণিজ্য ঃ
এই যুগে পণ্য উৎপাদনের ও প্রসারের ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্মে= হয়। যারা ব্যবসা বাণিজ্যে যুক্ত ছিল তারা ছিল বৈশ্যশ্রেণির অন্তর্ভুক্ত। দেশের অভ্যন্তরে নদী= তীরে নতুন নতুন বাণিজ্য কেন্দ্র গড়ে ওঠে। বণিকরা বৈদেশিক বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল প্রথমে বিনিম প্রথার মাধ্যমে বাণিজ্য হত। পরবর্তীকালে নিষ্ক ও মনা নামে স্বর্ণমুদ্রা ব্যবহৃত হত।
যােগাযােগ:
যােগাযােগ ব্যবস্থায় ঘােড়ায় টানা রথ, যাঁড়ে টানা দুচাকা ও চার চাকা বিশিষ্ট গাড়ি এবং নৌকা ব্যবহৃত হত। ঋকবেদে শত অনিত্ৰ নামে শত দাঁড় বিশিষ্ট নৌকার উল্লেখ আছে।
রাজস্ব :
রাজস্ব হিসাবে রাজা নিয়মিত কর আদায় করতেন না। রাজা দান এবং যুদ্ধে লুষ্ঠিত সম্পদের অংশ পেতেন। বাণিজ্য সম্পদের থেকে ‘শুল্ক’ হিসাবে কর এবং উৎপন্ন ফসলের থেকে “ভাগ” নামে রাজস্ব আদায় করা হত। বলি’ নামে বাধ্যতামূলক দান আদায় হতাে।
বৈদিক যুগের রাজনৈতিক জীবন :-
আর্যরা ভারতে প্রবেশকালে নানা দল, উপদল ও গােষ্ঠীতে বিভক্ত ছিল। এই সব গােষ্ঠীর মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লেগে থাকত। অনার্যদের সঙ্গে সর্বদা আর্যরা যুদ্ধে লিপ্ত থাকত। ধীরে ধীরে আর্যরা উত্তরভারতে বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে।
গ্রাম-বিশ-জনঃ
ঋক্ বৈদিক যুগে সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি ছিল পরিবার। কয়েকটি পরিবার নিয়ে হত গ্রাম। গ্রামের প্রধান ছিলেন গ্রামণী। কয়েকটি গ্রাম নিয়ে গঠিত হত বিশ। “বিশ”-এর প্রধানকে বিশপতি বলা হত। “জন” বা জনপদ ছিল বিশের থেকে বড় শাসনতান্ত্রিক স্তর। জনের প্রধানকে গােপ বলা হয়। জন ছিল রাষ্ট্রের সমকক্ষ। এই রাষ্ট্রের অধিকর্তাকে রাজন্ বলা হত। আর্যরা ভারতে স্থায়িভাবে বসবাসের আগে তাদের এক একটি গােষ্ঠীর নির্বাচিত দলপতি ছিল। স্থায়িভাবে বসবাস করার পর দলপতির ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত। রাজপদ বংশানুক্রমিক হলেও কোথাও কোথাও নির্বাচিত রাজপদের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। নির্বাচিত রাজ্যকে গণরাজ্য ও রাজাকে গণপতি বা জ্যেষ্ঠ বলা হত।
রাজার ক্ষমতা, মর্যাদা ও কর্তব্য :-
ঋক বৈদিক যুগে জাঁকজমকপূর্ণ পােশাক, বাসস্থান ও ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা রাজার ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। রাজার প্রধান কর্তব্য ছিল। প্রজাদের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষা করা। গােধন রক্ষা করার জন্য রাজাকে গােপতি ও ভূমি রক্ষার জন্য রাজাকে ভূপতি বলা হত। শান্তি শৃংখলা বজায় রাখার দায়িত্ব রাজা পালন করতেন। বহিরাক্রমণ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করতেন রাজা। বিচার ও শাস্তি প্রদান ছিল রাজার কর্তব্য।
” সভা সমিতি ও অন্যান্য রাজকর্মচারী:
রাজা সর্বশক্তিমান হলেও স্বৈরাচারী ছিলেন না। শাসন কার্যে রাজা সভা ও সমিতির পরামর্শ গ্রহণ করতেন। বয়ােজ্যেষ্ঠ ও জ্ঞানবৃদ্ধদের নিয়ে গঠিত হত সভা এবং জনসাধারণ নিয়ে গঠিত হত সমিতি। এই দুটি প্রতিষ্ঠান রাজাকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। রাজার দায়িত্ব পালনে নানা কর্মচারী সাহায্য করতেন। ধর্মীয় অনুশাসনের দ্বারা পুরােহিতরা রাজাকে নিয়ন্ত্রিত করতেন এবং ধর্ম কার্য ও যাগযজ্ঞ করতেন। সেনাপতির উপর অভ্যন্তরীণ শান্তিরক্ষা ও বহিরাক্রমণ প্রতিরােধের দায়িত্ব থাকত। সেনাবাহিনী গঠিত হত পদাতিক, অশ্বারােহী ও রথসৈন্য নিয়ে। এছাড়া গ্রামণী, দূত, গুপ্তচর প্রভৃতি কর্মচারি শাসনকার্যে রাজাকে সাহায্য করতেন। উগ্র নামে কর্মচারি পুলিশের কাজ করত। বিবাদের মীমাংসা করতেন মধ্যমসি এবং গ্রামের বিচারকার্য করতেন গ্রাম্যবাদিন। যুদ্ধের অস্ত্র ছিল তির-ধনুক, বর্শা, তরবারি, কুঠার, বর্ম, শিরস্ত্রাণ ও মুষল। রাজা তার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনের জন্য প্রজাদের কাছ থেকে পেতেন আনুগত্ ও কর।
বৈদিক যুগ বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য
ধর্মীয় জীবনঃ
আর্যরা নানা প্রাকৃতিকশক্তিকে উপাসনা বা পূজা করত। যে সকল প্রাকৃতিক দৃশ্য বা শক্তি মনে ভীতি, বিস্ময় ও শ্রদ্ধার উদ্রেক করতাে সেগুলি আর্যদের উপাসনার বস্তু ছিল যেমন- সূর্য, চন্দ্র, বৃষ্টি, অগ্নি প্রভৃতি। এছাড়াও বিশ্বকর্মা, প্রজাপতি প্রভৃতি দেবতার পূজাও প্রচলিত ছিল। ইন্দ্র বৃষ্টি ও বজ্রের, বরুণ জলের, দৌঃ আকাশের, অগ্নি ও সূর্য দেবতা রুপে পৃজিত হত। এই দেবতাদের তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে ঋকবেদে স্তোত্র রচিত হয়েছিল। ইন্দ্রকে পুরন্দর বা দুর্গ ধ্বংসকারী বলা হত। ইন্দ্রের পরে স্থান ছিল অগ্নির। যজ্ঞের অগ্নিতে আহুতি দেওয়া হত। এছাড়া ‘সােম’(বৃক্ষের দেবতা), পাৰ্জন্য (বৃষ্টির দেবতা), যম (মৃত্যুর দেবতা), বায়ু (বাতাসের দেবতা) প্রভৃতি দেবতাদের উপাসনা করা হত। দেবীরা হলেন অদিতি, উষা, সাবিত্রী ও সরস্বতী। আর্যরা প্রথমে মূর্তিপূজা করত না। পরবর্তীকালে আর্য অনার্য সংমিশ্রণে মূর্তি পূজা প্রচলিত হয়। যজ্ঞে দেবতার উদ্দেশ্যে ঘি, দুধ, যব, মধু প্রভৃতি আহূতি দেওয়া হত। ব্রাহ্মণরা ছিল পুরােহিত শ্রেণি। তারা ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠানের মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। আর্যরা স্তব, স্তুতি, আহূতি প্রভৃতির মাধ্যমে দেবতাদের তুষ্ট করত। সেই যুগে মানুষ দেবতার কাছে পুত্র, খাদ্য, পশু, সম্পদ এবং জাগতিক উন্নতি কামনা করত।
||হরপ্পা সভ্যতার সঙ্গে বৈদিক সভ্যতার তুলনামূলক সম্পর্ক ||
বৈসাদৃশ্য ঃ
হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে নানা বিষয়ে পার্থক্য রয়েছে। প্রথমত হরপ্পা সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক সভ্যতা, অপরদিকে বৈদিক সভ্যতা ছিল গ্রামীণ সভ্যতা। দ্বিতীয়ত হরপ্পা সভ্যতায় পাকা রাস্তাঘাট ও পােড়ামাটির তৈরি বহুতল গৃহে অধিবাসীরা বাস করত। আর্যরা বাঁশ, কাঠ ও খড়ের তৈরি গৃহে বাস করত। তৃতীয়ত হরপ্পা সভ্যতায় ঘােড়ার অস্তিত্ব ছিলনা, কিন্তু বৈদিক সভ্যতায় ঘােড়া ব্যবহৃত হত। চতুর্থত হরপ্পা সভ্যতায় মুর্তি পূজা, বৃক্ষের পূজা, শিব ও মাতৃদেবীর পূজা হত। বৈদিক সভ্যতায় পুরুষ দেবতা পূজার প্রাধান্য ছিল; গাভীর পূজা হত। মুর্তির পূজা হত না। ইন্দ্র, অগ্নি, বরুণ প্রভৃতি প্রাকৃতিক দেবতার উপাসনা হত। পঞমত বৈদিক সভ্যতার অর্থনীতি ছিল কৃষি ভিত্তিক ও পশুপালন। হরপ্পার অর্থনীতি শিল্প-বাণিজ্য ভিত্তিক ছিল। ষষ্ঠত হরপ্পা সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক, কিন্তু বৈদিক সভ্যতা ছিল পিতৃতান্ত্রিক। সপ্তমত আর্যরা মৃতদেহ দাহ করত। হরপ্পাবাসীরা মৃতদেহ কবর দিত। অষ্টমত আর্যরা যুদ্ধে আত্মরক্ষা মূলক অস্ত্ররূপে ঢাল ও শিরস্ত্রাণ ব্যবহার করত। হরপ্পায় এই অস্ত্রের ব্যবহার ছিল না। নবমত হরপ্পা সভ্যতায় রাজার কোন অস্তিত্ব ছিল না। বৈদিক সভ্যতায় রাজ’-এর উল্লেখ রয়েছে।
সাদৃশ্য:
হরপ্পা সভ্যতা ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য থাকলেও কিছু ক্ষেত্রে সাদৃশ্য রয়েছে। হরপ্পা ও বৈদিক যুগে মানুষ বৃক্ষ, আগুন, জল, সূর্য প্রভৃতি প্রাকৃতিক বস্তুকে উপাসনা করত। এই উভয় সভ্যতার অধিবাসীরা ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল এবং পােশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার ব্যবহারে সাদৃশ্য দেখা যায়। উভয় সভ্যতায় তা-ব্রোঞ্জের সরঞ্জাম ব্যবহৃত হত। ভারতীয় সভ্যতা বিকাশে উভয় সভ্যতার সাংস্কৃতিক অবদান ছিল।
| বৈদিক সভ্যতার বিবর্তন ঃ |
ঋক বৈদিক যুগের পরবর্তীকালে ৬০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত আর্যদের সমাজ, অর্থনীতি, ধর্ম ও রাজনীতির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হয়। এই পরিবর্তন হঠাৎ হয়নি। ক্রমশ বিবর্তনের মধ্য দিয়ে পরিবর্তন দেখা দিয়েছিল। বৈদিক সাহিত্য থেকে পরবর্তী বৈদিক যুগের পরিবর্তনের চিত্র পাওয়া যায়।
সামাজিক ক্ষেত্রে বিবর্তনঃ
বর্ণপ্রথা পরবর্তী বৈদিক যুগে বর্ণ-প্রথা পেশা ভিত্তিক থেকে জন্মভিত্তিক বা বংশানুক্রমিক হয়। বর্ণপ্রথা কঠোর হয়। এই সময় সমাজ ব্রাত্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শূদ্র চারটি বর্ণ বা জাতিতে বিভক্ত হয়ে যায়। ব্রাত্মণরা ছিল বর্ণ শ্রেষ্ঠ। ব্রাত্মণ ও ক্ষত্রিয়ের ক্ষমতা ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। বৈশ্য ও শূদ্রের মর্যাদা হ্রাস পায়। শূদ্রদের কোনাে অধিকার ছিল না। তারা ছিল অপবিত্র। ব্রাত্মণ ও ক্ষত্রিয়দে সঙ্গেবৈশ্য ও শূদ্রদের দুরত্ব বাড়তে থাকে। ক্ষত্রিয়রা, ব্রাত্মণদের শ্রেষ্ঠত্বের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা শুন করে। এই সময় চারবর্ণ ছাড়া কর্মকার, সূত্রধর, মৎস্যজীবী, চর্মকার প্রভৃতি উপবর্ণের উদ্ভব হয়।
বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা :
এই যুগে নারীর মর্যাদা হাস পায়। নারীদের ধর্মীয় ও রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। পুরুষদের মধ্যে বহু বিবাহের ব্যাপক প্রচলন হয়। মেয়েরা রাজনৈতিক কাজে অংশ গ্রহণ করতে পারত না, কিন্তু, ঋগ্বেদের যুগে সভাসমিতিতে যােগ দিত। বাল্য বিবাহ পণপ্রথা প্রভৃতি এই যুগে দেখা যায়। তবে নারীরা উচ্চশিক্ষা, অধ্যাপনা ও ধর্মচর্চা করতে পারতেন। এই সময় গার্গী, মৈত্রেয়ী প্রভৃতি বিদুষী নারীর উল্লেখ পাওয়া যায়।
পরবর্তী বৈদিক যুগে চতুরাশ্রম প্রথায় শৈথিল্য দেখা যায়। পােশাক পরিচ্ছদে সূতি ও পশমের সঙ্গে রেশম বস্ত্র ব্যবহৃত হত। আয়না ও চিরুনির ব্যবহার শুরু হয়।
রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিবর্তনঃ
রাজ্য বিস্তার ও রাজশক্তি বৃদ্ধি :
আর্যরা ভারতের উত্তর ও পূর্বদিকে আধিপত্য বিস্তার করলে পূর্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের স্থলে বৃহৎ রাজ্যের উৎপত্তি হয় এবং কাশী, কোশল, কুরু, পাাল, বিদেহ প্রভৃতি নতুন রাজ্যের উদ্ভব ঘটে। বৃহৎ রাজ্যের রাজারা সাম্রাজ্য বিস্তার করতেন। তারা রাজসূয় ও অশ্বমেধ যজ্ঞের মাধ্যমে ক্ষুদ্র রাজ্যের আনুগত্য গ্রহণ করে সম্রাট, একরাট, বিরাট প্রভৃতি উপাধি ধারণ করতেন। রাজাদের শক্তি ও মর্যাদা বৃদ্ধি পায়। রাজা ব্রাক্ষ্মণ ছাড়া আর কাউকেই আমল দিতেন না এবং নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধিরূপে প্রতিষ্ঠা করেন। সভা সমিতির গুরুত্ব এই সময় হ্রাস পায়।
রাজকর্মচারী :
পরবর্তী বৈদিক যুগে রাজ্যের আয়তন বৃদ্ধি পাওয়ায় শাসন কার্যের প্রয়ােজনে নতুন নতুন রাজকর্মচারীর পদ সৃষ্টি হয়। “থপতি” – সীমান্ত রক্ষা করতেন, কর আদায়কারী ছিল। “ভাগদুখ”, “ক্ষত্ৰী” ছিল রাজ সংসারের তত্ত্বাবধায়ক, একশত গ্রামের ভারপ্রাপ্ত ছিল “শতপতি”। বলি ও শুল্ক নামে দুই ধরনের কর সংগ্রহিত্রী ও ভাগদুখেরা আদায় করত। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। অধ্যক্ষ নামে কর্মচারী বিচার কার্য পরিচালনা করতেন। গ্রাম্যবাদিন গ্রামের বিচারক ছিলেন।
অর্থনেতিক বিবর্তন:
কৃষিকাজ
ঋক বৈদিক যুগে অর্থনীতির ভিত্তি ছিল কৃষি ও পশুপালন। পরবর্তী বৈদিক যুগে লােহার প্রচলন হওয়ায় উন্নত যন্ত্রপাতির দ্বারা কৃষির উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। ফলে কৃষি প্রাধান্য লাভ করে। কৃষির সমাদর ছিল। কৃষি জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানার উদ্ভব হয়। বিভিন্ন ধরনের শাকসজি উৎপাদন হত। যবের সঙ্গে ধান চাষ প্রাধান্য পায়। পশুপালনের গুরুত্বও বৃদ্ধি পায়। গাে হত্যা নিন্দনীয় ছিল।
বিভিন্ন বৃত্তি :
এই যুগে বংশানুক্রমিক বিভিন্ন পেশায় মানুষ নিযুক্ত ছিল। ধাতুশিল্পে তাম্রব্রোঞ্জের সঙ্গে লােহা, টিন, সীসা প্রভৃতি ধাতুর পণ্য উৎপাদন হত। চর্মশিল্প ও দারু শিল্প গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ব্যবসা বাণিজ্য প্রসারিত হয়। বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে বহু নগরের উদ্ভব ঘটে। মনা ও নিষ্ক নামে স্বর্ণমুদ্রা বিনিময় মাধ্যম ছিল।
বৈদিক যুগ বৈদিক যুগের সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন বৈদিক যুগে নারীর মর্যাদা বৈদিক সভ্যতার বৈশিষ্ট্য:
বৈদিক যুগে ধমীয় বিবর্তনঃ
ধর্মীয় ক্ষেত্রে পরবর্তী বৈদিক যুগে পরিবর্তন সাধিত হয়। এই যুগে ভৌগােলিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার সম্প্রসারণের সঙ্গে বৈদিক সাহিত্যে ধর্মীয় ও দার্শনিক তত্ত্বের প্রসার ঘটে। এই যুগে ধর্মীয় জটিলতা বৃদ্ধি পায় ও আচার সর্বস্ব ধর্মীয় অনুষ্ঠান হতে থাকে। পুরােহিতদের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। এই সময় অগ্নি ও ইন্দ্রের গুরুত্ব হ্রাস পায়। প্রজাপতি, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতা প্রধান দেবতা হিসাবে স্থান পায়। অনার্যদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে আর্যরা মাতৃপূজা ও বলিদান প্রথা চালু করে। পরবর্তী বৈদিক যুগকে ব্রাত্মণ্য যুগও বলা হয়।