ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর
ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর
প্রশ্ন । ভারত-ছাড় আন্দোলন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও। ইহার গুরুত্ব উল্লেখ কর।
অথবা, ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের ইতিহাসে ভারত-ছাড় আন্দোলনের ভূমিকা বিশ্লেষণ কর।
অথবা, ভারত-ছাড় আন্দোলনের প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলি বিশ্লেষণ কর।
উত্তর।
ভারত ছাড় আন্দোলন: ভারতের স্বাধীনতা-সংগ্রামের অন্তিম পর্যায়ের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ আন্দোলন ছিল ভারত-ছাড় বা আগস্ট আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত আঘাত হানিবার জন্য এই সর্বাত্মক, গণ-আন্দোলনের সূচনা হয়।
ভারত ছাড় আন্দোলন: জাপানের সামরিক অগ্রগতি
পটভূমিকা—জাপান মিত্রপক্ষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগদান করিলে এশিয়ায় মিত্রপক্ষের সামরিক বিপর্যয় দেখা যায়। সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ও ব্রহ্মদেশে জাপান অব্যাহত গতিতে অগ্রসর হয়। এমন কি ভারতের আক্রমণের সম্ভাবনাও লক্ষ্য করা যায়। এই পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের পূর্ণ সহযোগিতা লাভের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকার স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রীপকে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের মার্চ মাসে প্রেরণ করেন।
কিন্তু ভারতের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য ক্রীপসের প্রস্তাব কংগ্রেসের নিকট গ্রহণযোগ্য হইল না এবং কংগ্রেস তাহা প্রত্যাখ্যান করিল। ক্রীপস্ প্রস্তাব সম্পর্কে গান্ধীজী বলিয়াছিলেন, ক্রীপস্ মিশনের ব্যর্থতা “It is a postdated cheque on a cashing bank.” ক্রীপস মিশনের ব্যর্থতার ফলে ভারতের সর্বত্র এক চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হইল। পরিষ্কার বোঝা গেল যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাহার অতি দুর্দিনেও ভারতবাসীর হস্তে ক্ষমতা ছাড়িতে রাজী নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে কংগ্রেস ব্যাপক গণ-আন্দোলনের পথ গ্রহণ করিতে বাধ্য হইল।
‘ভারত-ছাড়’ প্রস্তাব—
কংগ্রেসের নেতৃবৃন্দ বুঝিতে পারিলেন যে সম্ভাব্য জাপানী আক্রমণ প্রতিহত করিতে হইলে ভারতীয়দের হস্তে ক্ষমতা হস্তান্তর করা একান্ত প্রয়োজন। গান্ধীজী ‘হরিজন’ পত্রিকায় ব্রিটিশ সরকারকে অবিলম্বে ভারত ত্যাগ করিতে পরামর্শ দিলেন। ইহার পর ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ১৪ই জুলাই কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি ঐতিহাসিক ‘ভারত-ছাড়’ প্রস্তাব গ্রহণ করিল।
এই প্রস্তাবে বলা হয় যে শুধুমাত্র ভারতবর্ষের স্বার্থেও নহে, নাৎসীবাদ, ফ্যাসীবাদ প্রভৃতি সর্বপ্রকার সাম্রাজ্যবাদ ও জঙ্গী কর্মতৎপরতার অবসানের জন্য ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসনের অবিলম্বে অবসান হওয়া প্রয়োজন। ব্রিটিশ সরকার কংগ্রেসের দাবি অগ্রাহ্য করিলে কংগ্রেস গান্ধীজীর নেতৃত্বে সর্বশক্তি নিয়োগ করিয়া সমগ্র ভারতবর্ষে এক ব্যাপক আন্দোলন শুরু করে। ‘ভারত-ছাড়’ প্রস্তাব সম্বন্ধে ব্রিটিশ সরকার অনমনীয় কঠোর মনোভাব গ্রহণ করে।
অবশেষে ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ৮ই আগস্ট নিখিল ভারত কংগ্রেস সমিতি ‘ভারত-ছাড়’ প্রস্তাব গ্রহণ করিল। এই প্রস্তাবে বলা হয় “The immediate ending of British rule in India is an urgent necessity, both for the sake of India and for the success of the cause of the united nations.” কংগ্রেস গান্ধীজীকে নেতৃত্ব গ্রহণ করিয়া ব্যাপক অহিংস গণ-সংগ্রাম পরিচালনা করিতে অনুরোধ করিল। গান্ধীজী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে এই মন্ত্র ঘোষণা করেন, ‘করেঙ্গে ইয়ে মরেঙ্গে’—করিব না হয় মরিব
সরকারী দমননীতি:
কিন্তু কংগ্রেস কর্তৃক আন্দোলনের প্রস্তাব ঘোষিত হইবার সঙ্গে সঙ্গেই ৯ই আগস্ট গান্ধীজী ও কংগ্রেসের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হইল। কংগ্রেস বে-আইনী সংগঠনরূপে ঘোষিত হইল। নেতাদের গ্রেপ্তারের সংবাদ সারা ভারতে ছড়াইয়া পড়িবার সঙ্গে সঙ্গে চতুর্দিকে ঐতিহাসিক ‘ভারত-ছাড়’ বা আগস্ট আন্দোলন শুরু হইল।
জনগণ নেতৃত্বহীন হইয়া পড়িলেও সর্বত্র হরতাল পালিত হইল ও সভাসমিতির মাধ্যমে বিক্ষোভ জানাইতে লাগিল। এই পরিস্থিতিতে সরকার কঠোর হস্তে আন্দোলন দমনে উদ্যোগী হইলেন। ১৪৪ ধারা জারি করিয়া সভা-সমিতি নিষিদ্ধ করা হইল এবং ব্যাপক দমন-নীতি অনুসরণ করিলেন।
শীঘ্রই আন্দোলন ব্যাপক আকার ধারণ করিল এবং ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষত বাঙলা, বিহার, উত্তরপ্রদেশ, উড়িষ্যায় গণ-বিক্ষোভ দেখা দিল। কোথাও সুসংবদ্ধভাবে এবং কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে আন্দোলন চলিতে লাগিল। এই আন্দোলনে কংগ্রেসের প্রত্যক্ষ সংস্রব না থাকিলেও জয়প্রকাশ নারায়ণ, রামমনোহর লোহিয়া, অচ্যুত পটবর্ধন প্রমুখ সমাজতান্ত্রিক নেতারা সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন।
আগস্ট আন্দোলনে জয় প্রকাশ নারায়ণের ভূমিকা ছিল খুবই গৌরবজনক, তিনি একটি কেন্দ্রীয় সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন এবং এক বৈপ্লবিক কর্মসূচী গ্রহণ করেন। দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তাঁহার উদ্যোগে গোপন কেন্দ্র গড়িয়া উঠে। ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের নভেম্বরে তিনি হাজারীবাগ জেল হইতে পলায়ন করিয়া নেপালে চলিয়া যান এবং সেখানে ‘আজাদ দস্তা’ বা গেরিলা বাহিনী গঠন করিতে প্রয়াসী হইলেন।
বেশ কিছুদিন গোপন সংগ্রাম পরিচালনার পর ১৯৪৩ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বরে তিনি পুনরায় কারারুদ্ধ হন। আন্দোলন কোথাও কোথাও সহিংস হইয়া উঠিল। (টেলিগ্রাফের তার কাটিয়া, রেলের লাইন অপসারণ করিয়া ও ডাকঘর পোড়াইয়া আন্দোলনকারীগণ সরকারের যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করার চেষ্টা করিল।
সরকারী অফিস ও আদালতে ব্রিটিশ পতাকার পরিবর্তে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের চেষ্টা করিয়া বোম্বাই, কটক, পাটনা, কলিকাতা প্রভৃতি শহরে বহু স্বেচ্ছাসেবক পুলিসের গুলিতে নিহত হইল?) বিহার, উত্তরপ্রদেশে গণ-বিক্ষোভ শহর ছাড়িয়া গ্রামাঞ্চলে ব্যাপক আকার ধারণ করিল। সরকারী সম্পত্তি ও যোগাযোগ ব্যবস্থা ধ্বংস করাই ছিল বিক্ষোভকারীদের লক্ষ্য।
এই গণ-বিক্ষোভে বাংলার মেদিনীপুর জেলার তমলুক ও কাঁথি মহকুমার জনগণ এক অভূতপূর্ব বীরত্বের পরিচয় দিয়াছিলেন। মাতঙ্গিনী হাজরা ও রামচন্দ্র বেরার নাম এই প্রসঙ্গে উল্লেখযোগ্য। বৃদ্ধা মাতঙ্গিনী হাজরা জাতীয় পতাকা হস্তে জনতাকে নেতৃত্ব দিবার সময় গুলিবিদ্ধ হইয়াও জাতীয় পতাকা ত্যাগ করেন নাই।
তমলুকে জাতীয় সরকার স্থাপন:
বিশেষত তমলুক মহকুমার তমলুক, মহিষাদল, সুতাহাটায় সরকারের যাবতীয় সম্পত্তি ধ্বংস করা হয় এবং তথায় একজাতীয় সরকার গঠন করা হয়। এইজাতীয় সরকার ১৯৪২ খ্রীষ্টাব্দের ডিসেম্বর হইতে ১৯৪৪ খ্রীষ্টাব্দের আগস্ট মাস পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এককথায় মেদিনীপুর জেলার দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে কিছুদিনের জন্য ব্রিটিশ শাসনের বিলুপ্তি ঘটিয়াছিল। সরকারও মারমুখী হইয়া ছিলেন এবং সর্বত্র সৈন্যবাহিনীর গুলিবর্ষণের ফলে শত শত লোক প্রাণ হারায় এবং হাজার হাজার গ্রামের উপর পাইকারী জরিমানা ধার্য করা হয়।
গান্ধীজী ও অন্যান্য কংগ্রেস নেতৃবর্গ এইসব হিংসাত্মক কার্যের সঙ্গে কংগ্রেসের সম্পর্কের কথা অস্বীকার করেন। কিন্তু এই বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই যে, জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই আন্দোলনে ঝাঁপাইয়া পড়ে। জওহরলাল ১৯৪২-এর আগস্ট-আন্দোলনকে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের সঙ্গে তুলনা করিয়া লিখিয়াছিলেন, ‘নেতা নাই, সংগঠন নাই, উদ্যোগ-আয়োজন কিছুই নাই, কোন মন্ত্ৰবল নাই, অথচ একটা অসহায় জাতি আপনা হইতে কর্মপ্রচেষ্টার অন্য কোনো পন্থা না পাইয়া বিদ্রোহী হইল,—– এই দৃশ্য প্রকৃতই বিপুল বিস্ময়ের ব্যাপার।”
আগস্ট-আন্দোলনের ব্যর্থতার কারণ:
সরকারী দমননীতির ফলে শেষ পর্যন্ত “ভারত-ছাড়” আন্দোলন ব্যর্থ হইয়াছিল। তৎকালীন রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতিতে ইংরাজদের ভারত ত্যাগ করিতে বাধ্য করা সম্ভব ছিল না। ইহা ভিন্ন উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে জনগণ সর্বত্র সঠিকভাবে চলিতে পারে নাই। ভারতবর্ষের তৎকালীন বিভিন্ন দল যেমন মুসলিম লীগ আগস্ট-আন্দোলনের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন।
ভারত-ছাড়’ আন্দোলন: গুরুত্ব
‘ভারত-ছাড়’ আন্দোলন সাফল্যমন্ডিত না হইলেও এই আন্দোলনের ফলে ভারতীয় জনগণের সংগ্রামী শক্তি সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয়। বিদেশী শাসকগণ বুঝিতে পারিলেন যে তাঁহাদের সাম্রাজ্য আর রক্ষা করা সম্ভব নয়। এককথায়, ভারত-ছাড় আন্দোলন ছিল ভারতের আসন্ন স্বাধীনতার পূর্ব নির্দেশ। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য আগস্ট-আন্দোলন ছিল এক সর্বাত্মক গণ-বিস্ফোরণ। ভারতের
বড়লাট লর্ড লিনলিথগো ভারত-ছাড় আন্দোলনের ব্যাপকতা ও তীব্রতা লক্ষ্য করিয়া ইহাকে ১৮৫৭ খ্রীষ্টাব্দের মহাবিদ্রোহের পর ভারতের সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ব্রিটিশ-বিরোধী অভ্যুত্থান রূপে অভিহিত করিয়াছেন। গান্ধীজীর ভারত-ছাড় প্রস্তাব অনুসারে এই আন্দোলন শুরু হইলেও গান্ধীজীর অহিংস কর্মসূচীর ভিত্তিতে এই আন্দোলন পরিচালিত হয় নাই। বস্তুতঃপক্ষে হিংস ও অহিংস উভয় পদ্ধতি অবলম্বনেই এই জাতীয় সংগ্রাম গড়িয়া উঠিয়াছিল।
বস্তুতঃপক্ষে শীর্ষস্থানীয় কংগ্রেস নেতারা কারারুদ্ধ হওয়ায় এই আন্দোলন গোপন বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে সংগঠিত হয়। ইহা ভিন্ন, আগস্ট আন্দোলন ছিল সাধারণ ভারতবাসীর পুঞ্জীভূত বিক্ষোভের সর্বাত্মক ও স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিফলন।