মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি কি ছিল|The reason for the downfall of the Mughal Empire was in Bengoli
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি কি ছিল|The reason for the downfall of the Mughal Empire was in Bengoli
মােগল সাম্রাজ্যের পতন
মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের কারণসমূহ আলােচনা কর।
অথবা, মােগল সাম্রাজ্যের পতনের মূলে প্রধান কারণগুলি কি কি?
অথবা,
মােগল-সাম্রাজ্যের পতন কি কি কারণে ঘটিয়াছিল? ঔরঙ্গজেব এই পতনের জন্য কতখানি দায়ী ছিলেন ?
মােগল সাম্রাজ্যের পতন:
উত্তর।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অভ্যন্তরীণ কারণ:
ইতিহাসে সাম্রাজ্যের উত্থান যেমন সত্য, উহার পতনও তেমনি সত্য। মধ্যযুগে একদা মােগলসাম্রাজ্য আয়তন, জনসংখ্যা ও আর্থিক সম্পদে সমগ্র বিশ্বে শ্রেষ্ঠ আসন গ্রহণ করিয়াছিল; কিন্তু দুইশত বৎসরের কিছু অধিককালের মধ্যেই উহার অস্তিত্ব বিলুপ্ত হইয়া গেল। এত বড় একটি সাম্রাজ্যের পতন কেবলমাত্র একটি কারণে সম্ভব নহে, বা একদিনেও সম্ভব নহে। দীর্ঘদিন ধরিয়া কয়েকটি অভ্যন্তরীণ কারণে উহার ভিত্তি শিথিল হইয়া আসিতেছিল; অবশেষে বহির্দেশ হইতে কয়েকটি আক্রমণ উহার উপর চরম আঘাত হানিল।
রক জাতির গুণাবলী:
সম্রাট শাহজাহানের আমল হইতেই মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের সূচনা হয়। প্রথমত, মধ্যযুগের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী মােগল-সাম্রাজ্যও মূলত সামরিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। মােগলগণ ছিলেন নিতান্তই সামরিক জাতি। ভারতবর্ষে যতদিন যুদ্ধের প্রয়ােজন ছিল ততদিন তাহাদের গুণাবলী ও শক্তি ছিল অটুট। কিন্তু যখন হইতে তাহার প্রয়ােজন মিটিয়া গেল তখন হইতে নানাদিক দিয়া তাহাদের মধ্যে দুর্বলতা দেখা দিতে লাগিল, তাহাদের পতন আরম্ভ হইল।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র:
দ্বিতীয়ত, মােগল শাসন ছিল স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্র এক্ষেত্রে সম্রাটের ব্যক্তিগত চরিত্র, বুদ্ধি, কর্মনিষ্ঠা ও সামরিক শক্তির উপরই সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব একান্তভাবে নির্ভর করিত। ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত মােগল সম্রাটগণের পশ্রিম ও কর্মনিষ্ঠার জন্য সাম্রাজ্যের ঐক্য ও শৃঙ্খলা মােটের উপর অব্যাহত রাখা সম্ভব হইয়াছিল কিন্তু পরবর্তী যুগের বিলাসপ্রিয় দুর্বল সম্রাটগণ সাম্রাজ্যকে সঙ্কট হইতে রক্ষা করিবার মত কোন ক্ষমতা রাখিত না। প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের স্বাধীনতা-স্পৃহাকে দমন করিতে পারিত না।
তৃতীয়ত, স্বৈরাচারী একনায়কতন্ত্রের অপর সমস্ত ক্রটিও মােগল-সাম্রাজ্যে স্বভাবতই বিদ্যমান ছিল। জনসাধারণের স্থায়ী সমর্থন ও আনুগত্যের উপর মােগল-সাম্রাজ্যের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত ছিল না।
সাম্রাজ্যের প্রতি জন সাধারণের আনুগত্য:
একমাত্র মােগল সম্রাট আকবর তাহার উদারতা, দূরদর্শিতা ও গভীর রাজনীতিজ্ঞানের সাহায্যে সাম্রাজ্যের প্রতি প্রজাসাধারণের আনুগত্য লাভ করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন। কিন্তু পরবর্তী মােগল সম্রাটগণ সে নীতি অনুসরণ করেন। নাই, এবং স্বভাবতঃই জনসাধারণের সমর্থনের দৃঢ়ভিত্তির উপর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয় নাই। তাই সাম্রাজ্যের সহিত প্রজাসাধারণের কোন যােগাযােগ ছিল না।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অর্থনৈতিক কারণ:
চতুর্থত,বিলাস ও আড়ম্বরের রাজকীয় আতিশয্য জনগণের অর্থনৈতিক দুর্গতি:
সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক কাঠামাে শক্তিশালী করিবার কোন প্রচেষ্টা ছিল না। একদিকে যেমন ছিল আড়ম্বর ও বিলাসব্যসন, অপরদিকে তেমনি ছিল আতিশয্য জনগণের প্রজাসাধারণের অর্থনৈতিক দুর্গতি। একটি সুনিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক নীতি অর্থনৈতিক দুর্গতি দ্বারা সাম্রাজ্যের অর্থনৈতিক শক্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি করার কোন চেষ্টাই ছিল না। একদিকে কৃষিক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ বৃদ্ধি পায় নাই। অন্যদিকে শিল্প বাণিজ্যের প্রসারের দিকেও মােগল শাসকগণ প্রয়াসী হন নাই। এদিকে ভূমি রাজস্বের পরিমাণ অত্যধিক হওয়ায় কৃষকদের আর্থিক দুর্দশা বৃদ্ধি পায়। ঐতিহাসিক ইরফান হাবিবের মতে মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের মূলে ছিল কৃষি সঙ্কট (agrarian crisis)। কৃষককূলের অবস্থা শাচনীয় হইয়া উঠে এবং জাঠ, সত্যমী, শিখ বিদ্রোহে কৃষকগণ দলে দলে সামিল হয়।
ব্যবস্থার অভাব; অধঃপতন
পঞ্চমত, রাস্তাঘাট ও যোগাযোগব্যবস্থা অভাব
সাম্রাজ্যের বিশাল আয়তন উহার পতনের অন্যতম কারণ ছিল। মধ্যযুগে রাস্তাঘাট বা যােগাযােগের ব্যবস্থা সুবিধাজনক ছিল না; সুতরাং দূরবর্তী প্রদেশসমূহের উপর কেন্দ্র হইতে রাস্তাঘাট ও যােগাযােগ দৃষ্টি রাখা এক দুরূহ ব্যাপার ছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্য কারণ উত্তরাধিকার-দ্বন্দ্ব
যষ্ঠত, উত্তরাধিকার-দ্বন্দ্ব
উত্তরাধিকার সম্বন্ধে কোন সুনির্দিষ্ট আইন না থাকায় প্রতিবারই উত্তরাধিকার-দ্বন্দ্বের উদ্ভব হইত। উত্তরাধিকার-দ্বন্দ্ব ইহার ফলে স্বার্থান্বেষী আমীরগণের প্রভাব বৃদ্ধি পাইত এবং সাম্রাজ্যের ভিত্তি শিথিল হইয়া পড়িত।
সপ্তমত, অভিজাত শ্রেণীর অধঃপতন
মােগল শাসনের শেষদিকে অভিজাতশ্রেণীর মধ্যেও নানা দুর্বলতা প্রবেশ করিতেছিল। বিলাস-প্রিয়তা, স্বার্থান্বেষণ, আত্মকলহ প্রভৃতি তাহাদের মধ্যে অভিজাতশ্রেণীর প্রবলভাবে দেখা দিতেছিল। অথচ এই অভিজাত শ্রেণীই এক সময়ে সাম্রাজ্যের স্তম্ভস্বরূপ ছিল। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বের শেষ ভাগে মােগল অভিজাতশ্রেণীর দলগত ও গােষ্ঠীগত বিরােধ সৃষ্টি হয়। এই সময় মােগল অভিজাতদের মধ্যে দুইটি পরস্পর-বিরােধী গােষ্ঠীর উদ্ভব হয় যথা—ইরানী ও তুরানী। এই দুই গােষ্ঠীর পারস্পরিক ঈর্ষা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব মােগল-সাম্রাজ্যে এক গভীর সঙ্কটের সৃষ্টি করে। ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর অভিজাত সম্প্রদায়ের দলাদলি আরও প্রকট আকার ধারণ করে। মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের মূলে অভিজাতশ্রেণীর দায়িত্ব সম্বন্ধে ভিন্ন ভিন্ন মত প্রচলিত আছে। সতীশচন্দ্র প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে তাদের নৈতিক অধঃপতনের ফলে মােগল-সাম্রাজ্যের সংহতি বিপন্ন হয় নাই। অভিজাতদের দলাদলি ও ক্ষমতা লিপ্সা সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে বেশী ক্ষতিকর হইয়াছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অপর এক কারণ মনসবদারী প্রথার কুফল
অষ্টমত, বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে সৈন্যবাহিনী, মনসবদারী প্রথার কুফল
মােগল সামরিকবাহিনীর মধ্যেও অবশেষে নানা দুর্বলতা দেখা দেয়। বিভিন্ন জাতি হইতে সৈন্যদল সংগৃহীত হওয়ায় মােগলবাহিনী কোন সময়েই জাতীয় বাহিনীরূপে দেখা দেয় নাই এবং সকল জায়গায় একরকম রণনীতিও অনুসৃত হইতে পারে বিভিন্ন জাতির সমন্বয়ে নাই। মনসবদারী প্রথা চালু থাকার ফলে সৈন্যদলের আনুগত্য অনেক সময় সম্রাটের চাইতে মনসবদারগণের উপরই বেশি দেখা যাইত। তাহা ছাড়া, সেনাশিবিরে বিলাসব্যসন, জাকজমক প্রভৃতি সেনাবাহিনীর প্রথার কুফল ক্ষমতা অনেক পরিমাণে বিনষ্ট করিয়া দিয়াছিল।
অনাবশ্যকভাবে সৈন্যবাহিনীর সহিত প্রচুর দ্রব্যসম্ভার থাকার ফলে উহার ক্ষিপ্রগতি ব্যাহত হইয়াছিল এবং সৈন্যবাহিনীর এইজন্যই মারাঠাবাহিনীর সহিত তাহারা কিছুতেই আঁটিয়া উঠিতে পারিত না।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের কারণ নৌবাহিনীর অভাব ও তাহার ফল:
নৌবাহিনীর অভাবকে মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম কারণ বলিয়া ঐতিহাসিক স্মিথ উল্লেখ করিয়াছেন। তাহার মতে এই দুর্বলতার জন্যই মােগলগণ নৌবলে বলীয়মান ইওরােপীয়গণকে পথ ছাড়িয়া দিতে বাধ্য হইয়াছিল। কিন্তু এই মত নৌ বাহিনীর অভাব ও গ্রহণযােগ্য নহে; কারণ ইওরােপীয় অপেক্ষা মারাঠাগণের নিকট হইতেই তাহার ফল মােগল-সাম্রাজ্যের উপর প্রথম ও প্রধান আঘাত আসিয়াছিল।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ ওরঙ্গজেব এর পরম অসহিষ্ণুতা দাক্ষিণাত্য ক্ষত:
সর্বশেষে, মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের জন্য ঔরঙ্গজেবের ধর্মান্ধতা ও দাক্ষিণাত্য-নীতি কম দায়ী নহে। তাহার পরধর্ম-অসহিষ্ণুতার জন্য হিন্দু প্রজাগণ সাম্রাজ্যের পরম শত্রুতে পরিণত হইয়াছিল, তাহারই অদূরদর্শিতার ফলে জাঠ, রাজপুত, মারাঠা ও
শিখদের তরফ হইতে মােগল-সাম্রাজ্য-বিরােধী আন্দোলনের অভ্যুদয় ঘটিয়াছিল এবং ফলে সাম্রাজ্যের বিপর্যয় দেখা দিয়াছিল। ঔরঙ্গজেবের দাক্ষিণাত্য-নীতির ব্যর্থতাও সাম্রাজ্যের ধ্বংসের পথকে সুগম করিয়া দিয়াছিল।
দাক্ষিণাত্য ক্ষত’ রাজধানী হইতে দীর্ঘকাল অনুপস্থিত
তাহার দাক্ষিণাত্যবিজয় মােগল-সাম্রাজ্যের শক্তি বৃদ্ধি না করিয়া তাহার দেহে ক্ষত সৃষ্টি করিয়াছিল। মারাঠাশক্তিকে দমন করিবার জন্য দীর্ঘকাল রাজধানী হইতে অনুপস্থিত থাকিয়া তিনি দেশের শাসনব্যবস্থাকে শিথিল করিয়া ফেলিয়াছিলেন। মারাঠাশক্তির সহিত ক্রমাগত ব্যর্থ সংঘর্ষে লিপ্ত থাকিয়া তিনি তাহার সৈন্যবাহিনীর মধ্যে হতাশার সৃষ্টি করিতে সাহায্য করিয়াছিলেন মাত্র।
মোগল সাম্রাজ্যের পতনের বহিরাগত কারণ উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষা ব্যবস্থায় দুর্বলতা:
কিন্তু কেবলমাত্র এই সমস্ত অভ্যন্তরীণ কারণে এত দ্রুত ভাঙিয়া পড়িত না, যদি না বহির্দেশ হইতে আঘাতের পর আঘাত আসিয়া তাহাকে বিপর্যস্ত করিত। উত্তর-পশ্চিম দ্বারপথ দিয়াই যুগে যুগে ব্যবস্থায় দুর্বলতা ভারতে বহিঃশত্রুর প্রবেশ সম্ভব হইয়াছিল। কিন্তু এই দ্বারপথকে সুরক্ষিত রাখিবার কোন উল্লেখযােগ্য চেষ্টাই মােগল সম্রাটগণ করেন নাই। ইহারই সুযােগ লইয়া এবং অভ্যন্তরীণ দুর্বলতায় প্রলুব্ধ হইয়া প্রথমে নাদির শাহ্ এবং পরে আহম্মদ শাহ দুররানী বারবার সাম্রাজ্যের উপর আঘাত হানিতে শাহ দুরানী লাগিলেন। এই আঘাত হইতে সাম্রাজ্যকে বাচাইবার কোন ক্ষমতা দুর্বল সম্রাটদের ছিল না।
এইরূপভাবে অভ্যন্তরীণ ও বহিরাগত কারণে একদা বিশাল মােগল-সাম্রাজ্য ধ্বংসের পথে অগ্রসর হইল। আপাতদৃষ্টিতে এই ধ্বংসসাধন ঔরঙ্গজেবের পর অত্যন্ত দ্রুতগতিতে সংঘটিত হইয়াছিল মনে হইতে পারে, কিন্তু উপরি-উক্ত কারণসমূহ বিশ্লেষণ করিলে দেখা যাইবে যে ইহাতে আশ্চর্য হইবার কিছু নাই। মােগল-সাম্রাজ্যের পতনের মূলে কোন একটি বিশেষ কারণ বা কোন বিশেষ ব্যক্তি দায়ী ছিলেন তাহা বলা যায় না। যদিও ঔরঙ্গজেবের ভ্রান্তনীতি মােগল-সাম্রাজ্যের সংহতির পক্ষে ক্ষতিকারক ছিল, তথাপি শাহজাহানের রাজত্বকাল হইতে সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয়ের ইঙ্গিত দেখা যায়। দুর্ভাগ্যবশত ঔরঙ্গজেব সামাজিক, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে প্রয়ােজনীয় কাঠামােগত সংস্কার সাধনে ব্যর্থ হন এবং
সাম্রাজ্যের পতন অনিবার্য হইয়া উঠে।