History

গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস|History of the Gupta Empire|

 গুপ্ত সাম্রাজ্যের ইতিহাস|History of the Gupta Empire|

 

গুপ্ত সাম্রাজ্য:-

 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের সূচনা-

 

মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের সঙ্গে সঙ্গে ভারতে রাজনৈতিক ঐক্য নষ্ট হয়েছিল। মৌর্যদের পরে ভারতের বিভিন্ন অংশ দীর্ঘকাল ধরে বিদেশিদের দ্বারা আক্রান্ত ও অধিকৃত হয়েছিল। কুষাণরা ভারতের বিস্তীর্ণ অঞলে ঐক্য ফিরিয়ে এনেছিলেন। কিন্তু কুষাণ সাম্রাজ্যের পতনের পরে সেই ঐক্য নষ্ট হয়ে যায়। শকদের অধীনে ছিল গুজরাট ও মালবের একাংশ। কিন্তু শকদের শক্তি দ্রুত হ্রাস পাওয়ার ফলে উত্তর ভারতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের উদ্ভব হয়েছিল এবং উত্তর ভারতে অনৈক্য ও অস্থিরতা দেখা যায়। এই অবস্থায় মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পাঁচশত বছর পরে গুপ্তদের নেতৃত্বে মগধকে কেন্দ্র করে পুনরায় ভারতে আর একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে উঠেছিল। এই গুপ্ত সাম্রাজ্য পুনরায় ভারতে ঐক্য, শান্তি ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে এনেছিল। প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে গুপ্ত যুগে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানে অভূতপূর্ব উন্নতি হয়েছিল।

গুপ্ত-সাম্রাজ্যের-ইতিহাস-History-of-the-Gupta-Empire

 

গুপ্ত সাম্রাজ্যের:গুপ্ত রাজ বংশের প্রতিষ্ঠা:

 

• প্রথম চন্দ্রগুপ্ত ও গুপ্তদের আদি বাসস্থান কোথায় ছিল, তা বলা কঠিন, কেউ কেউ বলেন গুপ্তদের আদি বাসস্থান ছিল উত্তরপ্রদেশে। পুরাণের মতে মগধ ছিল তাদের আদি বাসস্থান। বৈদেশিক পরিব্রাজক ইৎ-সিং-এর বিবরণ থেকে জানা যায় যে, শ্রীগুপ্ত নামে জনৈক রাজা গুপ্ত বংশের প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি পাটলিপুত্র অঞ্চলের সামন্ত রাজা ছিলেন। তিনি সম্ভবত বাংলা ও  বিহারের অন্তর্গত কোন ক্ষুদ্র রাজ্যের শাসন কর্তা ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র ঘটোৎকচ গুপ্ত রাজা হন। এরা দু’জন মহারাজা উপাধি ব্যবহার করতেন। গুপ্ত বংশের প্রথম স্বাধীন রাজা ছিলেন প্রথম চন্দ্রগুপ্ত। তিনি ঘটোৎকচ গুপ্তের পুত্র ছিলেন এবং মহারাজাধিরাজ উপাধি গ্রহণ করেন। সম্ভবত ৩২০ খ্রিস্টাব্দে তিনি মগধের সিংহাসনে বসেন এবং এই সময় থেকেই তিনি গুপ্তা নামে নতুন একটি অব্দের প্রচলন করেছিলেন। বৈশালীর লিচ্ছবী বংশীয় রাজকন্যা কুমার দেবীকে তিনি বিবাহ করে তার শক্তি, সম্মান ও প্রতিপত্তি বৃদ্ধি করেন। মগধ সহ সমগ্র বিহার, অযােধ্যা, এলাহাবাদ, ত্রিহৃত, বঙ্গদেশের কিছু অংশ তার সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল। ৩৪০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রথম চন্দ্রগুপ্ত রাজত্ব করেছিলেন।

 

সমুদ্রগুপ্ত (৩৪০-৮০ বা ৩৩৫-৮০ খ্রিঃ) :

 

 সিংহাসন লাভ ও উদ্দেশ্য ঃ 

 এলাহাবাদ প্রশস্তি থেকে জানা যায় যে, প্রথম চন্দ্রগুপ্ত মৃত্যুর পূর্বে তার যােগ্যতম পুত্র সমুদ্রগুপ্তকে উত্তরাধিকারী মনােনীত করেন। ৩৩৫ বা ৩৪০ খ্রিস্টাব্দে সমুদ্রগুপ্ত সিংহাসনে আসীন হন। হরিষেণ রচিত এলাহাবাদ প্রশস্তি, ফা হিয়েনের বিবরণ,

সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা প্রভৃতি থেকে সমুদ্রগুপ্তের রাজত্বকাল সম্বন্ধে জানা যায়। সিংহাসনে আরােহণ করেই সমুদ্রগুপ্ত দিগ্বিজয়ীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তাঁর উদ্দেশ্য ছিল ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য সাধন এবং নিজেকে একরাট রূপে প্রতিষ্ঠিত করা। রাজ্য বিস্তারে তিনি ভিন্ননীতি গ্রহণ করেছিলেন। উত্তর ভারতের রাজ্যগুলি সরাসরি তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ ভারতে তিনি তা করেন নি। দক্ষিণ ভারতের তিনি গ্রহণপৱিমােক্ষনীতি গ্রহণ করেন। তিনি প্রথমে উত্তর ভারত অভিযান করেন, পরে দক্ষিণ ভারত। রাজ্যজয়ের জন্য সমুদ্রগুপ্ত ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেন।

 

 উত্তর ভারত অভিযান :

 

 এলাহাবাদ প্রশস্তির বর্ণনা অনুসারে সমুদ্রগুপ্ত উত্তর ভারতে নয়জন রাজাকে পরাজিত করেন। প্রথম পর্বে গাঙ্গেয় উপত্যকায় নাগবংশীয় তিনজন রাজাকে পরাজিত করেন। এরা হলেন অচ্যুত, নাগসেন ও গণপতি নাগ। তাদের রাজ্য ছিল যথাক্রমে অহিচ্ছত্র, মথুরা ও পদ্মাবতী। এর পর তিনি দক্ষিণাত্য বিজয় সম্পূর্ণ করে পুনরায় উত্তর ভারতের ছয়টি রাজ্য অধিকার করেন। এই সব রাজ্যের পরাজিত রাজারা হলেন রুদ্রদেব, মতিল, চন্দ্রবর্মন, বলবর্মন, নাগদত্ত এবং নন্দী। এই রাজ্যগুলি তিনি তার সাম্রাজ্যভুক্ত করেছিলেন। উত্তর প্রদেশের অধিকাংশ অঞল, মধ্যভারতের কিছু অংশ এবং বঙ্গদেশের দক্ষিণ পশ্চিম অংশ তার সাম্রাজ্য ভুক্ত ছিল। মােটামুটি দিল্লি, পাঞ্জাব, মালব, রাজপুতনা, গাঙ্গেয় উপত্যকা, মধ্যভারতের বিস্তীর্ণ অঞল তার অধিকারে এসেছিল। বঙ্গদেশ জয়ের পিছনে তার বাণিজ্য ভিত্তিক অর্থনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল।

 

আটবিক রাজ্য জয় : 

 উত্তর ভারত জয়ের পর তিনি মধ্য ভারতের আটবিক বন রাজ্যগুলি। জয় করেন। এই রাজ্যগুলি জব্বলপুর থেকে গাজিপুর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এই আটবিক রাজ্যগুলিকে নিজ সাম্রাজ্যভুক্ত করে তিনি সর্বরাজোচ্ছেত্তা উপাধি ধারণ করেন। এই রাজ্য জয়ের ফলে দাক্ষিণাত্য অভিযানের পথ সুগম হয়।

 

দাক্ষিণাত্য জয় : 

 উত্তরভারতে একচ্ছত্র অধিপত্য লাভ করে তিনি | ভারতের পূর্ব উপকূল ধরে দক্ষিণ ভারত অভিযান করেন। দক্ষিণ ভারতের পূর্বদিকের বারােজন রাজাকে তিনি পরাজিত করেন। এঁরা হলেন (১) কোশলের মহেন্দ্র, (২) মহাকান্তারের ব্যাঘ্ররাজ, (৩) কৌরলের মন্তরাজ, (৪) পিষ্ঠপুরমের মহেন্দ্রগিরি, (৫) কোরের | স্বামীদত্ত, (৬) এরন্ডপন্নের দমন, (৭) কাঞির বিত্মগােপ, (৮) সমুদ্রগুপ্তের মুদ্রা অবমুক্তার নীলরাজ, (৯) বেগির হস্তিবর্মন, (১০) পালাঙ্কের উগ্রসেন, (১১) দেবরাষ্ট্রের কুবের (১২) কুথলপুরের ধনঞ্জয়। এই অভিযান তিনি শুরু করেছিলেন উড়িষ্যার গঞ্জাম থেকে মাদ্রাজের কাঞ্চি পর্যন্ত। এই অভিযানে থলবাহিনী ও নৌবাহিনী যৌথভাবে অংশগ্রহণ করেছিল বলে দাক্ষিণাত্যের রাজ্যগুলি জয় করে তা নিজ শাসনে অন্তর্ভুক্ত না করে তিনি রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছিলেন। কারণ তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, পাটলীপুত্র থেকে সুদূর দাক্ষিণাত্যের উপর নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। সেইজন্য তিনি দক্ষিণ ভারতের রাজাদের কাছ থেকে কর ও আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি গ্রহণ করে তাঁদের নিজরাজ্য ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার দাক্ষিণাত্য বিজয়ের তিনটি নীতি ছিল। এই নীতিকে গ্রহণ পরিমােক্ষ বলা হয়।প্রথমটি “গ্রহণ”শত্রুকে বলপূর্বক বন্দী করা, দ্বিতীয়টি “মােক্ষ” অর্থাৎ শত্রুর মুক্তি দান এবং তৃতীয়টি “অনুগ্রহ” অর্থাৎ পরাজিত শত্রুকে তার হৃতরাজ্য প্রত্যর্পণ করা। তবে সমুদ্রগুপ্ত পরাজিত রাজ্যগুলিকে সার্বভৌমত্ব ফিরিয়ে দেন নি।

 

 সীমান্ত রাজ্য ও উপজাতি রাজ্যের আনুগত্য :

  সমুদ্রগুপ্তের দিগ্বিজয়ে শঙ্কিত হয়ে পাঁচটি সীমান্ত রাজ্য তার আনুগত্য মেনে নেয়। সমতট (পূর্ব বাংলার একাংশ), দাবক (ঢাকা জেলা), কামরূপ (উত্তর আসাম), নেপাল ও কর্তৃপুর (জলন্ধর জেলা) – এই পাঁচটি সীমান্তবর্তী রাজ্য গুপ্তদের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। হরিষেণের বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে নয়টি উপজাতি রাজ্য মালব, অর্জুনায়ন, যৌধেয়, মদ্রক, আভীর, প্রার্জুন, কাক ও খর-পারিক প্রভৃতি রাজ্য সমুদ্রগুপ্তের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছিল।

 

 বৈদেশিক সম্পর্ক :

  সমুদ্রগুপ্তের পরাক্রমের খ্যাতি কেবলমাত্র ভারতে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারত উপমহাদেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে ছিল। অনেক বিদেশি শাসকসমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপনে আগ্রহী হয়েছিলেন। পশ্চিম পাঞ্জাব ও কাবুল উপত্যকার কুশাণ  রাজা দৈবপুত্র তার সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক করেছিলেন এবং মালব ও কাগিয়াড়ের শব বাজার সমুদ্রগুপ্তের সঙ্গে মৈত্রী স্থাপন করেছিলেন। সিংহল রাজ মেঘবর্মা সমুদ্রগুপ্তের অনুমতি নিয়ে বুদ্ধ গয়ায় একটি বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার মালয়, জাভা, সুমাত্রা প্রভৃতি বিদেশি রাজ্যের সঙ্গে সমুদ্র গুপ্তের সুসম্পর্ক ছিল।

 

 গুপ্ত সাম্রাজ্য -সমুদ্রগুপ্তের কৃতিত্ব ঃ 

 মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের পর সমুদ্রগুপ্তই সমগ্র ভারতে এক সার্বভৌম রাজশক্তি স্থাপন করেছিলেন। গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ সম্রাট সমুদ্রগুপ্ত ৩৪০ খ্রিঃ থেকে ৩৮০ খ্রিঃ পর্যন্ত রাজত্ব করেন। তিনি উত্তর ভারত, মধ্য ভারত ও দক্ষিণ ভারত জয় করে একবিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিলেন এবং ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন করেছিলেন। দিগ্বিজয়ে সাফল্যের পর সনগুপ্ত অশ্বমেধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান করেন এবং তিনি “পরাক্রমাঙ্ক” “সর্বরাজোচ্ছেত্তা”, “অপ্রতিরথ” প্রভৃতি উপাধি ধারণ করেন। সমুদ্রগুপ্তের রণকুশলতা ও দিগ্বিজয়ের জন্য ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট থি তাকে “ভারতের নেপােলিয়ান” বলে আখ্যায়িত করেছেন। তাঁর সাম্রাজ্যসীমা ছিল হিমালয়ের পাদদেশ থেকে দক্ষিণে উড়িষ্যা হয়ে তামিলনাড়ুর চিঙ্গলপেট পর্যন্ত।

 

 গুণাবলি :

 সমুদ্রগুপ্ত যেমন দিগ্বিজয়ী বীর ও সুশাসক ছিলেন, তেমনি কবি, সঙ্গীতজ্ঞ, শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত ও শিক্ষা-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপােষক হিসাবে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তার প্রজাকল্যাণ সুদক্ষ শাসন কালে গুপ্তসাম্রাজ্য ব্যবসা-বাণিজ্য ও শিল্পে সমৃদ্ধ হয়েছিল। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে তাঁকে কবিরাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে কাব্য সাহিত্যে তাঁর অনুরাগের কথা জানা যায়। তার মুদ্রায় বীণাবাদনরত মুর্তি থেকে তার সঙ্গীতানুরাগের কথা জানা যায়। জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি রা তার পৃষ্ঠপােষকতা লাভ করতেন। সংস্কৃত পন্ডিত হরিষেণ ছিলেন তাঁর সভাকবি এবং বেবি পন্ডিত বসুন্ধু ছিলেন তার মন্ত্রি ও মিত্র। সমুদ্রগুপ্ত ছিলেন ব্রাহ্মণ্যধর্মের অনুরাগী। তার শাসনকালে সুশাসন, শান্তি শৃংখলা, আর্থিক সমৃদ্ধি শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান বিজ্ঞান প্রভৃতি ক্ষেত্রে অতপর উন্নতি ঘটেছিল। এই জন্য গুপ্ত যুগকে প্রাচীন ভারতের সুবর্ণযুগ বলা হয়। অশােকের হল ছিল ধর্ম বিজয় আর সমুদ্রগুপ্তের লক্ষ্য ছিল দিগ্বিজয়।

গুপ্ত সাম্রাজ্য দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত (৩৮০-৪১৪ খ্রিস্টাব্দ) :

 সিংহাসন লাভ ঃ সমুদ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত, গুপ্ত সাম্রাজ্যের সিংহাসনে আরােহণ করেন। তিনি সম্ভবত ৩৮০ থেকে ৪১৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত রাজত্ব করেন।

 নীতি :

  দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পিতার মত দিগ্বিজয়ী বীর না হলেও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যের আয়তন কিছুটা বৃদ্ধি করেছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত দুইটি নীতির দ্বারা গুপ্ত সাম্রাজ্যের শকি ও রাজনৈতিক প্রতিপত্তি প্রসারিত করেছিলেন, প্রথমত, বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মাধ্যমে ও দ্বিতীয়ত, যুদ্ধ নীতির দ্বারা। তিনি মধ্য ভারতের শক্তিশালী নাগ বংশের রাজকন্যা কুবের নাগাকে বিবাহ করেন এবং নিজ বংশের শক্তি বৃদ্ধি করেন। নর্মদা উপত্যকার দক্ষিণে মহারাষ্ট্রের শক্তিশালী বাকাটক বংশের রাজা দ্বিতীয় রুদ্রসেনের সঙ্গে নিজ কন্যা প্রভাবতীর বিবাহ দেন। নাগবংশ ও বাকাটক বংশের সঙ্গে বৈবাহিক মৈত্রী সম্পর্ক স্থাপনের ফলে শক রাজ্য জয়ের পথ সুগম হয়েছিল। এছাড়া তিনি তাঁর পুত্রের সঙ্গে কুন্তল (কর্ণাটক) রাজ্যের কদম্ব বংশের বিবাহ দেন।

শকদের উচ্ছেদ :

 ভারতের উত্তর-পশ্চিমে মালব, গুজরাট কাথিয়াবাড় তলে বিদেশি শক ক্ষত্রপগণ প্রায় তিনশ বছরের বেশি সময় ধরে রাজত্ব করছিল। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিবেশি

শকদের প্রতিপত্তি দমন করা এবং পশ্চিম ভারতে বন্দর গুলিতে ব্যবসা-বাণিজ্য কেন্দ্র অধিকার করার প্রয়ােজনে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শক রাজা তৃতীয় রুদ্র সেনের বিরুদ্ধে অভিযান করেন। যুদ্ধের পর তিনি শকরাজ রুদ্রসেনকে পরাজিত করে মালব, গুজরাট ও সৌরাষ্ট্র অধিকার করেন। শকদের পরাজিত করে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত শকারি উপাধি ধারন করেন। শকদের বিরুদ্ধে জয়লাভের ফলে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সাম্রাজ্য পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরব সাগর পর্যন্ত প্রসারিত পশ্চিম উপকূলের বন্দর গুলি দিয়ে রােম সাম্রাজ্যের সঙ্গে বাণিজ্য চলত। পূর্ব উপকূল দিয়ে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশ গুলির সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক বৃদ্ধি হয়। পশ্চিম ভারতে সুষ্ঠু শাসনের প্রয়ােজনে তিনি উজ্জয়িনীতে বিকল্প রাজধানী স্থাপন করেছিলেন।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন।

 দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের কৃতিত্ব :

  গুপ্ত বংশের শ্রেষ্ঠ স্থপতিরূপে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তকে অভিহিত করা যেতে পারে। তাঁর রাজত্বকালে গুপ্ত সাম্রাজ্য চরম উৎকর্ষ লাভ করেছিল। সুশাসন প্রতিষ্ঠা, সাম্রাজ্য বিস্তার, অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও শিল্প সংস্কৃতির বিকাশ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল স্মরণীয়। উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত সাম্রাজ্যকে দ্বিতীয়চন্দ্রগুপ্ত বিস্তৃত করেছিলেন। তার সুষ্ঠু শাসনে সাম্রাজ্যে শান্তি শৃংখলা ফিরে আসে। চৈনিক পরিব্রাজক ফা-হিয়েন তার রচিত ভ্রমণ কথা ফো-কুয়াে-কিং গ্রন্থে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের শাসন ব্যবস্থার উচ্ছসিত প্রশংসা করেছেন। তাহার শাসনব্যবস্থা ছিল উদার ও জনকল্যাণমূলক। দেশে অপরাধ হ্রাস পাওয়ায় দন্ড বিধির কঠোরতা হ্রাস পায়। এই সময় আর্থিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সমৃদ্ধি এসেছিল।

তাঁর শাসনকালে জ্ঞান-বিজ্ঞান এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির বিকাশ ঘটেছিল। তিনি নিজে  বৈষ্ণব হওয়া সত্ত্বেও পরধর্ম সহিষ্ণু ছিলেন। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মুদ্রায় তাকে শ্রী বিক্রম, সিংহ-ক্রিম, বিক্রমাদিত্য প্রভৃতি উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার রাজসভায় নবরত্ন বা নয়জন পণ্ডিত ছিলেন। তাঁরা হলেন – কালিদাস, ধন্বন্তরি, ক্ষপণক, শঙ্কু, বেতাল ভট্ট, ঘটকৰ্পর, অমর সিংহ, বরাহমিহির ও বররুচি। মহাকবি কালিদাস দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের নবরত্নের সভার সদস্য ছিলেন। স্থাপত্য, ভাস্কর্য ও চিত্রকলা ও অজন্তা গুহাচিত্র অঙ্কণ প্রভৃতি ক্ষেত্রে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রাজত্বকাল ভারতের গৌরব বৃদ্ধি করেছিল। ।

কুমার গুপ্ত (৪১৫-৪৫৫) :

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যুর পর তার পুত্র প্রথম কুমার গুপ্ত ৪১৫ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে বসেন। তিনি বিশাল গুপ্ত সাম্রাজ্যকে অক্ষুন্ন রেখেছিলন। তার চল্লিশ বছরের রাজত্ব কাল শান্তি ও সমৃদ্ধির যুগ ছিল। তাঁর রাজত্ব কালের শেষ দিকে নর্মদা উপত্যকার পুষ্যমিত্র নামে এক জাতি গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করে। তিনি এই আক্রমণ প্রতিহত করে সাম্রাজ্যকে রক্ষা করেন। ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে তার রাজত্বের অবসান হয়।

• স্কন্দ গুপ্ত (৪৫৫-৪৬৭ খ্রিস্টাব্দ) ঃ

কুমার গুপ্তের মৃত্যুর পর তাঁর পুত্র স্কন্দগুপ্ত ৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে মগধের সিংহাসনে বসেন। তিনি সিংহাসনে আরােহণ করার কিছু কাল পর হুণরা হিন্দুকুশ পর্বত অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে শুরু করলে স্কন্দগুপ্ত হুণদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন এবং শােচনীয় ভাবে ণদের পরাজিত করেন। হুণরা পরাজিত হয়ে ভারত ছেড়ে চলে যায়। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার স্কন্দগুপ্তকে “ভারতের রক্ষাকারী” বলে অভিহিত করেছেন। দক্ষিণ ভারতের বকাটকগণ গুপ্ত সাম্রাজ্য আক্রমণ করলে স্কন্দগুপ্ত তাদের পরাজিত করেন। স্কন্দগুপ্ত কেবল যুদ্ধই নয় সাম্রাজ শাসনে দক্ষতার পরিচয় দিয়েছিলেন। তিনি সুরাষ্ট্রের সুদর্শন হ্রদের সংস্কার করেছিলেন। স্কন্দগুপ্ত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় যুক্ত ছিলেন। তিনি নিজে বৈষ্ণব ধর্মাবলম্বী হলেও বৌদ্ধ ধর্মের পৃষ্ঠপােষকতা করেছেন।

স্কন্দগুপ্তের মৃত্যুর পর (৪৬৭ খ্রিঃ) গুপ্ত সাম্রাজ্যের পতন আরম্ভ হয়। গুপ্ত শাসনাধীন প্রাদেশিক শাসনকর্তারা স্বাধীন হতে থাকে। হূণরাজা তােরমাণ ও তার পুত্র মিহিরকুল সিব্বদেশ, রাজস্থান, পশ্চিমভারতের কয়েকটি অঞ্চল দখল করে নেয়। অল্পকালের মধ্যে গুপ্ত সাম্রাজ্য ভেঙে পড়ে। 

গুপ্ত সাম্রাজ্য :গুপ্তযুগের শাসন ব্যবস্থা ।

সম্রাটের ক্ষমতা : ফা-হিয়েনের বিবরণ, গুপ্তযুগের শিলালিপি ও অন্যান্য উপাদান থেকে গুপ্ত শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা যায়। সম্রাট ছিলেন সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী। তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ শাসক, বিচারক, আইন প্রণেতা ও সামরিক বিভাগের প্রধান। রাজারা নিজেদের ঐশ্বরিক ক্ষমতার অধিকারীরূপে পরমভট্টারক, পরমেশ্বর, দেবানামপ্রিয় উপাধি গ্রহণ করতেন। রাজারা স্বৈরাচারী হলেও তারা রীতিনীতি, সামন্ততন্ত্র, মন্ত্রী প্রভৃতির দ্বারা শাসন পরিচালনা করতেন।

 

কেন্দ্রীয় কর্মচারী :

  গুপ্তশাসন ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক দুইভাগে বিভক্ত ছিল। কেন্দ্রীয় শাসন মন্ত্রি, সচিব ও উচ্চপদস্থ কর্মচারীদের দ্বারা পরিচালিত হত। মন্ত্রিপদ বংশানুক্রমিক ছিল। কেন্দ্রীয় কর্মচারীদের মধ্যে ছিলেন মহাবলাধিকৃত (প্রধান সেনাপতি), মহাদণ্ডনায়ক (প্রধান বিচারপতি) সন্ধিবিগ্রহিক, মহাপ্রতিহার (রাজধানী রক্ষক) প্রভৃতি। নিম্নপদস্থ বহু কর্মচারী ছিল।

 

প্রাদেশিক শাসন ঃ 

 গুপ্ত সাম্রাজ্যকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল। প্রদেশকে বলা হত দেশ বা ভুক্তি। ভুক্তিগুলি বিষয় বা জেলায় বিভক্ত ছিল। প্রশাসনিক বিভাগের সর্বনিম্ন ছিল গ্রাম। উপরিক ছিল প্রাদেশিক শাসক। বিষয়ের শাসক ছিল বিষয় গাত্র বা আযুক্ত। গ্রামের শাসনভার গ্রামিকের উপর থাকত। কুমারামাত্য ছিলেন প্রাদেশিক ও কেন্দ্রীয় সংযােগকারী কর্মচারী। 

 

গ্রামসভা গ্রামের শাসন ক্ষেত্রে যুক্ত থাকত। নগরের ক্ষেত্রে নিগমসভা ছিল।

 

ভূমিরাজস্ব ছিল এক ষষ্ঠাংশ থেকে এক চতুর্থাংশ পর্যন্ত। বাণিজ্য, খনি শুল্ক প্রভৃতি থেকে রাজকোষে আয় হত। কখনাে কখনাে অতিরিক্ত কর আদায় করা হত। কর্মচারীরা কর আদায়ে অত্যাচার করত না। বিচার ব্যবস্থায় বহু আইন প্রণীত হয়েছিল। দণ্ডবিধির কঠোরতা ছিল না। প্রাদেশিক শহরে বিচারালয় ছিল। গ্রামের বিচার গ্রামে হত। রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক।

গুপ্তশাসন ছিল জনকল্যাণকামী। এই শাসন ব্যবস্থার পরম্পরা পরবর্তীকালে ভারতের শাসনকার্যে প্রবাহমান ছিল।

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *