সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কি কি|Define culture? What are the characteristics of culture

 

সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও? সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য কি কি|Define culture?  What are the characteristics of culture

 

প্রশ্ন । সংস্কৃতির সংজ্ঞা দাও এবং এর বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ কর। 

 

সংস্কৃতি কাকে বলে

 

 সাধারণভাবে সংস্কৃতি বলতে আমরা বুঝি মার্জিত রুচি বা অভ্যাসজাত উৎকর্ষ। সমাজবিদ ডিউই (Dewey)-এর ভাষায়, “সংস্কৃতি এমন কিছু যা অনুশীলিত এবং পরিণত, এবং যা স্থল ও অমার্জিত অবস্থার বিপরীত”  সংস্কৃতি হল শিক্ষা ও চর্চার দ্বারা পরিশীলিত এবং মার্জিত রুচিসম্পন্ন আচার-অনুষ্ঠান।

সংস্কৃতির-সংজ্ঞা-দাও-সংস্কৃতির-বৈশিষ্ট্য-কি-কি

 

এ হলো সংস্কৃতির সংকীর্ণ অর্থ। সমাজতত্বে সংস্কৃতি কথাটিকে আরও ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। ব্যাপক অর্থে আমাদের জীবনের সব দিকগুলিই সংস্কৃতির অন্তর্ভুক্ত। টাইলার ( Tylor)-এর মতে, সমাজের সমষ্টিগত জ্ঞান, বিশ্বাস, কলা, নৈতিকতা, রীতিনীতি, আইন, মানুষের অর্জিত বিভিন্ন অভ্যাস ও দক্ষতা—সবকিছুরই জটিল মিশ্র রূপ হল সংস্কৃতি।

 

সংস্কৃতি’ শব্দটিকে বিভিন্ন সমাজতত্ত্ববিদ বিভিন্নভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে। নিম্নে কয়েকটি সংজ্ঞা তুলে ধরা হল :

 

সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত

 

সংস্কৃতির সংজ্ঞা প্রসঙ্গে মালিনাওস্কি (Malinowski) বলেছেন, “সংস্কৃতি হল মানুষের ই ও এবং একটি উপায় যার মাধ্যমে সে তার উদ্দেশ্য সাধন করে  ভিরবাটি (E. V. de-Roberty) বলেছেন, “সংস্কৃতি হল সেইসব তাত্ত্বিক ব্যবহারিক চিন্তা ও জ্ঞানের সমষ্টি যা মানুষ আয়ত্ত করে”। নর্থ (C. C. North) বলেছেন, মানুষ তার অভাব মেটাবার প্রয়ােজনে যেসব উপায় উদ্ভাবন করেছে, সেগুলিই হল সত” গ্রাহাম ওয়ালাস (Graham Wallas) বলেছেন, “সংস্কৃতি হল মানুষের চিন্তাভা, মূল্যবােধ এবং উদ্দেশ্যসমূহের সমষ্টি” (“accumulation of thoughts, values and objects.”)। তিনি আরও বলেন, এটা হল একটা সামাজিক উত্তরাধিকার (social heritage) বা মানুষ শিক্ষার মাধ্যমে তার পূর্বপুরুষের কাছ থেকে অর্জন করে।

  তবে এ জৈবিক উত্তরাধিকার নয়, যা মানুষ আপনা-আপনিই অর্জন করে। পেয়ার ( Lapiere) বলেছেন, “সংস্কৃতি হল সেইসব আচার, প্রথা, জ্ঞান ইত্যাদির সমষ্টি যা কেন সমাজের সভ্যরা বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে। ম্যাকাইভার বনে, সংস্কৃতি হল আমাদের প্রকৃতির প্রকাশ যা আমাদের জীবনধারা, চিন্তাচেতনা, কক, সাহিত্য, ধর্ম, অমােদ-প্রমােদ ইত্যাদির মধ্যে নিহিত থাকে। কোয়েনি (Knig) বলেছেন, “মানুষ সবসময়ই তার পরিবেশের সঙ্গে খাপখাওয়াতে চেষ্টা করে এবং তার জীবনধারাকে উন্নত করতে চেষ্টা করে। সংস্কৃতি হল এই প্রচেষ্টার সমষ্টি মাত্র।

 

উপরোক্ত সংজ্ঞাগুলি থেকে বােঝা যায়, সমাজতত্ত্বে সংস্কৃতি শব্দটিকে একটি বিশেষ বিশেষ অর্থে ব্যবহার করা হয়। সাধারণ মানুষ সংস্কৃতি বলতে যা বুঝে থাকে সমাজতত্ত্বে  তা ঠিক,  বােঝানো হয় না। সাধারণ মানুষ একজন শিক্ষিত মানুষকে সংস্কৃতি সম্পন্ন cultured) এবং অশিক্ষিত মানুষকে সংস্কৃতিহীন (uncultured) মানুষ বলে থাকে।কিন্তু সমাজ তত্ত্বে সংস্কৃতি বলতে অর্জিত আচরণকে বােঝায় যা সমাজের সভ্যরা অনুসরণ করে থাকে। সমাজের মানুষ বংশপরম্পরায় যা অর্জন করে তাই সংস্কৃতি। এটা একটা উত্তরাধিকার কে(heritage) বােঝায় যার মধ্যে প্রত্যেক শিশু জন্মায়। সুতরাং সমাজতত্ত্বের কোন ছাত্রের কাছে সংস্কৃতিহীন মানুষ বলে কিছু নেই। আমাদের হাঁটা, চলা, খাওয়া,কথা বলা,গান গাওয়া, নৃত্য করা এর সবই সংস্কৃতির আন্তর্ভুক্ত। সমাজের সভ্য হিসাবে  এগুলি আমরা শিখি আমাদের পিতা-মাতা, শিক্ষক, বন্ধুবান্ধব প্রভৃতির মাধ্যমে।

  বস্তুত মানুষ সামাজিক জীব হিসাবে যা কিছু চর্চা বা অনুশীলন করেছে, আয়ত্ত করেছে, শিখেছে সবই তার সংস্কৃতির অঙ্গীভূত। মানুষের সঙ্গে পশুদের প্রধান পার্থক্য হল এই যে পশুরা মানুষদের মত বংশপরম্পরায় কোন সংস্কৃতি বহন করে না। এজন্যই মানুষকে সংস্কৃতিবহনকারী প্রাণী (culture-bearing animal) বলা হয়।

 

সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য :

 

 উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কৃতির নিম্নলিখিত বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করা যেতে পারে ।

 

প্রথমত , সংস্কৃতি হল একটি অর্জিত গুণ। এটা জন্মগত বা সহজাত নয়। সংস্কৃতি হল মানুষের শিক্ষার মধ্য দিয়ে অর্জিত আচরণ।

 

দ্বিতীয়ত, সংস্কৃতি মানুষের ব্যক্তিগত নয়, সামাজিক উত্তরাধিকার (“Culture is social, not the individual heritage of man.”)। এটা সামাজিকভাবে উৎপন্ন বিষয় (social product) যার অংশীদার হল গােষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত প্রত্যেক সদস্যই।

 

তৃতীয়ত, সংস্কৃতি হল একটা আদর্শগত বিষয় (“Culture is idealistic”)। সংস্কৃতির স্থান মানুষের আদর্শে, মনে এবং  অনুসৃত নিয়মনীতিতে।

সংস্কৃতির মূল বৈশিষ্ট্য

চতুর্থত , সংস্কৃতি থেমে যায় না বা এর বিনাশ নেই। সমাজের ঐতিহ্য, প্রথা, রীতিনীতি প্রভৃতির মধ্য দিয়ে সংস্কৃতি এক পুরুষ থেকে অন্য পুরুষের মধ্যে সঞ্চালিত হয়। বস্তুতপক্ষে প্রত্যেক সমাজেই সংস্কৃতির একটি স্বতন্ত্র ধারা প্রবহমান থাকে। এই ধারা অতীত থেকে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যতের দিকে প্রবাহিত।

 

পঞ্চমত, সংস্কৃতি মানুষের প্রয়ােজন মেটায় (“Culture fulfils some needs.)। সংস্কৃতি গােষ্ঠীর সেইসব নৈতিক ও সামাজিক চাহিদা মেটায় যা ছাড়া গােষ্ঠী টিকতে পারত না।

 

যষ্ঠত , ভাষা হল সংস্কৃতির প্রধান বাহন। মানুষ শুধু বর্তমানেই আছে এমন নয়, সে অতীতেও ছিল, আবার ভবিষ্যতেও থাকবে। ভাষার মাধ্যমে মানুষ অতীতের সঞ্চিত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে আয়ত্ত করে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে সেই জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে পৌছে দেয়।

 

সপ্তমত , প্রত্যেক ব্যক্তির সত্য, সুন্দর, ন্যায়নীতি প্রভৃতি সম্পর্কে ধারণা গড়ে ওঠে তার সংস্কৃতি অনুযায়ী। ভারতীয় সমাজে আজ পর্যন্ত আধ্যাত্মিক উৎকর্ষ লাভ পরম সাধনা। পক্ষান্তরে বস্তুবাদী পাশ্চাত্য সমাজের পরম সাধনা হল ঐচ্ছিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য অর্জন। এক কথায় সংস্কৃতিই সমাজস্থ মানুষের মনােভাব, মূল্যমান, লক্ষ্য প্রভৃতি বিষয়গুলি নির্ধারণ করে দেয়।

 

অষ্টমত , ব্যক্তির আচরণ কোন্ পথে এবং কতদূর পর্যন্ত অগ্রসর হবে, কোন লক্ষ্যে গিয়ে যে পৌছাতে চায়, সংস্কৃতিই তা ঠিক করে দেয়।

 

নবমত , প্রত্যেক সমাজের সংস্কৃতি একটি স্বতন্ত্র ঐতিহ্যের সৃষ্টি করে। তার মাই মানুষের মন এই ঐতিহ্যকে বহন করে চলে। তাই কোন কোন সমাজবিজ্ঞান মতে সংস্কৃতি মূলত মানসিক বা অন্তর্মুখী বিষয়।

 

সবশেযে, সংস্কৃতি মানুষের হৃদয়বৃত্তির সঙ্গে যুক্ত। জ্ঞান মানুষের বুদ্ধিকে উন্নত করে, আর সংস্কৃতি তার হৃদয়কে গঠিত করে। সংস্কৃতির সঙ্গে সামাজিক ক্ষের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। সংস্কৃতিসম্পন্ন ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে তার সামাজিক গয়িত্ব পালন করতে পারে।

 

ব্যক্তির সংস্কৃতি সমাজের জীবনকে প্রভাবিত করে, আর ব্যক্তির জীবন সমাজের সংস্কৃতির দ্বারা প্রভাবিত হয়।

 

প্রশ্ন ) সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য নির্দেশ কর। 

উত্তর। সমাজবিজ্ঞানে সংস্কৃতি ও সভ্যতা ‘—এ দুটিকে অনেক সময় সমার্থকরূপে ব্যবহার করা হয়। কিন্তু বাস্তবিকপক্ষে এ দুটি সমার্থবােধক নয়। জার্মান দার্শনিক কান্ট (Kant)-এর মতে, সংস্কৃতি হচ্ছে মানসিক কিছু ; পক্ষান্তরে সভ্যতা হচ্ছে নিছকই বাহ্যিক ব্যাপার। পরবর্তীকালে বহু লেখক সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কণ্টকে অনুসরণ করেছেন।

 

এডওয়ার্ড টাইলার (Sil Edward Tylor)-এর মতে, “সংস্কৃতি হল মানুষের জ্ঞানবিজ্ঞান, বিশাস, কলা, নৈতিকতা, আইন, প্রথা ও সামাজিক মানুষের অর্জিত যাবতীয় মক্ষমতা ও অভ্যাস প্রভৃতির জটিল সংমিশ্রণ।” পেয়ার (Lapiere)-এর মতে, ‘সংস্কৃতি হল আচার-আচরণ, প্রথা, জ্ঞান-বিদ্যা ইত্যাদির সমষ্টি যা কোন সমাজের সভ্যরা বংশপরম্পরায় উত্তরাধিকারসূত্রে লাভ করে।”

 

অপরপক্ষে সভ্যতা বলতে বােঝায় ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ে মানব সংস্কৃতির নানারূপ কতি যেগুলি এক স্থায়ী রূপ পরিগ্রহ করে। বাটোমাের (T. B. Bottomore)-এর মতে, কতকগুলি বিশেষ মনুষ্যগােষ্ঠীর একই প্রকার প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যের সংমিশ্রণে যে সাংস্কৃতিক সমন্বয় গড়ে ওঠে তাকেই আমরা সভ্যতা বলি। যেমন আমরা পাশ্চাত্য পুজিবাদী সমাজকে একটা সভ্যতা বলে বর্ণনা করতে পারি যার অন্তর্গত বিভিন্ন সামাজিক গােষ্ঠীর মধ্যে বিশেষ একপ্রকার বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা, ধর্ম ইত্যাদির প্রচলন দেখা যায়।

 

উপরােক্ত সংজ্ঞাগুলির ভিত্তিতে সংস্কৃতি ও সভ্যতার মধ্যে নিম্নলিখিত পার্থক্যগুলি নদের্শ করতে পারি?

 

প্রথমত, ম্যাকাইভার (Maclver)-এর মতে, সংস্কৃতি হল লক্ষ্য, সভ্যতা হল সেই ল্য লাভের উপায়। তার মতে, সভ্যতা হল সংস্কৃতির যন্ত্র, শরীর বা পরিচ্ছদস্বরূপ। রাজনতি, অর্থনীতি এবং যন্ত্রশিল্পের মাধ্যমে সভ্যতার প্রকাশ ঘটে, আর সংস্কৃতির প্রকাশ বটে ল’, সাহিত্য, ধর্ম ও নৈতিকতার মধ্য দিয়ে। আমাদের সংস্কৃতি হল আমরা যা তাই, তার সভ্যতা হল আমরা যা ব্যবহার করি (“Our culture is what we are, our civilization is what we use.”) |

 

দ্বিতীয়ত, সভ্যতা পরিমাপের একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ড আছে, কিন্তু সংস্কৃতির তা নেই। সভ্যতার একটি বাস্তব প্রয়ােজনীয়তার দিক আছে যা পরিমাপ করা যায় ; অপরপক্ষে সংস্কৃতি হল অনুভূতির ব্যাপার, সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত রুচি এবং বিচার শক্তির দ্বারা এর মান লাওলের তুলনায় ট্রাক্টর বা রেডিওর তুলনায় টেলিভিশন যে অধিকতর হল এবং উপযোগী তা নিয়ে বিতর্কের কোন অবকাশ নেই। কিন্তু সংস্কৃতির বিচার হয় মনের মানসিক উৎকর্মের মানদণ্ডে। তাই সংস্কৃতির উৎকর্ষ বিচারের ক্ষেত্রে বিতর্ক দেখা যায়। বদ্রনাথ ও সেপীয়র-এর মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ তা বিতর্ক-সাপেক্ষ। 

 

তৃতীয়ত, সভ্যতা সদাই অগ্রসর হয়, কিন্তু সংস্কৃতি নয়।

 সভ্যতার বিজয়যাত্রা সুপরিকল্পিত এবং এর ক্রমােন্নতি সুনিশ্চিত। গরুর গাড়ীঘােড়ার গাড়ী→মােটর গাড়ী→রেল গাড়ী—বিমানমহাকাশযান —এইভাবে সভ্যতার নানাবিধ উপকরণের ক্রমিক অগ্রগতি লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে উত্থান-পতন ঘটে ; পৃথিবীর অনেক প্রাচীন সংস্কৃতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। অজন্তা গুহার চিত্রকলার থেকে আধুনিক চিত্রকলা যে উন্নত একথা হলফ করে বলা যায় না।

 

চতুর্থত , সভ্যতার উপাদানসমূহ বা অবদানগুলি যত সহজে আয়ত্ত করা যায়, সংস্কৃতির উপাদানসমূহ অত সহজে আয়ত্ত করা যায় না। সাধারণ লােক সামান্য কিছু শিক্ষা পেলেই আধুনিক যন্ত্রপাতির কলাকৌশল ও ব্যবহার বুঝে নিতে পারে, কিন্তু কোন লােককে খুব যত্ন সহকারে কবিতা লেখা বা ছবি আঁকা শেখালেও যে সে সেই বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করবেই তা নিশ্চিত করে বলা যায় না। 

 

পঞ্চমত , সভ্যতা ও সংস্কৃতির অনুকরণের ক্ষেত্রেও পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়। ম্যাকাইভার বলেছেন, “এক দেশের সভ্যতা আর এক দেশ অবিকৃত অবস্থায় গ্রহণ করতে পারে, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা হয় না” (“Civilization is borrowed without change or loss, but not culture.”)। রেডিও, টেলিভিশন, এক্স-রে এগুলি এখন আর কোন দেশের একচেটিয়া ব্যাপার নয়। কিন্তু সাঁওতাল পরগণার আদিবাসীদের নৃত্যগান এখনও কেবল তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। কারণ হিসাবে বলা যায়, সভ্যতার উপাদান বাহ্যিক ও বস্তুভিত্তিক, তাই একে অনায়াসেই পৃথিবীর এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে বিস্তৃত করা যায়, কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে তা হয় না। সংস্কৃতি আমাদের জীবনের সঙ্গে জড়িত। ভারতবর্ষে আমরা পাশ্চাত্য সভ্যতার অনেক কিছু আমদানি করেছি, কিন্তু পাশ্চাত্য সংস্কৃতি আমদানি করি নি বা করতে পারি নি।

 

ষষ্ঠত , সভ্যতার তুলনায় সংস্কৃতি দীর্ঘস্থায়ী। সভ্যতার উপাদানগুলির ব্যবহারিক মূল্য সাধারণত নির্দিষ্ট কালের গণ্ডিতেই আবদ্ধ থাকে। নিত্যনতুন আবিষ্কারের সঙ্গে সঙ্গে পূরনাে ব্যবহার্য দ্রব্য-সামগ্রীর মূল্য অনেকাংশ কমে যায়। সংস্কৃতির পরিবর্তন ঘটে, কিন্তু তার মধ্যে একটা কালজয়ী মূল্য থাকে। একদা মূল্যবান ফোর্ড গাড়ির বর্তমানে কোন ব্যবহারিক মূল্য নেই বললেই চলে । কিন্তু মহাকবি কালিদাসের অমর কাব্যগাথা কিংবা অজন্তাইলােরার পর্বতগুহায় অঙ্কিত চিত্র সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে আজও আমাদের কাছে সমান মূল্যবান। ;

 

সপ্তমত , সভ্যতার ক্ষেত্রে পরিণতি বা ফলাফল হল বড় কথা। কিন্তু সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কোন নির্দিষ্ট লক্ষ্য বা পরিণতির প্রশ্ন থাকে না। সংস্কৃতি নিজেই নিজের লক্ষ্য। তাই সভ্যতার ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতা যত তীব্র থাকে, সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রতিযােগিতা তত তীব্র নয়।

 

অষ্টমত , কেউ কেউ বলেন সভ্যতা কর্মোদ্যমের আর সংস্কৃতি হৃদয়বৃত্তির প্রকাশ। সভ্যতা মানুষকে কর্মোদ্যমে প্রবৃত্ত রাখে, অপরপক্ষে সংস্কৃতি হৃদয়বৃত্তির দিগন্ত প্রসারিত করে।

 

উপসংহার : সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে উপরােক্ত পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও একথা অনস্বীকার্য যে উভয়ের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিদ্যমান। চারাগাছের পুষ্টি ও বিকাশের জন্য 

যেমন উপযুক্ত মাটি, জল, বায়ু ইত্যাদির প্রয়ােজন, ঠিক তেমনি সংস্কৃতির বিকাশের জন্য অনুকূল পরিবেশ বিশেষ প্রয়ােজনীয়। আর এই পরিবেশ সৃষ্টি হয় সভ্যতার বিভিন্ন উপাদানের দ্বারা।

সংস্কৃতি ও সভ্যতা

আবার সভ্যতাও সংস্কৃতির প্রভাব থেকে মুক্ত নয়। সভ্যতার উপাদানগুলি কী উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হবে তা সংস্কৃতির উপাদানের দ্বারা নির্ণীত হয়। পরমাণুশক্তি মানুষের জীবনযাত্রার সহায়ক কাজে ব্যবহৃত হবে, না কোন ধ্বংসাত্মক কাজে ব্যবহৃত হবে তা নির্ভর করে ব্যবহারকারীর সংস্কৃতিগত বিচার-বিবেচনার ওপর।

 

সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সভ্যতা ও সংস্কৃতির মধ্যে পার্থক্য থাকলেও তাদের মধ্যে সম্পর্ক খুবই ঘনিষ্ঠ। সভ্যতার উপাদানগুলিকে উপেক্ষা করে সংস্কৃতি কখনই বিকাশলাভ করতে পারে না। চিত্রশিল্পীকে রঙ, তুলি ও অন্যান্য অত্যাধুনিক দ্রব্যসমূহ যােগান দিয়ে সাহায্য করে সভ্যতাই। কাজে-কাজেই সংস্কৃতি ও সভ্যতা যেমন সমার্থক নয়, তেমনি আবার পরস্পরবিরােধীও নয়। সভ্যতাকে সংস্কৃতির একটি দিকরূপে গণ্য করাই যুক্তিযুক্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *