ফেব্রুয়ারী বিপ্লব: ইওরোপে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লবের গুরুত্ব

ফেব্রুয়ারী বিপ্লব: ইওরোপে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লবের গুরুত্ব

প্রশ্ন । (ক) ইওরোপে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লবের গুরুত্ব নির্ণয় কর।

(খ) “১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দ বিপ্লবের বৎসর”- উক্তিটির সত্যতা ব্যাখ্যা কর।

(গ) ইওরোপের উপর ফেব্রুয়ারী-বিপ্লবের প্রতিক্রিয়া কি হইয়াছিল?

ফেব্রুয়ারী-বিপ্লব-ইওরোপে-১৮৪৮-খ্রীষ্টাব্দের-বিপ্লবের-গুরুত্ব

উত্তর।

ফেব্রুয়ারী বিপ্লব: ইওরোপের উপর ফেব্রুয়ারী-বিপ্লবের প্রভাব :

সর্বত্র স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ:

ফেব্রুয়ারী-বিপ্লবের প্রভাব এক প্রবল ঝটিকার ন্যায় সমগ্র ইওরোপ মহাদেশকে আলোড়িত করিয়া তুলিয়াছিল। কিন্তু ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লব কোন আকস্মিক ঐতিহাসিক বিস্ফোরণ ছিল না। ১৮১৫ খ্রীষ্টাব্দের পর যদিও রক্ষণশীল শক্তি ইওরোপীয় রাজনীতিতে প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, কিন্তু উদারনৈতিক ও জাতীয়তাবাদী আদর্শ সমগ্র ইওরোপে ব্যাপক বিস্তার করিতে সমর্থ হয়। তাই রক্ষণশীল ও বৈপ্লবিক শক্তি সম্পদের সংঘাত অনিবার্য হইয়া উঠিয়াছিল। ১৮৩০ খ্রীষ্টাব্দের এই সংঘাতের প্রথম প্রতিফলন দেখা যায়। কিন্তু ইহার ফলে বৈপ্লবিক শক্তির জয়লাভ সুনিশ্চিত হয় নাই। ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারী-বিপ্লবের ইঙ্গিতে সর্বত্র স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে এক ব্যাপক বিদ্রোহ’ সৃষ্টি হইল। আর একবার প্রমাণিত হইল যে, জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রের শক্তি অত্যাচারে দাবাইয়া দেওয়া যায় না। তাই ইওরোপের পনেরটি বিভিন্ন দেশে বিদ্রোহ ছড়াইয়া পড়ে।

জার্মানীর রাজ্যগুলিতে বিদ্রোহ :

জার্মানীর প্রাশিয়া, হ্যানোভার, স্যাক্সনি, ব্যাডেন, বেভেরিয়া প্রভৃতি স্থানে বিপ্লবাত্মক-বিদ্রোহ ছড়াইয়া পড়ে এবং ফ্রাঙ্কফোর্ট নামক শহরে এক বিপ্লবী পার্লামেন্ট স্থাপিত হয় এবং এই স্থান সমস্ত দেশের আন্দোলনকে জয়যুক্ত করিবার চেষ্টা চলিতে থাকে। প্রাশিয়ার রাজা ফ্রেডারিক উইলিয়াম নিজরাজ্যে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থাপন করিতে স্বীকৃত হইলেন। জার্মানীর অন্যান্য অনুরূপ ব্যবস্থা অবলম্বন করা হইল।

ইতালির রাজ্যসমূহ; উদারনৈতিক শাসনব্যবস্থা

বিপ্লবের ঢেউ ইতালিতেও পৌঁছায় এবং সিসিলি, টাস্কেনি, ন্যাপলস্, মোডেনা, পার্মা, পোপের রাজ্য প্রভৃতি স্থানে ছড়াইয়া পড়িল। প্রত্যেক স্থানের শাসকই আত্মরক্ষার্থে উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র স্থাপন করিলেন; কেহ কেহ দেশত্যাগ করিয়া আত্মরক্ষা করিলেন।

বিরাট অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিদ্রোহ:

এমন কি প্রতিক্রিয়ার কেন্দ্রভূমি, মেটারনিকের নিজের দেশ বিরাট অস্ট্রিয়া সাম্রাজ্যও বিপ্লবের আলোড়ন হইতে রক্ষা পাইল না। যে সমস্ত জাতিকে পদানত করিয়া এই সাম্রাজ্য গড়িয়া উঠিয়াছিল, তাহাদের প্রায় প্রত্যেক স্থানেই স্বাধীনতার জন্য ও গণতন্ত্রের জন্য বিদ্রোহ শুরু হইল। মিলান, ভেনিস, বোহেমিয়া, হাঙ্গেরী এবং ভিয়েনায় প্রায় একই সময়ে গণআন্দোলন শুরু হয়। ভিয়েনাতে আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়। অধ্যাপক এ. জে. পি. টেলর মনে করেন ভিয়েনার বিদ্রোহ প্রকৃত অর্থে বিপ্লবের চরিত্র ধারণ করেছিল (The revolution of March 13th in Vienna was a real revolution ) । আন্দোলনের অপর এক কেন্দ্র হইল বোহেমিয়ার রাজধানী প্রাগ— সেখানে চেক ও স্নাভ জাতিগোষ্ঠী আন্দোলনে অবতীর্ণ হইল। এছাড়া হাঙ্গেরীর প্রধান শহর বুদাপেষ্টে মাগিয়ার জাতি

স্বায়ত্তশাসন ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবীতে আন্দোলন শুরু করিল। এই আন্দোলনের নেতা ছিলেন লুই কসুখ—তিনি হাঙ্গেরীর ম্যাৎসিনী নামে পরিচিত। হাঙ্গেরীয় আন্দোলনের গণভিত্তি ছিল বিস্ময়কর। বাধ্য হইয়া অস্ট্রিয়ার সম্রাট হাঙ্গেরীয়ানদের দাবিপূরণ করিয়া লইলেন। ইহার পর হাঙ্গেরিয়ানগণ তাহাদের পরিষদে “মার্চ মাসের আইন” (March Laws) জারি করিয়া সামন্ত-প্রথা উচ্ছেদ করিল এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা ঘোষণা করিল।

মেটারনিকের পলায়ন:

বিপ্লবের প্রচণ্ড শক্তিতে ভীত হইয়া মেটারনিক দেশ ছাড়িয়া পলায়ন করিতে বাধ্য হন এবং তাহার সাথে সাথে ইওরোপে ‘মেটারনিক-ব্যবস্থা’ও ধূলিসাৎ হইল। হ্যাপস্বার্গ (Hapsburg) বংশের সম্রাট প্রথম ফার্ডিনাণ্ডকে প্রথম জোসেফের পক্ষে সিংহাসন ত্যাগ করিতে হয় এবং ভিয়েনায় একটি জাতীয় সভা আহ্বান করিতে হয়।

ইংল্যাণ্ডে প্রতিক্রিয়া :ও বিপ্লবের ফল দীর্ঘকাল স্থায়ী হয় নাই :

ইংল্যাণ্ডে এই বিপ্লবের প্রতিধ্বনি শোনা যায়। চার্টিস্ট আন্দোলন এই সময়ে তীব্র হইয়া উঠে এবং ‘ইয়ং আয়ারল্যাণ্ড’ দলের নেতৃত্বে একটি সশস্ত্র বিদ্রোহ দেখা দেয়; সুতরাং ফেব্রুয়ারী-বিপ্লবের প্রভাব কেবলমাত্র ফ্রান্সের সীমার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না। ইহা সমস্ত ইওরোপের এক বিরাট আন্দোলনে পরিণত হয়। অবশ্য এ কথা সত্য যে ইওরোপের বিভিন্ন দেশে এই বিপ্লবের ফল দীর্ঘকাল স্থায়ী নাই, কারণ অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরীতে স্বৈরাচারী শক্তি শেষ পর্যন্ত জয়লাভ করে এবং ইতালিতেও বিপ্লবীগণ পরাজিত হয়। প্রাশিয়া ও জার্মানীর অপরাপর রাজগণও আস্তে আস্তে উদারনৈতিক ব্যবস্থা নাকচ করিয়া দেয়।

১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লবের গুরুত্ব:

গুরুত্ব : গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদের মোট সাফল্যের দিক হইতে বিচার করিলে ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লব খুবই কার্যকর হইয়াছিল বলা যায় না। কিন্তু এই বিপ্লবের গুরুত্ব কোন প্রকারেই হ্রাসপ্রাপ্ত হয় নাই। (১) এই বিপ্লবের ফলে ‘মেটারনিক-ব্যবস্থার’, অর্থাৎ মেটারনিকের নেতৃত্বে ইওরোপীয় কনসার্ট কর্তৃক জাতীয়তাবাদ ও গণতন্ত্রবাদ দমনের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যবস্থার সম্পূর্ণ পতন ঘটিল।
(২) ভিয়েনা-চুক্তিকে কার্যকর করিবার এবং প্রাক্-বিপ্লব যুগের রাজনৈতিক কাঠামোকে পুনরুজ্জীবিত করিবার চেষ্টাও সম্পূর্ণভাবে বিফল হইল। বরং জার্মানী ও ইতালিতে এক গভীর জাতীয়তাবোধের সৃষ্টি হইল।
(৩) তাছাড়া এই বিপ্লবের পর ফ্রান্সে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার স্বীকৃত হইল। ইহার প্রভাব ক্রমে সমগ্র ইওরোপে বিস্তার লাভ করে।
(৪) এই বিপ্লবের ফলে জার্মানী, অস্ট্রিয়া ও হাঙ্গেরীর কৃষকগণ ভূমিদাসত্ব হইতে মুক্তিলাভ করিয়াছিল। স্বৈরাচারী শাসন পুনঃস্থাপিত হওয়ার পরও কৃষকদের এই স্বাধীনতা বিনষ্ট হয় নাই।
(৫) সর্বোপরি এই বিপ্লবের সময়েই সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্থাপনের প্রকৃত চেষ্টা হয়। পরবর্তী যুগে এই সমাজতান্ত্রিক প্রভাব সর্বত্র ছড়াইয়া পড়িয়াছিল। তাই আপাত ব্যর্থতা সত্বেও ১৮৪৮ খ্রীষ্টাব্দের বিপ্লবকে ইওরোপের বৈপ্লবিক বলিষ্ঠ পদক্ষেপরূপে গণ্য করা যায়। জনগণ এই আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *