গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ: গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন
গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ: গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন
প্রশ্ন । গুপ্তযুগের সংস্কৃতির প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহ বর্ণনা কর ।
অথবা,
গুপ্তযুগ ভারতের ইতিহাসে কি একটি “সুবর্ণ যুগ” ?
অথবা,
গুপ্তযুগকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের সুবর্ণ যুগ বলা হয় কেন ?
সংক্ষিপ্ত প্রশ্ন । গুপ্তযুগের ভাস্কর্য সম্বন্ধে কি জান ?
গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ: উত্তর । সভ্যতা ও সংস্কৃতির দিক দিয়া গুপ্ত শাসনকাল ছিল ভারত-ইতিহাসের এক গৌরবজনক যুগ । কেবলমাত্র রাজনৈতিক ঐক্য সৃষ্টি ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনই এই যুগের বৈশিষ্ট্য ছিল না । শিল্প, সাহিত্য, বিজ্ঞান সর্বক্ষেত্রে এক অভূতপূর্ব অগ্রগতি এই যুগকে মহিমান্বিত করিয়া তুলিয়াছিল ৷ গুপ্তযুগে সভ্যতার এই অপূর্ব বিকাশ যে ঘটিয়াছিল তাহার কতকগুলি কারণ আছে।
দীর্ঘদিন রাজনীতিগত ভাবে ভারত বিচ্ছিন্ন থাকিবার পর গুপ্তসম্রাটগণের নেতৃত্বে উত্তর ভারতের এক বিরাট অংশে রাজনৈতিক ঐক্য সাধিত হইয়াছিল। সেই ঐক্য প্রায় দুই শতাব্দী কাল বজায় ছিল। কেবলমাত্র এক বিস্তৃত সাম্রাজ্যই যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল তাহা নহে, সমগ্র দেশে এক সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা দেশবাসীর সুখ ও সমৃদ্ধির পথ উন্মুক্ত করিয়া দিয়াছিল ।
সমগ্র দেশে শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধি পাইল, দেশ-বিদেশে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার হইল, কৃষ্টিগত যোগাযোগ ব্যবসা-বাণিজ্য দেশ-বিদেশের সৃষ্টি হইল । সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিল শিল্প ও সাহিত্যের অপূর্ব বিকাশ, সহিত যোগাযোগ সভ্যতা বিকাশের কারণ রাজনৈতিক ঐক্য ও সুষ্ঠু শাসন জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি। সর্বত্র ভারতীয় মনীষার এক চরম অভিব্যক্তি এই যুগকে উজ্জ্বল ও মহান করিয়া তুলিল ।
গুপ্ত যুগকে সুবর্ণ যুগ: গুপ্তযুগের সংস্কৃতির প্রকৃতি :
গুপ্তযুগে ভারতের অভাবনীয় সাংস্কৃতিক অগ্রগতির চরিত্র সম্পর্কে দুইটি ভ্রান্ত ধারণা প্রচলিত আছে। প্রথমত, জার্মান ভারততত্ত্ববিদ্ ম্যাক্সমূলার গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক অগ্রগতিকে হিন্দুধর্মের নবজাগরণের যুগ (Hindu renaissanee) বলিয়া চিহ্নিত করিয়াছেন । কিন্তু এই মত গ্রহণযোগ্য নয়, কারণ গুপ্ত পূর্ববর্তী কোন সময়ই, যথা মৌর্যযুগ ও কুষাণ রাজত্বকালে হিন্দুধর্ম ও সংস্কৃতির অগ্রগতি ব্যাহত হয় নাই এবং বিবর্তনের স্রোত রুদ্ধ হইয়া যায় নাই । দ্বিতীয়ত, ডঃ স্মিথ প্রমুখ ঐতিহাসিকদের মতে গুপ্তযুগে সংস্কৃতির উৎকর্ষের মূলে ছিল বৈদেশিক প্রভাব । কিন্তু বৈদেশিক সংযোগের ফলেই গুপ্ত সংস্কৃতির বিকাশ হইয়াছিল তাহা বলা যায় না । গুপ্তযুগের সংস্কৃতি ক্ষেত্রে কিছুটা বৈদেশিক প্রভাব থাকিলেও, ইহার অন্তর্নিহিত অনুপ্রেরণা ছিল ভারতীয় । বস্তুতঃপক্ষে, গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক বিকাশ ছিল ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রবহমান গতিধারার চরম ফলশ্রুতি।
সাহিত্য ও সংস্কৃত ভাষা :
গুপ্তযুগ অনবদ্য সাহিত্যসৃষ্টি এবং সংস্কৃত ভাষার উৎকর্ষের জন্য সুবিখ্যাত । কেহ কেহ মনে করিয়াছেন যে, গুপ্তযুগে সংস্কৃত ভাষার পুনরভ্যুদয় ঘটিয়াছিল । কিন্তু ঐতিহাসিকগণ- এ কথা সত্য বলিয়া মনে করেন নাই। কারণ গুপ্তযুগের পূর্বে কোন সময়েই সংস্কৃত ভাষা বিস্মৃত বা অবহেলিত হয় নাই ।
বরং পূর্ব হইতেই সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্য ধীরে ধীরে পূর্ণতা ও বিস্তার লাভ করিতেছিল ।তবে গুপ্তসম্রাটগণের পৃষ্ঠপোষকতায় এবং দেশের অনুকূল আবহাওয়ায় এই ভাষার এক অভাবনীয় উন্নতি সাধিত হইয়াছিল মাত্র। এই যুগের অধিকাংশ শিলালিপি ও সাহিত্য সংস্কৃত ভাষাতেই রচিত হইয়াছিল । এইযুগে মহাভারত ও পুরাণগুলির সম্পাদনার বিশাল কর্মকাণ্ড সম্পন্ন হয়।
একথা সত্য, সুদূর অতীত হইতেই মহাভারতের কাহিনী প্রচলিত ছিল। কিন্তু গুপ্তযুগে ‘মহাভারত’, পুরাণগুলির সম্পাদনা এমনভাবে করা হয় যে তা এক সম্পূর্ণ নতুন সাহিত্যের রূপ লয় । হিন্দু সম্প্রদায়ের কাছে মহাভারতের গুরুত্ব অপরিসীম। কারণ তাহা হইল ভারতবাসীর জাতীয় ঐতিহ্য, ধর্ম, রাজনৈতিক ও নৈতিক বোধের ধনভাণ্ডার।
কেন এসময়ে মহাভারত ও পুরাণগুলি সম্পাদনা করা হয় তাহা লইয়া মতভেদ আছে। যতদূর মনে হয় ভারতীয় জীবন হইতে কুষাণ, গ্রীক, প্রহ্লব প্রভৃতি বিদেশী জাতিগুলির প্রভাব দূর করিবার জন্য এই প্রচেষ্টা লওয়া হইয়াছিল ।
বহুসংখ্যক খ্যাতনামা সাহিত্যিক তাঁহাদের সাহিত্যসাধনার দ্বারা এই যুগকে সমৃদ্ধ করিয়াছেন। কালিদাস-রচিত শকুন্তলা, মেঘদূত, কুমারসম্ভব প্রভৃতি নাটক বিশ্বসাহিত্যের অমূল্য সম্পদ ; মৃচ্ছকটিকম্ প্রণেতা শূদ্রক, মুদ্রারাক্ষস প্রণেতা বিশাখদত্ত, বৌদ্ধ দার্শনিক ও গ্রন্থকার বসুবন্ধু, এলাহাবাদ-প্রশস্তির রচয়িতা হরিষেন প্রভৃতি মনীষীগণ এই যুগকে সাহিত্যসম্ভারে সমৃদ্ধ করিয়াছিলেন।
শিল্পকলা ও ভাস্কর্য :
শিল্পকলা ও ভাস্কর্যের এক অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হইয়াছিল গুপ্তযুগে। এই যুগের শিল্পকলার বহু শ্রেষ্ঠ নিদর্শন মুসলিম আক্রমণের সময় বিধ্বস্ত হইয়া যায়। সেইজন্যই স্থাপত্য-শিল্পের বিস্তৃত বিবরণের অভাব আছে।
যে সব নিদর্শন স্থাপত্য-শিল্প পাওয়া গিয়াছে তাহার মধ্যে উত্তরপ্রদেশের অন্তর্গত দেওঘরে অবস্থিত একটি প্রস্তর-নির্মিত মন্দির এবং কানপুরে অবস্থিত একটি ইষ্টক-নির্মিত মন্দির এই যুগের স্থাপত্য-শিল্পের চমৎকার নিদর্শন। সারনাথে আবিষ্কৃত একটি প্রস্তর-নির্মিত মন্দির গুপ্তযুগের স্থাপত্য-শিল্পের উৎকর্ষের পরিচয় দেয়।
ভাস্কর্য ভাস্কর্যের ক্ষেত্রেও এক অভাবনীয় উন্নতি পরিলক্ষিত হয় । ধর্মসম্বন্ধীয় ঘটনাসমূহকে আশ্রয় করিয়া, বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মের নীতি ও আদর্শকে অনুসরণ করিয়া গুপ্তযুগের ভাস্কর্য-শিল্পীগণ তাঁহাদের শিল্পকুশলতার পরিচয় দান করিয়াছেন ।
সারনাথ ও মথুরায় প্রাপ্ত দেব-দেবীর মূর্তিগুলির সূক্ষ্ম কারুকার্য, সাবলীল অঙ্গবিন্যাস ও নিখুঁত সম্পাদন সত্যই প্রশংসনীয়। ভারতের কতকগুলি শ্রেষ্ঠ শিব-মূর্তি গুপ্তযুগেই নির্মিত হইয়াছিল । পৌরাণিক আখ্যান ও উপাখ্যান অনুসারে রাম, কৃষ্ণ, বিষ্ণু, শিব প্রভৃতি দেবতার মূর্তি গঠন এই যুগের ভাস্কর্যশিল্পের বিষয়বস্তু ।
চিত্র-শিল্পে অজন্তা অজন্তা চিত্র গুপ্তযুগে চিত্রশিল্পেরও যে অপূর্ব বিকাশ হইয়াছিল অজন্তার গুহাচিত্রগুলিই তাহার প্রকৃষ্ট প্রমাণ । পাহাড় কাটিয়া গুহা-মন্দির নির্মাণ ও মন্দিরের দেওয়াল-গাত্রে অপূর্ব চিত্র অঙ্কন’ গুপ্তযুগের চিত্রশিল্পের চরম উৎকর্ষের পরিচায়ক ।
অজন্তা র বিস্ময়কর গুহাচিত্রগুলির অধিকাংশই এই যুগের সৃষ্টি এবং ইওরোপীয় • প্রত্নতত্ববিদদের মতে এই চিত্রগুলি রেনেসাঁস যুগের ইওরোপের শ্রেষ্ঠ প্রাচীর চিত্রগুলির সমতুল । গুহাচিত্রগুলি বাস্তবতায় পরিপূর্ণ এবং এগুলিতে সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায় । ধাতব শিল্পেও গুপ্তযুগ যে উন্নতি লাভ করিয়াছিল তাহাও অসামান্য।
দিল্লীর নিকটে চন্দ্ররাজ্যের লৌহস্তম্ভ ও উহার কারুকার্য আজও দর্শকদের বিস্ময়ের ধাতুশিল্প, বিভিন্ন মূর্তি বস্তু । নালান্দায় প্রাপ্ত বুদ্ধদেবের একটি তাম্রমূর্তি ও অসংখ্য মুদ্রা এ ও অসংখ্য মুদ্রা যুগের ধাতুশিল্পের উন্নতির সাক্ষ্য বহন করে।
বিজ্ঞানক্ষেত্রে :
জ্যোতিষ, গণিত, রসায়ন প্রভৃতি জ্ঞান-বিজ্ঞানের ক্ষেত্রেও গুপ্তযুগে অভূতপূর্ব উন্নতি দেখা গিয়াছিল। আর্যভট্ট ছিলেন ঐ যুগের শ্রেষ্ঠ গণিতশাস্ত্রবিদ্, বরাহমিহির ছিলেন শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিদ্ । ভারতীয় বৈজ্ঞানিকগণ গ্রীক ও রোমান জ্ঞান-বিজ্ঞানের সহিত পরিচিত ছিলেন । চিকিৎসাশাস্ত্রে গুপ্তযুগ পশ্চাৎপদ ছিল না । সম্ভবত শল্যচিকিৎসাও সে সময়ে প্রচলিত ছিল এবং শল্য-চিকিৎসক শুশ্রুত যতদূর সম্ভব গুপ্তযুগেই জন্মলাভ করিয়াছিলেন ।
গুপ্তযুগের সহিত অন্যান্য সভ্যতার তুলনা : গুপ্তযুগের সর্বাঙ্গীণ উন্নতি লক্ষ্য করিয়া অনেক ঐতিহাসিক এই যুগকে গ্রীসের পেরিক্লিসের যুগের সহিত তুলনা করিয়াছেন । ঐতিহাসিক বার্নেট তাঁহাদের মধ্যে অন্যতম।
পেরিক্লিসের সময়েও এথেন্সের সাম্রাজ্য বহুদূর বিস্তৃত হইয়াছিল ; দেশের শক্তি ও সমৃদ্ধি বৃদ্ধি পাইয়াছিল ; সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অভূতপূর্ব উন্নতি সাধিত হইয়াছিল । এই যুগ ছিল গ্রীক ইতিহাসের সুবর্ণযুগ । এইজন্যই গুপ্তযুগের সহিত অনেকে এই যুগকে ইংল্যাণ্ডের রাণী এলিজাবেথের যুগের সহিত তুলনা করেন। এই সময়ে ইংল্যাণ্ডে যে সমস্ত খ্যাতনামা বিশ্ববিশ্রুত সাহিত্যিকদের আবির্ভাব হইয়াছিল তাহা গুপ্তযুগের কথা স্মরণ করাইয়া দেয়। ইংল্যাণ্ডে এলিজাবেথের যুগ
সুবর্ণ যুগ—একটি ঐতিহাসিক ভ্রম ?
প্রচলিত ধারণায় গুপ্তযুগ প্রাচীন ভারতের ইতিহাসের চরম পর্যায় বা সুবর্ণযুগ রূপে অভিহিত । কিন্তু এই ধারণা সর্বতোভাবে সত্য কিনা এই বিষয়ে ঐতিহাসিক মহলে বিভিন্ন মতামত দেখা যায়। গুপ্তযুগের সাংস্কৃতিক উৎকর্ষ অভাবনীয় ছিল সত্য, কিন্তু সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারায় কিছু কিছু নেতিবাচক দিক দেখা যায় ।
সমাজব্যবস্থায় বর্ণভেদের কঠোরতা যথেষ্ট বৃদ্ধি পায়, নারীদের মর্যাদা হ্রাস ‘পাইয়াছিল এবং ভূমিদাস-প্রথার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। অর্থনীতিক্ষেত্রে বাণিজ্যিক বিকাশ ব্যাহত হইয়াছিল । তাই গুপ্তযুগকে সুবর্ণযুগ বলা সম্পূর্ণ সঠিক নয়। –