পরিবেশ দূষণ রচনা পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ রচনা: পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ রচনা: পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
পরিবেশ দূষণ
পরিবেশ দূষণ ও তার প্রতিকার
ভূমিকা ঃ লক্ষ লক্ষ বছর আগে পৃথিবীর বুকে যে প্রাণ ও প্রাণীর সৃষ্টি হয়েছিল সেদিন প্রকৃতি ও পরিবেশ এক সাম্য ছিল। এই ভারসাম্য বজায় রাখতে প্রধান ভূমিকা ছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের। সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের পথ ধরে মানুষ যেমন তিল তিল করে পরিবেশের তিলোত্তমা গড়ে তুলেছিল আজ সেই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট হতে বসেছে, দুষিত পরিবেশের প্রভাবে।
পৃথিবীর কঠিন অসুখ এখন, ‘হিংসায় উন্মত্ত পৃথ্বী’। এখন নিষ্ঠুর পৃথিবীতে বিঘ্নিত হতে চলেছে সুন্দরের আরাধনা। আলোর পাখিরা ভুলে যায় গান; সুন্দর ফিরে যায় লজ্জায় অপমানে। কবি জীবনানন্দের ভাষায় বলা যায়, ‘এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ নয়।’ এই দূষিত পরিবেশে গোটা জীবজগতের অস্তিত্বই আজ বিপন্ন।
পরিবেশ দূষণের কারণ ঃ
নানা কারণে বিশ্বের পরিবেশ ক্রমশঃ দূষিত হয়ে পড়ছে। আবহাওয়া, নদী, সমুদ্রের জল এবং পৃথিবীর উপরিভাগে প্রবাহিত নানা প্রকার বায়বীয় পদার্থকে নিয়ে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ, সভ্যতার অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে সেই পরিবেশ দূষিতকরণের ব্যাপকতা জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জল মাটি বায়ুর উপর পড়েছে প্রচণ্ড চাপ। শুরু হয়েছে বনসম্পদ ধ্বংসের অমিত উল্লাস।
একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে উদ্ভিদ জগৎ ও প্রাণীজগৎ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা। শক্তি উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গেই তা আক্রমণ করছে মানুষের স্বাস্থ্য-সম্পদকে। রাসায়নিক দ্রব্যই মানুষের নানাবিধ দুরারোগ্য ব্যাধির দ্রুত প্রসারণের কারণ। এর ফলে বায়ু, জল, খাদ্যদ্রব্য সমস্তই বিশুদ্ধতার অভাবে মারাত্মকভাবে দূষিত হয়ে পড়ছে। বাষ্পশক্তি ও বিদ্যুৎশক্তি উৎপাদনের মূলে রয়েছে যে দহন তা অক্সিজেনের অনুপাত হ্রাস করে শ্বাসরোধী বিষ-নিঃশ্বাসে বায়ুমণ্ডলকে করে তোলে প্রাণঘাতী। তারপর এলো পারমাণবিক যুগ। কাঠ, কয়লা এবং তৈল দহনের ফলে বায়ুমণ্ডল যে পরিমাণে দূষিত হয়, পারমাণবিক দহনের ফলে দূষণের পরিমাণ তার অপেক্ষা লক্ষ গুণ বেশী। মানুষ, জীবজন্তু, উদ্ভিদের সুস্থ অস্তিত্বও বিপন্ন হয়ে পড়ল।
পরিবেশ দূষণ রচনা: পরিবেশ দূষণের শ্রেণী ঃ
আমাদের পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলো মোটামুটি দু’ভাগে বিভক্ত। এক-প্রাকৃতিক, দুই-কৃত্রিম। প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে আছে, সীসে, পারদ, সালফার ডাইঅক্সাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড ইত্যাদি। এর মধ্যে কতকগুলো আবার আমাদের মল-মূত্র, শরীরের পচন থেকে উৎপন্ন। আর কৃত্রিম-দূষকের অন্তর্গত হল নানা কীটনাশক পদার্থ, গুঁড়ো সাবান, ঔষধপত্র ও প্রসাধন সামগ্রী এমন কি প্লাসটিকও। এ সব ‘যৌগ’ এর আমাদের পরিবেশে টিকে থাকার অদ্ভূত ক্ষমতা আছে। ফলে পরিবেশ বিজ্ঞানীদের সব থেকে দুশ্চিন্তা এদের নিয়েই।
দূষকের প্রকৃতি ও পদ্ধতি :
দুষকের প্রকৃতি ও পদ্ধতির মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। এর মধ্যে বায়ু দূষণ, জল দূষণ, শব্দ দূষণ, তেজষ্ক্রিয় দূষণ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার হলো বায়ু। সেই বায়ু দূষণ আজ সারা বিশ্বজুড়ে। সকলের স্বাস্থ্যের পক্ষেও এ এক গুরুতর সমস্যা। বাতাসে কার্বন-ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিয়ত বাড়ছে। এর ফলে আবহাওয়ায় তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। তেল, কয়লা, দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি। মানুষের শ্বাসযন্ত্র ও স্নায়ুযন্ত্রের উপর এর মারাত্মক ক্ষতিকারক ক্ষমতা আছে।
পরিবেশ দূষণ রচনা
জল দূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর নদ-নদী, পুকুর, খালবিল ইত্যাদির জল নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হাইড্রোকার্বন, প্রেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয়তা, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গম নালী বেয়ে আসা দূষিত তরল, আবর্জনা, এগুলোই হল জল দূষণের প্রধান কারণ। তা ছাড়া নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বহু শিল্পনগরী। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চটকল, কাপড়ের কল, কয়লা-ধোলাই কল, চিনি কল, কাগজের কল, ভেষজ তেল তৈরীর কারখানা, চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। এই সব কল-কারখানার বর্জ পদার্থ প্রতিনিয়ত নদনদীর জলকে দূষিত করছে। তাছাড়া পুকুর, খাল বিল ইত্যাদি দূষণের জন্যে, নালা নর্দমা, ঘরবাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এর থেকেই দূষিত হয় মাটি, দূষিত হয় পানীয় জল আর ছড়িয়ে পড়ে নানারকম সংক্রামক রোগ।
শব্দদূষণ এ যুগের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরেই শব্দদূষণের মাত্রা সবচেয়ে বেশী। প্রতিনিয়তই মিটিং, মিছিল, শ্লোগান, যন্ত্রচালিত গাড়ি, গাড়ির হর্ন, কল কারখানার বিকট আওয়াজ, বাজি পটকার শব্দ, মাইকের চড়া সুর, উৎসবের মত্ততা প্রভৃতির শব্দে কেঁপে উঠছে পৃথিবীর নাদ ব্রহ্ম। তার ফল হচ্ছে মারাত্মক ও ভয়াবহ। শব্দদূষণের ফলে দুরকম সমস্যার সৃষ্টি হয়।
প্রথমতঃ দেখা দেয় শ্রবণঘটিত সমস্যা। মানুষের শ্রবণ ইন্দ্রিয়ের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় । দেখা দেয় বধিরতা। আর অন্তঃকর্ণের অভ্যন্তরে অবস্থিত স্নায়ুকোষগুলিও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এর ফলে বধিরতা হয় চিরস্থায়ী এবং বধিরতা থেকে আসতে পারে অস্থিরতা, উন্মত্ততা।
দ্বিতীয়তঃ শ্রবণবহির্ভূত সমস্যা। এগুলি বিভিন্ন ধরনের। যেমন—মানুষের রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনিদ্রা রোগের শিকার হয়। হৃদস্পন্দন বাড়ে। শ্বাসক্রিয়ার হারও বাড়তে থাকে। মনোযোগ নষ্ট হয়, দৃষ্টিশক্তি ক্ষীণ হয়। হজমের গোলমাল পর্যন্ত দেখা দিতে পারে। শব্দের ২০ থেকে ৪০ ডেসিবেল পর্যন্ত হল স্বাভাবিক। তবে সেখানে শহরাঞ্চালে ৬০/৬৫ ডেসিবেলের শব্দের পরিমাণ প্রায়ই লক্ষ্য করা যায়। মহামান্য আদালত এজন্য শহরাঞ্চলে ও গ্রামাঞ্চলে পৃথক পৃথক শব্দের মাত্রা নির্ধারণের আদেশ দিয়েছেন।
বিশেষ করে ঘনজনবসতি এলাকায় হাসপাতাল ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অঞ্চলে সতর্ক থাকার কথা বলেছেন। এ ছাড়া কত প্রাবল্যের শব্দ কতক্ষণ ধরে মানুষ সহ্য করতে পারে এ ব্যাপারে আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল ষ্ট্যান্ডার্স অর্গানাইজেশন (ISO) কিছু নিয়ম জারি করেছেন। সাধারণতঃ বিভিন্ন ডেসিবল এককে মানুষ ২ ঘন্টা থেকে সর্বোচ্চ ৮ ঘন্টা পর্যন্ত এই শব্দমাত্রার চাপ সহ্য করতে পারেন।
আর সর্বাপেক্ষা তেজস্ক্রিয় দূষণের দ্বারা মানুষ ব্যাপকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয়। পারমাণবিক যুদ্ধ ও পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণের বিপদ সবচেয়ে বেশি। তবে কলকারখানা বা খনি অঞ্চলে গ্যাস লিকের ফলে শ্বাসরোধ হয়ে বহু মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে । উদাহরণ স্বরূপ বলা যায় ১৯৮৪ সালের ডিসেম্বরে মধ্যপ্রদেশের ভূপালে এই গ্যাস লিক জনিত দুর্ঘটনায় প্রায় আড়াই হাজার মানুষ মৃত্যু বরণ করে।
দূষণের প্রতিকার :
দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ আতঙ্কিত। এর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া খুব সহজসাধ্য ব্যাপার নয়। তাই এর প্রতিকারের জন্য নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। সেজন্যে আবহাওয়া-দূষণ সম্পর্কে মানব জাতিকে সচেতন করার উদ্দেশ্যে প্রতিবছর ৫ই জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ রূপে পালিত হয়।
আজ আর আবহাওয়া দূষণ নয়, চাই তার বিশুদ্ধীকরণ। তাই আজ অরণ্যসংহার নয়—প্রতিটি মানুষের জন্য চাই আনুপাতিক হারে অরণ্য সৃষ্টি। চেষ্টা চলছে দহনে উৎপন্ন গ্যাসে অতিরিক্ত কোন পদার্থ মিশিয়ে দেওয়ার যাতে তা নির্গত হওয়ার আগেই কোন কোন দূষক অপসারিত হতে পারে আর দূষিত জলকে পানযোগ্য করে তোলার উপযুক্ত পরিশ্রাবণ ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। শহরের মানুষকে বায়ু দূষণের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য পুরানো গাড়িগুলির পরীক্ষা করার ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণ
শব্দদূষণের কুপ্রভাব কমানোর জন্য শব্দ-নিরোধী ব্যবস্থার কথা গুরুত্বসহকারে ভাবা দরকার। এই সমস্ত ব্যাপারে আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যাকে কাজে লাগিয়ে বায়ুমণ্ডলের তেজস্ক্রিয়তা নষ্ট করার উপায় উদ্ভাবন করা অত্যন্ত জরুরী। এ না করতে পারলে শুরু হয়ে যাবে প্রকৃতির প্রতিশোধ গ্রহণের পালা।