বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা-Teacj Sanjib
বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা-Teacj Sanjib
বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্র
প্রশ্ন ১। ‘বঙ্কিমচন্দ্রই বাংলা উপন্যাসের প্রকৃত স্রষ্টা।’—প্রাক্ বঙ্কিমযুগের উপন্যাস রচনার প্রয়াসের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রধান প্রধান উপন্যাসগুলি আলোচনার মাধ্যমে মন্তব্যটির যৌক্তিকতা বিচার কর।
বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা- (১৮৩৮-৯৪)
উত্তর। (একের প্রশ্নের প্রথম অংশের উত্তরের জন্য ‘বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব শীর্ষক আলোচনাটি দেখ।)
বাংলা উপন্যাস সাহিত্য
বাংলা উপন্যাসের উদ্ভব :
বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে উপন্যাস সাহিত্যের জন্ম। উপন্যাস একটি আধুনিক কলারূপ (art form)। মানব চেতনাকে যুগোচিত ব্যাপ্তি ও গভীরতার সঙ্গে অন্বিত করার স্বতঃস্ফূর্ত প্রেরণা থেকেই এই কলাঙ্গিকের উদ্ভব। সমালোচক Ralph Fox তাঁর ‘The Novel and the people’
গ্রন্থে বলেছেন, “The novel
is not merely fictional prose, it is the prose of man’s life, the first art to take the whole man and give him expression.” এই অর্থে পূর্ণাবয়ব মানবজীবনকে কাহিনী-বদ্ধ করার প্রেরণা থেকে স্বত-উদ্ভূত শিল্পরূপ হচ্ছে উপন্যাস। উপন্যাসের সব লক্ষণের মধ্যে প্রধান হচ্ছে ছটি বৈশিষ্ট্য—–—(১) কাহিনী, (২) চরিত্র, (৩) মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব, (৪) বাস্তবতা ও স্থানীয় পরিবেশ, (৫) সংলাপ, (৬) উপন্যাসিকের জীবনদর্শন।
উপন্যাস সাহিত্যের এই উপাদানগুলির বিচারে বাংলা গদ্যের ক্রমবিকাশে প্যারীচাঁদ মিত্র সর্বপ্রথম কাহিনী গ্রন্থনে খানিকটা কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন। অবশ্য তাঁর পূর্বে ১৮৫২ সালে কলিকাতা ক্রিশ্চিয়ান ট্র্যাক্ট অ্যাণ্ড বুক সোসাইটির উদ্যোগে হানা ক্যাথেরীন মুলেন্স নামে উক্ত মিশনের এক ক্রিশ্চিয়ান বিদেশিনী উত্তমরূপে বাংলা শিখে খ্রীষ্টানদের জন্য তাদের সমাজের ঘটনা অবলম্বনে ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণ’ নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেন। প্যারীচাঁদের সাহিত্য ক্ষেত্রে অবতীর্ণ হবার কয়েক বছর আগেই ‘ফুলমণির বিবরণ’ প্রকাশিত হয়। সমালোচকেরা এই গ্রন্থটিকেই উপন্যাস সাহিত্যের সূচনা বলে চিহ্নিত করতে চান। কিন্তু ‘ফুলমণি ও করুণার বিবরণে’ প্রথম পূর্ণাঙ্গ কাহিনীর স্ফূরণ হলেও তার শিল্প লক্ষণ নামমাত্র; তাই প্যারীচাঁদ মিত্রের ‘আলালের ঘরের দুলাল ই প্রথম বাংলা উপন্যাসের শিরোপা ধারণ করে আছে। তাছাড়া ‘ফুলমণি মুলেন্সের মৌলিক রচনাও নয়, ‘The last day of the week’ নামে ইংরেজী আখ্যানের মর্মানুবাদ।
সরস কৌতুকের ভাষায় এবং তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ শক্তির সাহায্যে বাঙালীর সমসাময়িক বাস্তব জীবনকে যথাযথভাবে চিত্রিত করেছেন বলেই প্যারীচাঁদ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে নিঃসন্দেহে অগ্রাধিকার পেয়ে থাকবেন। সুতরাং ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়কেই আমরা যথার্থ উপন্যাস সৃষ্টির সূচনা বলে ধরে নিতে পারি। কারণ আমরা দেখব ১৮৭২ সালে বঙ্কিমের ‘বঙ্গ দর্শন’ পত্রিকা প্রকাশিত হবার পর থেকেই সমগ্র বাঙালী সমাজ আত্মদর্শনের বীজমন্ত্র খুঁজে পেয়েছিল। আর যথার্থ উপন্যাস সৃষ্টির ইতিহাসের শুরু তখন থেকেই।
বাংলা উপন্যাসে বঙ্কিমচন্দ্র (১৮৩৮-৯৪)
বঙ্কিমচন্দ্র প্রথম জীবনে কাব্যচর্চার মধ্য দিয়ে সাহিত্য-সাধনা শুরু করলেও তিনি খুব অল্প সময়ের মধ্যে তাঁর প্রতিভার উপযুক্ত ক্ষেত্র খুঁজে পেলেন। তিনি প্রথম ইংরেজীতে উপন্যাস লিখলেন ‘রাজমোহনস ওয়াইফ’ নামে (১৮৫৯-৬০)। উপন্যাসটি ১৮৬৪ খ্রীষ্টাব্দে ইণ্ডিয়ান ফীলড নামক পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়। পরবর্তী ক্ষেত্রে ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে তাঁর প্রথম বাংলা উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয়। কিন্তু তাঁর পূর্বে ভূদেব মুখোপাধ্যায়ের
ইতিহাস আশ্রিত উপন্যাস ‘অঙ্গুরীয় বিনিময়’ ১৮৫৬ খ্রীষ্টাব্দে প্রকাশিত হয়। অনেকে মনে করেন এই রচনাটি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘দুর্গেশনন্দিনী’ রচনার পথনির্দেশ করেছিল। এ ছাড়া সংস্কৃত আখ্যায়িকার সঙ্গে বাংলা দেশের উপকথা মিশিয়ে উপন্যাস লিখতে চেষ্টা করেছিলেন গোপীমোহন গোষ। তাঁর ‘বিজয়বল্লভ’ (১৮৬৩) বিদ্যাসাগরী রীতিতে রচিত। ঘটনা সংস্থানের দিক দিয়ে বইটি উপন্যাসের পর্যায়ে খানিকটা উঠেছে।
সে যাই হোক, বঙ্কিমচন্দ্রই যে বাংলা উপন্যাসের প্রথম সার্থক স্রষ্টা সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র সংশয়ের অবকাশ নেই। পাশ্চাত্য উপন্যাস ও রোমান্স প্রভাবে বঙ্কিমচন্দ্র সর্বপ্রথম নানা ধরনের বাংলা উপন্যাসের রস সৃষ্টিতে কৃতকার্য হন। বঙ্কিমচন্দ্র জীবিতকালে শেষ বাইশ বছরের মধ্যে (১৮৬৫-১৮৮৭) মোট চোদ্দখানি উপন্যাস লিখেছিলেন। আগেই বলেছি তাঁর প্রথম উপন্যাস ‘দুর্গেশনন্দিনী’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৬৫ খ্রীষ্টাব্দে। তাঁর শেষ উপন্যাস ‘সীতারাম’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৮৮৭ খ্রীষ্টাব্দে। তাঁর উপন্যাসগুলি মোটামুটি ভাবে নিম্নলিখিত ক’টি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়—
বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা-
(১) সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যা নিয়ে রচিত সামাজিক উপন্যাস
—‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮), ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘রাধারাণী’ (১৮৮৬)।
(২) ইতিহাস এবং রোমান্স আশ্রয়ী উপন্যাস—
‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪), ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২) ও ‘সীতারাম’ (১৮৮৭)।
(৩) তত্ত্বমূলক ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস
—‘দেবীচৌধুরাণী’ (১৮৮৫), ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮৪)। বঙ্কিমচন্দ্র ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে যে উপন্যাসগুলি রচনা করেছেন তার অধিকাংশের মধ্যে ঐতিহাসকি আবহাওয়া থাকলেও কল্পনার স্ফূরণও কম ঘটে নি। যেমন ‘দুর্গেশনন্দিনী’তে বিমলাআয়েষা-তিলোত্তমা ; ‘কপালকুণ্ডলায় কপালকুণ্ডলা-মতিবিবি-নবকুমার; ‘মৃণালিনী’তে হেমচন্দ্ৰমৃণালিনী-পশুপতি-মনোরমা; ‘চন্দ্রশেখরে’ চন্দ্রশেখর-প্রতাপ-শৈবলিনী এবং ‘সীতারামে’ শ্রীর চরিত্র ও ঘটনা—অধিকাংশই কাল্পনিক। এখানে ইতিহাসের পটে অনৈতিহাসিক মানুষের কথা প্রাধান্য পেয়েছে। যদিও উপন্যাসগুলিতে পাঠান-মোঘল বাদশাহী আমল ও তুর্কী অভিযানের প্রাসঙ্গিকতা আছে তবুও ইতিহাসের সঙ্গে রোমান্স ও কল্পনার খাদ মিশিয়ে যে উপন্যাসগুলি রচিত হয়েছে, সেগুলিকে বিশুদ্ধ ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা না গেলেও সেগুলি যে শিল্পোৎকর্ষ লাভ করেছে এ সম্পর্কে কোন সন্দেহই নাই।
উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা
‘দুর্গেশনন্দিনী’ বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম উপন্যাস হিসাবে স্বাভাবিকভাবেই কিছু ত্রুটিযুক্ত। এতে উপন্যাসের চেয়ে রোমান্সের রস বেশী, চরিত্রের দ্বন্দ্বের চেয়ে কাহিনীবয়নের গুরুত্ব অধিক। ‘কপালকুণ্ডলা’ একখানি অনবদ্য গ্রন্থ। এতেও রোমান্সের লক্ষণ প্রবল। কিন্তু তা ছাপিয়ে উঠেছে মানব প্রকৃতির গূঢ় রহস্য এবং নিয়তিতাড়িত মানব ভাগ্যের নিদারুণ পরিণাম, আর সে পরিণাম বর্ণিত হয়েছে কখনও কাব্যময় গীতিরসোচ্ছ্বাসের দ্বারা, কখনও সূক্ষ্ম মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্বের দ্বারা, কখনও বা নাটকীয় চমৎকারিত্বের সাহায্যে। প্রকৃতি-দুহিতা কপালকুণ্ডলার জীবননাট্যের ক্রমপরিণতি অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিস্ফুট হয়েছে।
‘মৃণালিনী’ বাংলায় মুসলমান অভিযানের পটভূমিকায় উপস্থাপিত কাল্পনিক কাহিনী। হেমচন্দ্ৰ ও মৃণালিনীর প্রেমের কাহিনী এতে প্রাধান্য পেলেও মনোরমা ও পশুপতির কাহিনীগ্রন্থনে লেখক
অধিকতর নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন। তবে বঙ্কিমের কবি-স্বপ্ন এখানে দুর্বার হয়েছে, তাই গঠনে এসেছে শিথিলতা। উপন্যাসদেহে বঙ্কিম এখানেই প্রথম উৎকৃষ্ট গান ও ছড়ার ব্যবহার করেছেন। ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ হিন্দু আমলে স্থাপিত একটি প্রেমের রোমান্টিক বড় গল্প। ১২৮০ সালের বঙ্গ দর্শন বৈশাখ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।
‘চন্দ্রশেখর’, মীরকাশিম ও ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর দ্বন্দ্বের পটভূমিকায় স্থাপিত হলেও ‘চন্দ্রশেখরে’র মূল কাহিনী সম্পূর্ণ কাল্পনিক। প্রতাপ-শৈবলিনীর আকর্ষণ এবং শৈবলিনীর স্বামী চন্দ্রশেখরের আদর্শ চরিত্র এর প্রধান বক্তব্য। কিন্তু এখানে শৈবলিনীর মধ্যে নারীর স্বয়ংক্রিয় বিদ্রোহী ব্যক্তিত্ব প্রথম উপন্যাসোচিত রূপ লাভ করেছে। ‘চন্দ্রশেখরে’ যে জীবন সমস্যা দেখানো হয়েছে তার ভিত্তি শিক্ষিত নারীর স্বাতন্ত্র্য-কামনার বিষ-জ্বালার মধ্যে। রেনেসাঁস যুগের বাংলার সাহিত্যে ও সমাজে তার যুগপৎ ঐতিহাসিক প্রতিষ্ঠা।
‘রাজসিংহ’ বঙ্কিমের রচিত সার্থক ঐতিহাসিক উপন্যাস—এই উপন্যাসের কেবল আকৃতি নয়, উদ্দেশ্যও ঐতিহাসিক। চতুর্থ সংস্করণ রাজসিংহের বিজ্ঞাপনে বঙ্কিম লিখেছিলেন—“আমি পূর্বে কখনও ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখি নাই। দুর্গেশনন্দিনী বা চন্দ্রশেখর বা সীতারামকে ঐতিহাসিক উপন্যাস বলা যাইতে পারে না। এই প্রথম ঐতিহাসিক উপন্যাস লিখিলাম।” রাজস্থানের চঞ্চলকুমারীকে ঔরংজীবের বিবাহের ইচ্ছা এবং তা থেকে রাণা রাজসিংহের সঙ্গে ঔরংজীবের বিরোধ, সেই বিরোধে রাজসিংহের জয়লাভ ও চঞ্চলকুমারীর সঙ্গে বিবাহ—এই হল মূল ঘটনা, এবং এ ঘটনা ইতিহাস অনুমোদিত। কিন্তু এর সঙ্গে তিনি আবার জেবুন্নিসামবারক-দরিয়া বিবির একটি কাল্পনিক উপকাহিনীও সংযোজন করেছেন, যা ইতিহাসের বাঁধা পথে না গিয়েও রসোপলব্ধিতে কোনরূপ অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নি।
‘সীতারাম’ তাঁর সর্বশেষ উপন্যাস। এতে সামান্য ঐতিহাসিক কাহিনী ও পটভূমিকা থাকলেও ঐতিহাসিক চরিত্রে কল্পনার বড় বেশী অতিশয্য দেখা যায়। এখানে রূপের মোহের প্রতি চরিত্রবান পুরুষের আকর্ষণ-জনিত নাটকীয়তা উপস্থাপিত হয়েছে।
বাংলা উপন্যাস এবং বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়
এরপর বঙ্কিমচন্দ্রের সামাজিক উপন্যাসগুলির আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মন্তব্য উদ্ধারযোগ্য—“এর পূর্বে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখনী থেকে দুর্গেশনন্দিনী, কপালকুণ্ডলা, মৃণালিনী লেখা হয়েছিল। কিন্তু সেগুলি কাহিনী। ইংরেজীতে যাকে বলে রোমান্স। আমাদের প্রতিদিনের জীবনযাত্রা থেকে দূরে এদের ভূমিকা। সেই দূরত্বই এদের মুখ্য উপকরণ।…বিষবৃক্ষে কাহিনী এসে পৌঁছাল আখ্যানে। যে পরিচয় নিয়ে সে এল তা আছে আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে।” ‘বিষবৃক্ষ’, ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’, ‘রজনী’ এই তিনখানি উপন্যাসের মূল কথা, আদিম সম্পর্কের জটিলতা। চিত্ত সংযমের অনিচ্ছা বা অক্ষমতা থেকে স্ত্রী-পুরুষের শোচনীয় পরিণাম বর্ণনার জন্যই বঙ্কিমচন্দ্র প্রায় সমসাময়িক পারিবারিক জীবনের ওপর ভিত্তি করে এই তিনখানি উপন্যাসের পরিকল্পনা করেছিলেন।
‘ইন্দিরা’ লঘু চালের সরস গল্প। একটি বিবাহিতা বালিকা শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পথে দস্যু বিড়ম্বিত হয়ে অনেকদিন পরে আবার স্বামী এবং শ্বশুর ঘরের অধিকার ফিরে পেয়েছিল— ইন্দিরার গল্প বিষয় এটুকুই। ডঃ সুকুমার সেন বলেছেন—“ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমার্দ্ধে সুপরিচিত ‘মন্মথকাব্য’ প্রভৃতি আদিরসাল আখ্যায়িকার নায়িকার মত ইন্দিরাও হারানো স্বামীকে খুঁজিতে বাহির হইয়াছে এবং স্বামীকে হস্তগত করিবার জন্য যাবতীয় নারীকলার প্রয়োগ করিয়াছে।” তা হলেও ইন্দিরার গল্পে আদি-রসিকতা কোথাও প্রবল হতে পারে নি।
আনন্দমঠ’ ও ‘দেবীচৌধুরাণী’ উপন্যাস
‘আনন্দমঠ’ ও ‘দেবীচৌধুরাণী’ উপন্যাস দুটি প্রচারধর্মী বা তত্ত্বমূলক রচনা বলে আখ্যাত। ‘আনন্দমঠ’ উপন্যাস নয়—বাঙালীর রচিত স্বপ্ন-কবিতা। তাই বঙ্কিমচন্দ্রের এই উপন্যাসটিকে বলা হয় দেশাত্মবোধের মহাকাব্য। ডঃ অসিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতে—‘এর অগ্নিগর্ভ স্বদেশপ্রেম ও রক্তাক্ত আত্মোৎসর্গ সন্ত্রাসবাদের যুগে বিপ্লবীদের মনে উদ্দীপনা ও হাতে আগ্নেয়াস্ জুগিয়েছিল, আর ‘বন্দেমাতরম’ তো পরবর্তী কালে সমরসঙ্গীতে পরিণত হয়েছিল।” ঘনতম। বঙ্কিমচন্দ্র জনকল্যাণের
বাংলা উপন্যাসের বিকাশের ক্ষেত্রে বঙ্কিমচন্দ্রের ভূমিকা-Teacj Sanjib
‘দেবীচৌধুরাণী’র মধ্যে ব্যক্তিত্বের মানস-সম্ভাবনা ছিল সুবৃহৎ জীবন-বেদীতে দেবীচৌধুরাণীকে প্রতিষ্ঠিত করে আহ্বান করেছেন—“এখন এসো, প্রফুল্ল! একবার লোকালয়ে দাঁড়াও — আমরা তোমায় দেখি। একবার এই সমাজের সম্মুখে দাঁড়াইয়া বল দেখি,—আমি নূতন নহি, আমি পুরাতন। আমি সেই বাক্যমাত্র….। – “পরিত্রাণায় সাধুনাং বিনাশায় চ দুষ্কৃতাম্ ধর্ম সংস্থাপনার্থায় সম্ভবামি যুগে যুগে।”
এ বাক্য পুরাতন—কিন্তু নতুন করে—নূতন মূল্যে উচ্চারিত হয়েছে, রেনেসাঁসের যন্ত্রণাপীড়িত জীবন-ভূমিতে।
ও বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস সাহিত্যের সামগ্রিক আলোচনায় এটাই প্রতীয়মান হয় যে, নীতি আদর্শের প্রতি পক্ষপাত সত্ত্বেও মানব জীবনের অতল অপার রহস্যের প্রতি বঙ্কিমচন্দ্রের শেক্সপীয়রের মতোই সুগভীর অন্তর্দৃষ্টি ছিল, নরনারীর জীবনের বৃহৎ স্বরূপ সম্বন্ধে তিনি সর্বদাই অবহিত ছিলেন। সর্বোপরি বিশেষ দেশকালের পটভূমিকায় বিশেষ দেশকালের নরনারীর চরিত্র আঁকলেও তিনি তারই মধ্য দিয়ে সর্বকালের মানুষের ছবি এঁকেছেন।