বচনের বিরোধিতা সম্পর্কে আলোচনা কর-Teacj Sanjib
বচনের বিরোধিতা সম্পর্কে আলোচনা কর-Teacj Sanjib
বচনের বিরোধিতা বা বিরূপতা
(Opposition of Proposition)
ভূমিকা, বচনের বিরোধিতা, বিরোধিতার শর্ত, প্রকারভেদ। বিভিন্ন প্রকার বিরোধিতার আলোচনা। বিরোধ চতুষ্কোণ, বিরোধানুমান ও বিরোধানুমানের প্রকারভেদ। নির্দেশিকা।
বচনের বিরোধিতা বড় প্রশ্ন
* ভূমিকা : জ্ঞাত সত্যের ভিত্তিতে অজ্ঞাত সত্যে উপনীত হওয়ার প্রক্রিয়াকে অনুমান বলে। অনুমানের ভাষায় প্রকাশিত রূপকে বলে যুক্তি। প্রচলিত যুক্তিবিজ্ঞানে (Traditional Logic এই পার্থক্য উপেক্ষা করা হয়। অনুমানকেই যুক্তি বলা হয়।
অবরোহ যুক্তি বা অনুমান দু-প্রকার : অমাধ্যম অনুমান ও মাধ্যম অনুমান। মাধ্যম অনুমানে দুই বা ততোধিক আশ্রয়বাক্য থেকে সিদ্ধান্ত নিঃসৃত করা হয়। অমাধ্যম অনুমানে একটি আশ্রয়বাক৷ থেকে সিদ্ধান্ত নিঃসৃত করা হয়। অমাধ্যম যুক্তি প্রধানত তিন প্রকার : আবর্তন, বিবর্তন ও সমবিবর্তন। আবর্তন ও বিবর্তন দুটি মৌলিক প্রক্রিয়া। বিবর্তন ও আবর্তনের যুগ্ম প্রয়োগের ফলে সমবিবর্তন হয়। সুতরাং, সমবিবর্তন মৌলিক অনুমান প্রক্রিয়া নয়।
নিরপেক্ষ বচন চার প্রকার : A, E, I, O ; নিরপেক্ষ বচন চারটির মধ্যে বিভিন্ন প্রকার সম্বন্ধ থাকতে পারে। এই সম্বন্ধকে যৌক্তিক সম্বন্ধ (Logical relation) বলে। বচন চারটির পারস্পরিক যৌক্তিক সম্বন্ধের ভিত্তিতে বিভিন্ন অনুমান গঠন করা যায়। এই অনুমান প্রক্রিয়ায় প্রদত্ত বচনের সত্যমূল্য থেকে অন্য বচনটির সত্যমূল্য সম্পর্কে অনুমান করা যায়। অর্থাৎ প্রদত্ত বচনের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব থেকে নির্ণেয় বচনের সত্যতা বা মিথ্যাত্ব সম্পর্কে অনুমান করা যায়) যৌক্তিক সম্বন্ধের (Logical relation) অপর নাম বিরোধিতার সম্বন্ধ (Relation of Opposition)। বিরূপতা ও বিরোধিতা সমার্থক শব্দ।
বচনের বিরোধিতা কাকে বলে
বচনের বিরোধিতা বলতে কী বোঝায়?
(What is Opposition of Proposition ?) বচনের বিরোধিতার শর্তগুলি কী কী? (What are the conditions of Opposition of Propositions ?) *
উত্তর ঃ একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়যুক্ত দুটি নিরপেক্ষ বচনের মধ্যে যদি গুণের পার্থক্য থাকে অথবা পরিমাণের পার্থক্য থাকে অথবা গুণ এবং পরিমাণ উভয়ের পার্থক্য থাকে, তবে বচন দুটির পারস্পরিক সম্বন্ধকে বচনের বিরোধিতা (opposition of proposition) বা বিরূপতা বলে। এই সম্বন্ধের ভিত্তিতে একটি বচনের সত্যমূল্য থেকে অন্য বচনের সত্যমূল্য অনুমান করা যায়।
যেমন :
E-কোনো মানুষ নয় পূর্ণ সত্তা – প্রদত্ত, সত্য
A – সকল মানুষ হয় পূর্ণ সত্তা – মিথ্যা – –
উল্লিখিত যুক্তিতে নিরপেক্ষ বচন দুটির উদ্দেশ্য ও বিধেয় পদ এক। বচন দুটির পরিমাণের পার্থক্য নেই। উভয় বচনই সার্বিক। কিন্তু গুণের পার্থক্য আছে। একটি নঞর্থক, অন্যটি সদর্থক। বচন দুটির মধ্যে বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ আছে। এই সম্বন্ধের ভিত্তিতে প্রদত্ত বচনের সত্যতা থেকে নির্ণেয় বচনের মিথ্যাত্ব অনুমান করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়যুক্ত দুটি নিরপেক্ষ বচন নিম্নলিখিত শর্তে পরস্পরবিরোধী হতে পারে, অর্থাৎ তাদের মধ্যে বিরোধিতার সম্পর্ক থাকতে পারে :
বচনের বিরোধিতা শর্ত গুলি কি কি
বিরোধিতার শর্ত (Conditions of Opposition of Proposition) :
(১) বিরোধিতা দুটি নিরপেক্ষ বচনের মধ্যে থাকে। (২) বচন দুটির উদ্দেশ্যপদ ও বিধেয়পদ এক হবে।
(৩) বচন দুটির মধ্যে কেবল গুণের পার্থক্য থাকতে পারে। অথবা,
৪) বচন দুটির মধ্যে কেবল পরিমাণের পার্থক্য থাকতে পারে। অথবা,
(৫) বচন দুটির মধ্যে গুণ ও পরিমাণ উভয়ের পার্থক্য থাকতে পারে।
বচনের বিরোধিতা কয় প্রকার
* বিরোধিতার প্রকারগুলি কী কী?
(What are the different kinds of Opposition of Propositions ?) + উত্তর : বচনের বিরোধিতা চার প্রকার, যথা :
(১) বিপরীত বিরোধিতা (Contrary opposition)।
(২) অধীন বিপরীত বিরোধিতা (Sub-contrary opposition)।
(৩) অসম বিরোধিতা (Subaltern opposition)।
(৪) বিরুদ্ধ বিরোধিতা (Contradictory opposition)।
(১) বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ থাকে A এবং E
(২) অধীন বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ থাকে I এবং O
(৩) অসম বিরোধিতা সম্বন্ধ থাকে A এবং I, ও E এবং O –
(৪) বিরুদ্ধ বিরোধিতা সম্বন্ধ থাকে A এবং O ও E এবং I
বচনের বিপরীত বিরোধিতা
বচনের বিপরীত বিরোধিতা কী?
বচনের মধ্যে। – বচনের মধ্যে। বচনের মধ্যে। বচনের মধ্যে।
(What is contrary Opposition ? )
☼ উত্তর : একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়বিশিষ্ট দুটি সার্বিক বচনের মধ্যে যদি কেবল গুণের পার্থক্য থাকে তবে বচন দুটির পারস্পরিক সম্বন্ধকে বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ বলে। এই সম্বন্ধে যুক্ত বচন দুটি হল পরস্পর বিপরীত।
A এবং E – বচনের মধ্যে বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ আছে। –
আক্ষরিক দৃষ্টান্ত :
A – সকল S হয় P
E- কোনো S নয় P
মূর্ত দৃষ্টান্ত :
A সকল মানুষ হয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব।
E – কোনো মানুষ নয় বুদ্ধিবৃত্তিসম্পন্ন জীব।
বৈশিষ্ট্য ঃ এই ক্ষেত্রে বচন দুটির উদ্দেশ্যপদ ও বিধেয়পদ এক। উভয় বচন সার্বিক কিন্তু এদুটির মধ্যে গুণের পার্থক্য আছে। প্রথমটি সদর্থক, দ্বিতীয়টি নঞর্থক।
বচনের অধীন বিপরীত বিরোধিতা
বচনের অধীন বিপরীত বিরোধিতা কী?
(What is sub-contrary opposition?)
☼ উত্তর : একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়বিশিষ্ট দুটি বিশেষ বচনের মধ্যে কেবল যদি গুণের পার্থক্য থাকে তবে বচন দুটির পারস্পরিক সম্পর্ককে অধীন বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ বলে। এই সম্বন্ধে যুক্ত বচন দুটি পরস্পরের অধীন বিপরীত। I এবং O-বচনের মধ্যে অধীন বিপরীত বিরোধিতা সম্বন্ধ আছে।
আক্ষরিক দৃষ্টান্ত ঃ
I – কোনো কোনো S হয় P
O- কোনো কোনো S নয় P
মূর্ত দৃষ্টান্ত :
I – কোনো কোনো ফুল হয় লাল বস্তু।
O – কোনো কোনো ফুল নয় লাল বস্তু।
বৈশিষ্ট্যঃ
(১) বচন দুটির উদ্দেশ্য ও বিধেয় পদ অভিন্ন।
(২) উভয় বচন বিশেষ।
(৩) বচন দুটির মধ্যে গুণের পার্থক্য আছে। একটি সদর্থক, অন্যটি নঞর্থক।
বচনের বিরুদ্ধ বিরোধিতা
বিরুদ্ধ বিরোধিতা কী?
(What is contradictory opposition ?)
উত্তর ঃ একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়বিশিষ্ট দুটি নিরপেক্ষ বচন যদি গুণ ও পরিমাণ উভয় দিক থেকে ভিন্ন হয় তবে বচন দুটির পারস্পরিক সম্বন্ধকে বিরুদ্ধ বিরোধিতা সম্বন্ধ বলে। এই সম্বন্ধে যুক্ত বচন দুটি পরস্পর বিরুদ্ধ। বিরুদ্ধ বিরোধিতা সম্বন্ধ (Contradictory relation) A ও O এবং E ও I-বচনের মধ্যে থাকে।
আক্ষরিক দৃষ্টান্ত :
(i) A – সকল S হয় P
O- কোনো কোনো S নয় P
(ii) E- কোনো S নয় P
I – কোনো কোনো S হয় P
মূর্ত দৃষ্টান্ত ঃ
(i) A সকল ঘোড়া হয় চতুষ্পদ জীব
O-কোনো কোনো ঘোড়া নয় চতুষ্পদ জীব
(Ii)E- কোনো ঘোড়া নয় চতুষ্পদ জীব
I – কোনো কোনো ঘোড়া হয় চতুষ্পদ জীব
বৈশিষ্ট্য ঃ
(১) নিরপেক্ষ বচন দুটির উদ্দেশ্যপদ ও বিধেয়পদ অভিন্ন হবে।
(২) বচন দুটির মধ্যে গুণের পার্থক্য থাকবে। একটি সদর্থক হলে অন্যটি নঞর্থক হবে। অথবা, একটি নঞর্থক হলে, অন্যটি সদর্থক হবে।
(৩) বচন দুটির মধ্যে পরিমাণের পার্থক্য থাকবে। একটি সার্বিক হলে অন্যটি বিশেষ হবে। অথবা একটি বিশেষ হলে, অন্যটি সার্বিক হবে।
বচনের অসম বিরোধিতা
বচনের অসম বিরোধিতা কী?
(What is subaltern opposition?)
* উত্তর : একই উদ্দেশ্য ও বিধেয়বিশিষ্ট দুটি নিরপেক্ষ বচনের মধ্যে যদি কেবল পরিমাণের পার্থক্য থাকে, গুণের পার্থক্য না থাকে, তবে বচন দুটির পারস্পরিক সম্বন্ধকে অসম বিরোধিতা সম্বন্ধ (Subaltern relation) বলে। এই সম্বন্ধে যুক্ত বচন দুটি পরস্পর অসম A এবং I, E এবং O – এগুলি পরস্পর অসম।
আক্ষরিক দৃষ্টান্ত :
(i) A – সকল S হয় P
I কোনো কোনো S হয় P
(ii) E – কোনো S নয় P –
O – কোনো কোনো S নয় P –
মূর্ত দৃষ্টান্ত :
(i) A- সকল মানুষ হয় মরণশীল জীব।
I – কোনো কোনো মানুষ হয় মরণশীল জীব।
(ii) E- কোনো মানুষ নয় অমর সত্ত্বা। E
O-কোনো কোনো মানুষ নয় অমর সত্ত্বা।
বৈশিষ্ট্য ঃ
(১) নিরপেক্ষ বচন দুটির উদ্দেশ্যপদ ও বিধেয়পদ অভিন্ন হবে।
(২) বচন দুটির গুণ অভিন্ন হবে। অর্থাৎ উভয় বচন হয় সদর্থক হবে, অথবা, উভয় নঞর্থক হবে।
(৩) বচন দুটির পরিমাণ ভিন্ন হবে। একটি সার্বিক হলে অন্যটি বিশেষ হবে অথবা, একা বিশেষ হলে অন্যটি সার্বিক হবে।
(৪) এই সম্বন্ধ A ও I এবং E ও O – – বচনের মধ্যে থাকে।
অসম বিরোধিতাকে কী প্রকৃত বিরোধিতা
অসম বিরোধিতাকে কী প্রকৃত বিরোধিতা বলা যায়? (Is Subaltern a real Opposition ? )
* উত্তর ঃ প্রশ্নটিকে কেন্দ্র করে যুক্তিবিদদের মধ্যে মতপার্থক্য আছে। গ্রিক দার্শনিক অ্যারিস বলেন, অসম বিরোধিতাকে প্রকৃত বিরোধিতা বলা যায় না। তাঁর মতে, যে দুটি বচনের মা যথার্থ বিরোধিতা থাকে, সেই দুটি বচন একই সঙ্গে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না। বিরোধি এই শর্তটি অসম বিরোধিতার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কারণ, অসম বিরোধিতা সম্বন্ধে যুক্ত বচন একই সঙ্গে সত্য বা একই সঙ্গে মিথ্যা হতে পারে। যেমন –
A সকল মানুষ হয় মরণশীল জীব। – সত্য।
I – কোনো কোনো মানুষ হয় মরণশীল জীব। সত্য।
A এবং I বচনের সম্বন্ধ অসম বিরোধিতা। এই ক্ষেত্রে উভয় বচনই সত্য। আবার,
I – কোনো কোনো মানুষ হয় পূর্ণ সত্ত্বা। – মিথ্যা।
A – সকল মানুষ হয় পূর্ণ সত্ত্বা। মিথ্যা। –
– এই ক্ষেত্রে উভয় বচনই মিথ্যা। আবার উভয় বচনই সদর্থক। সুতরাং, বচন দুটির (A – I) মধ্যে প্রকৃত কোনো বিরোধ নেই।
আবার,
E-কোনো মানুষ নয় পূর্ণ সত্ত্বা। -সত্য।
O কোনো কোনো মানুষ নয় পূর্ণ সত্ত্বা। — সত্য। – –
এই ক্ষেত্রে উভয় বচনই সত্য। বচন দুটি নঞর্থক। সুতরাং, বচন দুটির মধ্যে প্রকৃত কোনো বিরোধিতা নেই। এই কারণে Aristotle তাঁর বিরোধ চতুষ্কোণে অসম বিরোধিতাকে উল্লেখ করেন নি। অ্যারিষ্টটলের বিরোধ চতুষ্কোণ থেকে দেখা যায় তিনি কেবলমাত্র বিপরীত বিরোধিতা (Contrary opposition) এবং বিরুদ্ধ বিরোধিতা (Contradictory opposition) এই দুটিকে প্রকৃত বিরোধিতা বলেছেন। –
অ্যারিষ্টটলের মতবাদ বিরোধিতা সম্পর্কে লৌকিক মতবাদের অনুরূপ। লৌকিক অর্থে বিরোধিতা হল অসংগতি। দুটি বচনের মধ্যে এই সম্বন্ধ থাকলে তারা কখনও একই সঙ্গে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে না। যেসব তর্কবিদ বিরোধিতা পদের লৌকিক অর্থ গ্রহণ করেন তারা অসম বিরোধিতাকে প্রকৃত বিরোধিতা বলে মনে করেন না। তাঁরা বলেন, দুটি বিরোধী বচন কখনও এক সঙ্গে সত্য হতে পারে না। যেহেতু অসম বিরোধিতা সম্বন্ধে যুক্ত দুটি বচন একই সঙ্গে সত্য বা মিথ্যা হতে পারে, সেহেতু এই সম্বন্ধকে প্রকৃত বিরোধিতা সম্বন্ধ বলে তাঁরা স্বীকার করেন না।
বচনের বিরোধিতা
তবে প্রচলিত বা গতানুগতিক যুক্তিবিদ্যায় অসম বিরোধিতাকে প্রকৃত বিরোধিতা বলা হয়েছে। বিরোধিতাকে সত্য-মিথ্যার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়নি। বিরোধিতাকে একটি বিশেষ অর্থে গ্রহণ করা হয়েছে। এই অর্থে দুটি অভিন্ন উদ্দেশ্য ও বিধেয়বিশিষ্ট নিরপেক্ষ বচনের মধ্যে যেকোনো রকম পার্থক্যকেই বিরোধিতা বলা যায়। এই অর্থে গুণগত পার্থক্যও বিরোধিতা, আবার পরিমাণগত পার্থক্যও বিরোধিতা। অসম বিরোধিতার ক্ষেত্রে গুণগত পার্থক্য না থাকলেও দুটি বচনের মধ্যে পরিমাণগত পার্থক্য আছে। সুতরাং, অসম বিরোধিতাকে প্রকৃত বিরোধিতা বলা যায়।