এশিয়া আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন : teacj sanjib

 এশিয়া আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন : teacj sanjib

এশিয়া আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন

এশিয়া-আফ্রিকার-জাতীয়-মুক্তি-আন্দোলন-teacj-sanjib

 

লক্ষ্য ঃ এশিয়া ও আফ্রিকা দুই মহাদেশের বিশাল ভূখণ্ড দীর্ঘকাল ধরে ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে ছিল। বিদেশি শাসনের অত্যাচার, ঔপনিবেশিক শোষণের শৃঙ্খল থেকে নিজেদের সম্পূর্ণরূপে মুক্ত করার জন্য এশিয়া ও আফ্রিকার পরাধীন রাষ্ট্রসমূহের জনগণ বিদেশি শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনে লিপ্ত হয়। একেই জাতীয় মুক্তি আন্দোলন বলা হয়। এই মুক্তি আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক শৃঙ্খল থেকে দেশকে মুক্ত করা। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে ষাটের দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত এই আন্দোলনের উদ্ভব ও বিকাশ। 

 এই কালপর্বে এশিয়া ও আফ্রিকার প্রায় ৪০টি রাষ্ট্র ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনতা থেকে মুক্তি লাভ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, ইটালি, সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রভৃতি ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ঐক্যের অভাব, পরস্পরের মধ্যে বিরোধিতা এবং যুদ্ধে বিপুল পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলিকে দুর্বল করে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতি এশিয়া ও আফ্রিকার স্বাধীনতাকামী জনগণকে উৎসাহিত করেছিল মুক্তি আন্দোলনকে তীব্রতর করে তুলতে। এর ফলে এই গণ আন্দোলনের জোয়ারে বিদেশি শাসন পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে।

এশিয়া আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি  আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য:

বৈশিষ্ট্য ঃ এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারা বিশ্লেষণ করলে কয়েকটি বৈশিষ্ট্য পরিলক্ষিত হয়। প্রথমত, এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন দীর্ঘকাল ধরে চলেছিল। ফলে দীর্ঘ সংগ্রামের ধারার মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এশিয়া ও আফ্রিকার জনগণ বিভিন্ন ভাষাগত, সাংস্কৃতিক, ধর্মীয়, সামাজিক ভাবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে বিভক্ত। ফলে জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে সংহতি ও সমন্বয়ের অভাব ছিল। তবে সব জাতিগোষ্ঠীর লক্ষ্য ছিল ঔপনিবেশিক শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করা। তৃতীয়ত, এই জাতীয় আন্দোলনের প্রথম পর্বে শহরাঞ্চলের উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে কেন্দ্রীভূত ছিল। 

 একই শ্রেণির জনগণ পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, ইউরোপীয় উদারনীতি, জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, স্বাধীনতা প্রভৃতি ভাবধারায় আলোকপ্রাপ্ত হয়েছিল। এদের মধ্যেই প্রথম সংহত প্রতিবাদের ভাষা উচ্চারিত হয়েছিল। চতুর্থত, এশিয়া ও আফ্রিকায় জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রথম পর্বে শহরাঞ্চলে সীমিত থাকলেও পরবর্তী পর্বে দেশের সমস্ত প্রান্তে, গ্রামাঞ্চলে এই আন্দোলন পরিব্যপ্তি হয়েছিল। ফলে এই আন্দোলন একটি গণচরিত্র লাভ করে। পঞ্চমত, এই জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের পদ্ধতি সর্বত্র এক ছিল না। কোথাও অহিংস নীতি আবার কোথাও সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা সমানভাবে ক্রিয়াশীল ছিল। 

এশিয়া ও আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারা পর্যালোচনা করলে তিনটি পর্যায় দেখা যায়। প্রথম পর্বে এই আন্দোলনে কোনো সাংগঠনিক রূপ ছিল না। দ্বিতীয় পর্যায়ে সাংগঠনিক চরিত্র লাভ করে। তৃতীয় পর্যায়ে সমগ্র দেশের আপামর জনগণের মধ্যে এই আন্দোলন প্রসারিত হয়।

এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকদের পতনের কারণ:

 

এশিয়া ও আফ্রিকায় ঔপনিবেশিকদের পতনের প্রধান কারণগুলি হল—(১) দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানির হাতে ইঙ্গ-ফরাসীদের বিপর্যয় এশিয়াবাসীদের উদ্বুদ্ধ করেছিল। (২) ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও আমেরিকা বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি ও জাপানকে পরাজিত করলেও, তাদের গৌরব ম্লান হয়েছিল (৩) জাপান দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া থেকে ইংরেজ, ফরাসি ও ওলন্দাজদের বিতাড়িত করায় এশিয়ার পরাধীন জাতিগুলির মনে মুক্তি আশার সঞ্চার হয়। (৪) বিশ্বযুদ্ধে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স দুর্বল হয়ে পড়েছিল।

 

এশিয়ার মুক্তি আন্দোলন ঃ 

 

 দক্ষিণ এশিয়া এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মধ্যে ভারত, সিংহল, ব্রহ্মদেশ, ইন্দোচিন, ইন্দোনেশিয়া প্রভৃতি দেশ অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, পর্তুগাল, হল্যান্ড, প্রভৃতি ইউরোপীয় শক্তি দখল করে রেখেছিল। কালক্রমে এই সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলির শোষণ, শাসন ও অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত হয়ে এইসব পরাধীন দেশে জাতীয়তাবাদের উন্মেষ হয় এবং দেশবাসী ঔপনিবেশিক শাসনের বন্ধন থেকে মুক্তির তীব্র সংগ্রামে লিপ্ত হয়। অবশেষে স্বাধীনতা লাভ করে।

 

দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার পাঁচটি অঞ্চল কম্বোডিয়া, লাওস, আনাম, কোচিন-চিন ও টংকিং একত্রে ইন্দোচিন নামে পরিচিত। ওই অঞ্চলগুলি ফরাসিদের অধীনে ছিল। প্রায় সত্তর বছর পর ফরাসিদের কবল থেকে মুক্তি লাভ করে।

 

ভিয়েতনাম ঃ 

 

 ১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স ইন্দোচিন দখল করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ কালে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার লাভের আশায় ইন্দোচিনের জনগণ ফ্রান্সকে সাহায্য করেছিল। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের আশা বিনষ্ট হয়। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে হো-চি-মিন ভিয়েতনামের কমিউনিস্ট দল গঠন করে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চালাতে থাকে। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে জাপান ইন্দোচিন দখল করে। হো-চিমিন ‘ভিয়েতমিন’ দল গঠন করে জাপানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর হো-চি-মিন টংকিং-এর রাজধানী হ্যানয় দখল করে এবং ভিয়েতনাম প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। ফ্রান্স এই প্রজাতন্ত্রকে স্বীকার করে নেয়। জাপান পরাজিত হয়ে ইন্দোচিন ত্যাগ করার সময় ভিয়েতনামীদের প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে গিয়েছিল। এই সময় ফ্রান্স ইন্দোচিন পূণদখল করতে গেলে হো-চি-মিন ওই সব অস্ত্র দিয়ে ফরাসীদের বাধা দিতে থাকেন। ফ্রান্স ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে আনামের রাজা বাও-দাই-কে ভিয়েতনামের রাজা হিসাবে ঘোষণা করে ভিয়েতমিন বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। ব্রিটেন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাও-দাই সরকারকে সাহায্য করতে অগ্রসর হয়। অপর পক্ষে চিন ও রাশিয়া হো-চি মিন-এর পক্ষ নেয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১৩ই মার্চ ভিয়েতমিনরা ফরাসি ঘাঁটি দিয়েন-বিয়েন-ফু বিধ্বস্ত করে। অবশেষে ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে জেনেভা সম্মেলনে ভিয়েতনামকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়। উত্তর ভিয়েতনাম হো-চি-মিনের প্রজাতন্ত্র এবং দক্ষিণ ভিয়েতনাম বাওদাই পরিচালিত রাষ্ট্রহিসাবে স্বীকৃতি লাভ করে। এই অবস্থায় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সাম্যবাদ প্রসার প্রতিরোধ লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। দীর্ঘকাল ধরে সংগ্রামের পর ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্ট শাসিত ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ভিয়েতনামের জন্ম হয়।

 

কাম্বোডিয়া ঃ 

 

 কাম্বোডিয়া বা কাম্পুচিয়ার মুক্তি আন্দোলনের নেতা ছিলেন রাজা নরোদম সিহানুক। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে রাজা সিহানুক ফরাসিদের অধীনতা থেকে মুক্ত হয়ে এখানে একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। সিহানুক সরকারের ব্যর্থতায় ১৯৭৫ সালে কাম্বোডিয়ায় কমিউনিস্ট দল ক্ষমতায় আসে।

 

লাওস ঃ 

 

 ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি অধীনতা থেকে লাওস স্বাধীনতা লাভ করে। ভিয়েতনামে ভিয়েতমিন দলের সাহায্যে মুফানুভঙ্গ-এর নেতৃত্বে “পাথেট লাও” নামক কমিউনিস্ট দল লাওসে ক্ষমতা দখল করেন।

 

ইন্দোনেশিয়া ঃ 

 

 দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার সুমাত্রা, জাভা, বালি, বোর্ণিও প্রভৃতি দ্বীপে ডাচ বা ওলন্দাজদের (হল্যান্ড) উপনিবেশ ছিল। এই দ্বীপগুলি একত্রে ইন্দোনেশিয়া নামে পরিচিত সপ্তদশ শতকের শেষে হল্যান্ড এই স্থান দখল করে ঔপনিবেশিক শাসন চালাতে থাকে। ১৯২৭ খ্রিস্টাব্দে ড. সুকর্ণ ইন্দোনেশীয় জাতীয়তাবাদীদল গঠন করে দেশের মুক্তির জন্য জোরদার আন্দোলন করে থাকে। ওলন্দাজ সরকার নিষ্ঠুর দমননীতির মাধ্যমে আন্দোলন দমন করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে জার্মানি হল্যান্ড দখল করলে ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে হল্যাণ্ডের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়। এই সুযোগে জাপান ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়া দখল করে ডঃ সুকর্ণর নেতৃত্বে একটি সহযোগী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। বিশ্বযুদ্ধের পর জাপান ইন্দোনেশিয়া ত্যাগ করলে ড. সুকর্ণ প্রজাতন্ত্রী সরকার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময় ডাচরা ফিরে এসে তা দমন করার চেষ্টা করলে তারা ব্যর্থ হয় এবং ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা মেনে নিতে বাধ্য হয়।

 

চীন ঃ 

 

 চিয়াং-কাই-শেক ১৯৪৫-৪৯ সাল পর্যন্ত আমেরিকার সাহায্যে চিনের কমিউনিস্টদের দমন করতে উদ্যোগী হন। কিন্তু কমিউনিস্টদের দমনে তিনি ব্যর্থ হন। ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে কমিউনিস্টরা পিকিং দখল করে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর মাও-সে-তুঙ ও চৌ-এন-লাই ১৯৪৯ খ্রিস্টাব্দে ১লা অক্টোবর গণ প্রজাতন্ত্রী চিন প্রতিষ্ঠা করেন। চিয়াং-কাই-শেক সদলবলে ফরমোজার তাইওয়ানে পলায়ন করেন।

 

ভারত ঃ 

 

 ভারতছাড়ো (১৯৪২), নেতাজি ও আজাদ-হিন্দ-বাহিনীর ভারত অভিযান, নৌবিদ্রোহ (১৯৪৬) প্রভৃতি আন্দোলন ও সংগ্রাম ইংরেজদের বুঝিয়ে দিয়েছিল ভারতে তাদের দিন শেষ। ব্রিটিশ মন্ত্রীসভা ১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে আলাপআলোচনার জন্য ভারতে মন্ত্রীমিশন পাঠান। রাজনৈতিক আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট এট্‌লী ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের কথা ঘোষনা করেন। মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বড়লাট হয়ে ভারতে আসেন এবং ভারতীয়দের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব ঘোষণা করেন। এই মাউন্টব্যাটেন প্রস্তাব অনুযায়ী এটলী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে ১৯৪৭ সালে ১৮ই জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ‘ভারতের স্বাধীনতা আইন’ পাশ করেন। এই আইন অনুযায়ী ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ১৫ই আগস্ট ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। ভারত স্বাধীন হওয়ার পরও চন্দননগর, পণ্ডিচেরী, মাহে, কারিকল ফরাসি অধিকৃত ছিল। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের পর ফরাসিরা এই অঞ্চলগুলি ভারত সরকারকে অর্পণ করে।

 

ব্রহ্মদেশ ঃ 

 

 ব্রহ্মদেশ বর্তমান নাম বার্মা বা মায়ানমার আগে ভারতের অঙ্গ ছিল। এই দেশটি ব্রিটিশ শাসনের অধীন ছিল। ভারতের অঙ্গ থাকায় এখানে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দে ভারত শাসন আইন অনুসারে বার্মাকে ভারত থেকে পৃথক করে স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার দেওয়া হয়। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে জাপান বার্মা জয় করে একটি তাঁবেদার সরকার প্রতিষ্ঠা করে। যুদ্ধ শেষে বার্মার জাতীয়তাবাদী আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করায় ইংরেজরা বুঝতে পারে বার্মাকে বেশিদিন পদানত করে রাখা যাবে না। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে ডিসেম্বর মাসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বার্মার স্বাধীনতা আইন পাশ হয় এবং ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে জানুয়ারী মাসে ব্রহ্মদেশ ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

 

সিংহল ঃ 

 

 সিংহলকে ব্রিটিশরা প্রথমে স্বশাসিত রাষ্ট্রের মর্যাদা দিয়েছিল। ১৯৪৭ সালে সিংহল স্বাধীনতা আইন পাশ হয় এবং সিংহল স্বাধীনতা লাভ করে। পরবর্তীকালে সিংহলের নতুন নাম হয় শ্রীলঙ্কা।

 

কোরিয়া ঃ 

 

 চিন ও জাপানের মধ্যবর্তী ছোটো উপদ্বীপ কোরিয়া ১৯১১ খ্রিস্টাব্দ থেকে জাপানের অধিকারে ছিল। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে পটস্ডম সম্মেলনে কোরিয়াকে স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত ঘোষনা করা হয়। জাপান এই সিদ্ধান্ত কার্যকরী না করায় রাশিয়া ও আমেরিকার সেনাবাহিনী জাপান অধিকৃত কোরিয়া আক্রমণ করে। জাপানি সেনা পরাজিত হয়ে উত্তর কোরিয়ায় রাশিয়ার সেনাবাহিনীর কাছে এবং দক্ষিণ কোরিয়ায় আমেরিকার সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। ফলে কোরিয়া ৩৮° সমাক্ষরেখা দ্বারা উত্তর ও দক্ষিণ দুভাগে ভাগ হয়ে যায়। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে উত্তর কোরিয়া রাষ্ট্রের নাম হয় জনগণতান্ত্রিক কোরিয়া এবং দক্ষিণ কোরিয়ার নাম হয় প্রজাতান্ত্রিক কোরিয়া। পরবর্তীকালে দুই কোরিয়াকে কেন্দ্র করে দীর্ঘ নিস্ফল যুদ্ধ চালিয়েও ঠান্ডা লড়াই-এর কারণে দুই কোরিয়া ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি।

 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পরেই মালয়, সিঙ্গাপুর স্বাধীনতা অর্জন করে।

 

আফ্রিকার জাতীয় মুক্তি আন্দোলন :

 

  আফ্রিকা মহাদেশে বিভিন্ন অঞ্চল সপ্তদশ শতক থেকে প্রধানত, ব্রিটিশ, ফরাসি, পর্তুগাল কর্তৃক অধিকৃত ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতীয় আন্দোলনের চাপে আফ্রিকার পরাধীন দেশগুলি স্বাধীনতা লাভ করে।

 

আফ্রিকার মরক্কো, টিউনিশিয়া, আলজেরিয়া, সিরিয়া, লেবানন প্রভৃতি দেশে ফরাসীদের কর্তৃত্ব ছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ঐসব দেশে মুক্তি আন্দোলন প্রবল আকার ধারণ করে। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে আফ্রিকায় ফরাসি কবল থেকে ওইসব দেশ মুক্ত হয়।

 

মরক্কো : 

 

 আফ্রিকার উত্তরে মরক্কো দেশটি ফরাসি অধিকৃত ছিল। সুলতান ষষ্ঠ মহম্মদ মরক্কোর স্বাধীনতার দাবি করেন। এই দাবিকে সমর্থন করে রাজনৈতিক দলগুলি স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে এবং মরক্কোর উপজাতিগুলি বিদ্রোহ করে। এই অবস্থায় ফ্রান্স নির্বাসিত সুলতানকে দেশে ফিরিয়ে আনে এবং ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দে মরক্কোর স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়।

 

আলজিরিয়া ঃ 

 

 আলজিরিয়া ছিল ফরাসিদের অধিকৃত দেশ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্রান্সের পরাজয়ের পর ফ্রান্স নতুন সংবিধান প্রবর্তন করে। আলজিরিয়ার আইনসভায় আরব ও ফরাসিদের সমান আসন সংখ্যা নির্দিষ্ট করেছিল। নির্বাচনে ফরাসি বিরোধীগণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করলে ফ্রান্স নির্বাচন বাতিল করেছিল। এর ফলে আলজিরিয়ায় সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু হয়। অবশেষে জোটনিরপেক্ষ দেশগুলির চাপে ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে এক গণভোটের মাধ্যমে আলজিরিয়া স্বাধীনতা লাভ করে।

 

দক্ষিণ আফ্রিকা ঃ 

 

 দক্ষিণ আফ্রিকা ব্রিটিশদের উপনিবেশ ছিল। এখানে শ্বেতাঙ্গ সরকার কৃষ্ণাঙ্গ অধিবাসী নিগ্রো ও ভারতীয় বংশোদ্ভুত জনগণের উপর নিষ্ঠুর অত্যাচার, শোষণ, পীড়ন চালাতে থাকে। মহাত্মা গান্ধি এই অত্যাচারের প্রতিরোধে অহিংস সত্যাগ্রহ করেছিলেন। কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে মুক্তি সংগ্রামের আন্দোলন শুরু হয়। নেলসন ম্যাণ্ডেলাকে ২৭ বছর কারারুদ্ধ করা হয়েছিল। দীর্ঘ সংগ্রাম ও বিশ্বের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী রাষ্ট্রগুলি সোচ্চার হওয়ায় ব্রিটিশ সরকার বর্ণবৈষম্যনীতি ত্যাগ করতে বাধ্য হয় এবং কৃষ্ণাঙ্গ নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন। দক্ষিণ আফ্রিকা মুক্তিলাভ করে। নাইজেরিয়া : ব্রিটিশ উপনিবেশ নাইজেরিয়া ১৯৪৫ থেকে ১৯৬০ পর্যন্ত দীর্ঘ লড়াই আন্দোলনের পর ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেয়।

 

সিয়েরা লিওনঃ ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দে শিক্ষিত লোকেদের নিয়ে সিয়েরা লিওনে, সিয়েরা লিওন অর্গানাইজেশন নামে একটি সংগঠন তৈরী হয়। এরা ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনকে জোরদার করে তোলে। সিটভেন্সের নেতৃত্বে অল্ পিপলস কংগ্রেস দল গড়ে ওঠে। দীর্ঘ সংগ্রামের পর ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দের ২৭-এ এপ্রিল সিয়েরা লিওন স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি পায়। গাম্বিয়া : ডেডিড জাওয়ার নামক জনৈক ব্যক্তি গাম্বিয়ায় প্রগ্রেসিভ পিপলস্ পার্টি গঠন করে

 

ব্রিটিশ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। শেষ পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার লন্ডন সম্মেলনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি গাম্বিয়ার স্বাধীনতা মেনে নেন।

 

ঘানা : 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে ১৯৪৫-৪৯ খ্রিস্টাব্দে ডঃ কোয়ামে নকুমার-এর নেতৃত্বে কনভেনসন পিপলস্ পার্টি গোল্ডকোস্ট ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়। ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দে

 

গোল্ডকোস্টে ন্যাশন্যাল লিবারেশন মুভমেন্ট নামে একটি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠে। ফলে মুক্তি আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। ১৯৫৬ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই সেপ্টেম্বর ব্রিটিশরা গোল্ডকোস্টের স্বাধীনতা স্বীকার করে নেয়। গোল্ডকোস্ট ঘানা নামে পশ্চিম আফ্রিকার সর্বপ্রথম স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি পায়।

 

 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *