প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ বিশ্লেষণ কর
প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ বিশ্লেষণ কর
প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ
প্রত্যক্ষ (Pratyaksa or Perception)
ন্যায় মতে, ইন্দ্রিয় এবং অর্থ তথা বিষয়ের মধ্যে সংযোগের ফলে যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তারই নাম হল প্রত্যক্ষ এই প্রত্যক্ষ প্রমার করণকেই বলা হয় প্রত্যক্ষ প্রমাণ। ন্যায় সম্প্রদায়ে প্রত্যক্ষ প্রমাণকেই মূল প্রমাণ এবং প্রমাকেই প্রকৃত ও আদি মারূপে স্বীকার করা হয়েছে। সেজন্যই ন্যায় দার্শনিকগণ সর্বাগ্রে প্রত্যক্ষের আলে করেছেন।
প্রত্যক্ষ কাকে বলে বা প্রত্যক্ষের সংজ্ঞা:
প্রত্যক্ষের সংজ্ঞাটিকে যথাযথভাবে উল্লেখ করতে হলে ন্যায়সূত্রকার মহর্ষি গৌতমের সংজ্ঞাটিকেই উল্লেখ করা দরকার। মহর্ষি গৌতমের ‘ন্যায়সূত্রে’ বলা হয়েছে, ‘ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপন্নং জ্ঞানম্ অব্যপদেশ্যম্ অব্যভিচারী ব্যবসায়ত্মকম্ প্রত্যক্ষম্’। অর্থাৎ, যে জ্ঞান ইন্দ্রিয় এবং অর্থের সন্নিকর্ষের ফলে উৎপন্ন (ইন্দ্রিয়ার্থ সন্নিকর্ষোৎপন্নং), যা অপর কোনো কিছুর মাধ্যমে প্রাপ্ত নয় (অব্যপদেশ্যম্), যা নিশ্চিত (অব্যভিচারী) এবং যা সংশয়শূন্য (ব্যবসায়ত্মকম্), তাই হল প্রত্যক্ষ (প্রত্যক্ষম্)।
প্রত্যক্ষের লক্ষণ বিশ্লেষণ:
প্রত্যক্ষের স্বরূপটি যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে হলে মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত প্রত্যক্ষজ্ঞানের সংজ্ঞাটির অন্তর্গত পদ বা শব্দগুলির বিশ্লেষণ একান্তভাবে প্রয়োজন।
ইন্দ্রিয় :
প্রদত্ত সংজ্ঞাটির প্রথমে ব্যবহৃত শব্দটি হল ইন্দ্রিয়। এই ইন্দ্রিয় বলতে ন্যায় দার্শনিকেরা পাঁচটি বহিরিন্দ্রিয় যথা—চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা এবং ত্বক ও একটি অতীন্দ্রিয় তথা মনকে বুঝিয়েছেন। পাঁচটি বহিরিন্দ্রিয়ের সাহায্যে আমরা জাগতিক বস্তু এবং ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করি এবং মন দ্বারা প্রত্যক্ষ করি আমাদের মানসিক অবস্থাসমূহকে, যেমন—সুখ, দুঃখ, ঘৃণা, ভালোবাসা ইত্যাদি।
অর্থ:
অর্থশব্দের মানে হল বিষয়। এখানে অবশ্য বিষয় বলতে জ্ঞানের বিষয়কেই বলা হয়েছে। অর্থ বা বিষয়টি হল অবশ্যই ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য। যে বিষয় ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য নয়, তাকে জ্ঞানের বিষয়রূপে স্বীকার করা হয় না। আমাদের যে ছয়টি ইন্দ্রিয় আছে, তাদের সকলেরই বিষয় বা অর্থ আছে। যেমন—চক্ষুর বিষয় হল রুপ, কর্ণের বিষয় হল শব্দ, জিহ্বার বিষয় হল স্বাদ, নাসিকার বিষয় হল ঘ্রাণ, ত্বকের বিষয় হল স্পর্শ এবং মনের বিষয় হল চেতনা।
সন্নিকর্ষ:
ইন্দ্রিয় আছে, আবার বিষয়ও আছে, কিন্তু তাহলেই যে প্রত্যক্ষ উৎপাদিত হবে, এমন নয়। কারণ ইন্দ্রিয় এবং বিষয়ের মধ্যে সন্নিকর্ষ তথা সংযোগের প্রয়োজন। ইন্দ্রিয় এবং বিষয়ের সংযোগ হলে তবেই প্রত্যক্ষ হয়। অবশ্য এক্ষেত্রে মনে রাখা উচিত যে, যোগ্য ইন্দ্রিয়ের সঙ্গেই যোগ্য বিষয়ের সন্নিকর্ষ হওয়া প্রয়োজন। যেমন ঘট নামক বিষয়টির সঙ্গে যদি চক্ষু নামক ইন্দ্রিয়ের সংযোগ ঘটে, তবেই এরকম প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয় যে—“এটি একটি ঘট” (ইদম্ ঘটম্)। সুতরাং, বিষয়ভেদে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষও ভিন্ন ভিন্ন হয়।
অব্যপদেশ্য:
আমাদের যখন কোনো বিষয়ের প্রত্যক্ষ জ্ঞান হয়, তখন আমরা সেই বিষয়ের নামকেও জানি। একেই বলা হয় ব্যপদেশ্য। কিন্তু সন্নিকর্ষ এমনই হবে যা বিষয়ের দ্বারা ব্যপদেশ্য নয়, অর্থাৎ অব্যপদেশ্য। অব্যপদেশ্য শব্দটির দ্বারা নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকেই বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ, যা শব্দের দ্বারা প্রকাশযোগ্য নয় তা-ই অব্যপদেশ্য। এরূপ বিষয়টি তাই অপর কোনো কিছুর মাধ্যমে প্রাপ্ত নয়।
অব্যভিচারী:
ব্যভিচারের অর্থ হল চরিত্রহীনতা। অর্থাৎ, যে বিষয়ের যা চরিত্র নয়, সেই বিষয়কে যদি তাই মনে হয়, তবে তাকে বলে ব্যভিচারী। ব্যভিচারের অভাবকেই বলা হয় অব্যভিচারী। রজ্জুতে যদি সর্পভ্রম হয়, তবে তা হবে ব্যভিচারী। কিন্তু রজ্জু যদি রজ্জু বলেই জ্ঞাত হয়, তবেই তা হবে অব্যভিচারী। অর্থাৎ, যে জ্ঞান বিষয়ের অনুরূপ তাকেই বলা হয় অব্যভিচারী। প্রত্যক্ষকেও এরূপ অব্যভিচারী হতে হবে।
ব্যবসায়ত্মক:
ব্যবসায়ত্মক শব্দটির অর্থ হল সংশয়শূন্য বা বিপর্যয়শূন্য। যে প্রত্যক্ষে সংশয় বা বিপর্যয় থাকে, তাকে যথার্থ প্রত্যক্ষরূপে অভিহিত করা সংগত নয়। যেমন—যখন কোনো বস্তুকে দেখে সেটা শুকনো গাছের কাণ্ড, না মানুষ—এরূপ সংশয় জাগে, তখন তাকে প্রত্যক্ষরূপে অভিহিত করা সংগত নয়। সুতরাং সংশয়মুক্ত নিঃসন্দেহ বা নিশ্চয়াত্মক জ্ঞানই হল প্রত্যক্ষ জ্ঞান। সুতরাং ব্যবসায়ত্মকের অর্থ হল নিশ্চয়াত্মক জ্ঞান।
প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ
বিশ্বনাথ কর্তৃক প্রত্যক্ষের সমালোচনা
মহর্ষি গৌতম প্রদত্ত যে সংজ্ঞাটি এখানে উত্থাপিত হয়েছে, সেই সংজ্ঞাটিকে মোটামুটিভাবে সমস্ত ভারতীয় সম্প্রদায়ই মেনে নিয়েছে। কিন্তু কিছু কিছু ন্যায় দার্শনিকদের মতে এই সংজ্ঞাটি পরিপূর্ণভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ, প্রত্যক্ষের এই সংজ্ঞাটি সমস্ত জাগতিক জীবের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলেও, ঈশ্বরের প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয় বলে উদ্ভ লক্ষণে অব্যাপ্তি দোষ ঘটে। তাই এই সংজ্ঞাটি এমন হওয়া উচিত, যে সংজ্ঞা জীব এবং ঈশ্বর সকলের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য হয়। এই উদ্দেশ্যে আচার্য বিশ্বনাথ প্রত্যক্ষের একটি সংজ্ঞা প্রদান করেছেন। সেই অনুসারে বলা হয়, “জ্ঞানাকরণং জ্ঞানম প্রত্যক্ষম”—এর অর্থ হল, যার করণ অপর একটি জ্ঞান নয়, অর্থাৎ যা অকরণ, তাকেই বলা হয়। প্রত্যক্ষ। প্রত্যক্ষ হল সাক্ষাৎ অনুভব।
নব্যন্যায়ের সূচনাকার গঙ্গেশ উপাধ্যায়ও প্রত্যক্ষের অনুরূপ সংজ্ঞা প্রদান করে বলেন, “প্রত্যক্ষ সাক্ষাৎকারিত্বম্ লক্ষণম্”। এর অর্থ হল, প্রত্যক্ষের লক্ষণ হল সাক্ষাৎকারিত্ব বা সাক্ষাৎ জ্ঞান। তিনি বলেন যে, বিষয়ের বা অর্থের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সন্নিকর্ষ নয়, ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সাক্ষাৎকারিত্বই হল প্রত্যক্ষের প্রকৃত লক্ষণ। প্রত্যক্ষের এই লক্ষণটি জীব ও ঈশ্বর উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।
প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগ
ন্যায়দর্শনে বিভিন্ন প্রকার প্রত্যক্ষের উল্লেখ করা হয়েছে। ন্যায়ের প্রত্যক্ষ সম্পর্কিত বিশদ আলোচনা ও জ্ঞানলাভ করতে হলে প্রত্যক্ষের শ্রেণিবিভাগের প্রতি সর্বাগ্রে দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন। ন্যায়দর্শনে প্রত্যক্ষকে দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে। লৌকিক এবং অলৌকিক।
● লৌকিক প্রত্যক্ষ:
লৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় এবং বিষয়ের সঙ্গে সাধারণ বা লৌকিক সংযোগ স্থাপিত হয়। লৌকিক প্রত্যক্ষকে আবার দু-ভাগে ভাগ করা হয়েছে—বাহ্য প্রত্যক্ষ এবং মানস প্রত্যক্ষ।
বাহ্য প্রত্যক্ষ:
আমাদের পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয়ের সাহায্যে যে প্রকারের প্রত্যক্ষ হয়, তাকেই বলা হয় বাহ্য প্রত্যক্ষ। পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয় দ্বারা এইরূপ প্রত্যক্ষ সম্পন্ন হয়ে থাকে। এই পাঁচটি বাহ্য ইন্দ্রিয় হল যথাক্রমে— চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক।
ন্যায় দার্শনিকগণ বাহ্য প্রত্যক্ষকে আরও একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গির দিক থেকে বিভক্ত করেছেন। এই দৃষ্টিভঙ্গিটি হল স্পষ্টতার বা স্বচ্ছতার দৃষ্টিভঙ্গি। এই দৃষ্টিভঙ্গির পরিপ্রেক্ষিতে বাহ্য প্রত্যক্ষ হল তিন প্রকারের—নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ, সবিকল্প প্রত্যক্ষ এবং প্রত্যভিজ্ঞা।
(a) নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ:
কোনো নির্দিষ্ট বিষয়ের সঙ্গে ইন্দ্রিয়ের সংযোগ হওয়া মাত্রই বিশেষণ বর্জিত যে জ্ঞান উৎপন্ন হয়, তাকেই বলে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। যেমন—এটা একটা বস্তু ।
(b) সবিকল্প প্রত্যক্ষ:
যে প্রত্যক্ষে বস্তুর বিশেষণ বা ধর্মের জ্ঞান হয়, তাকে বলে সবিকল্প প্রত্যক্ষ। যেমন— এটা একটা সাদা বস্তু ।
(c) প্রত্যভিজ্ঞা:
পূর্বপরিচিত কোনো বস্তুকে পরে দেখে, পূর্বপরিচিত বস্তুরূপেই যখন প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন তাকে বলা হয় প্রত্যভিজ্ঞা। যেমন—এই সেই দেবদত্ত যাকে আমি কাশীতে দেখেছিলাম।
মানস প্রত্যক্ষ :
ন্যায় মতে, মানস প্রত্যক্ষকে-ও স্বীকার করা হয়েছে। এক্ষেত্রে বিষয়টি মানস তথা মন দ্বারা প্রত্যক্ষিত। মনের সঙ্গে যখন চিন্তা, অনুভূতি, ইচ্ছা প্রভৃতির সন্নিকর্ষ হয়, তখনই এরূপ মানস প্রত্যক্ষ সম্ভব হয়। আমাদের মনকে বলা হয় অন্তর ইন্দ্রিয়।
অলৌকিক প্রত্যক্ষ:
অলৌকিক প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে ইন্দ্রিয় ও বিষয়ের মধ্যে সংযোগ হয় অলৌকিক বা অসাধারণভাবে। অলৌকিক প্রত্যক্ষকে আবার তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে—সামান্য লক্ষণ, জ্ঞান লক্ষণ এবং যোগজ লক্ষণ।
সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ:
সামান্য ধর্মই যে সন্নিকর্ষের স্বরূপ, তাকে বলে সামান্য লক্ষণ প্রত্যক্ষ। যেমন— ঘটে ঘটত্ব প্রত্যক্ষ।
জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ:
কোনো বস্তুর পূর্বজ্ঞান যখন সন্নিকর্ষরূপে প্রত্যক্ষের উৎপাদন করে, তখন তাকে বলে জ্ঞান লক্ষণ প্রত্যক্ষ। যেমন—চন্দন কাঠে সুরভি প্রত্যক্ষ।
যোগজ লক্ষণ প্রত্যক্ষ:
যে বিশেষ প্রকার যোগজ সন্নিকর্ষের ফলে যোগীদের সর্বকালীন অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে প্রত্যক্ষ হয়, তাকে বলে যোগজ লক্ষণ প্রত্যক্ষ। যেমন—বর্তমান কালের কোনো বস্তুতে তার ভবিষ্যৎ রূপের প্রত্যক্ষ।
নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ (Nirvikalpa Pratyaksha)
ন্যায়দর্শনে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের সংজ্ঞার পরিপ্রেক্ষিতে বলা হয়েছে নিষ্প্রকারকং জ্ঞানং নির্বিকল্পকম্’ অর্থাৎ যে প্রশ জ্ঞান কোনো ‘প্রকার’ বা ‘বিশেষণ রহিত’ বা ‘বিশেষণ শূন্য’ তাকেই বলে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ।
, প্রকারহীন প্রত্যক্ষরূপে নির্বিকল্প:
‘প্রকার’ বলতে প্রত্যক্ষের সংজ্ঞায় বিশেষ্য বা বিশেষণকেই বোঝানো হয়েছে। আমরা যখন কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ করে তার সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করি, তখন সেই বস্তুটির দুটি অংশ থাকে। এদের একটি হল বিশেষ্য এবং অপরটি হল বিশেষণ। প্রত্যক্ষের মাধ্যমে যখন আমাদের ‘ঘট’ সম্বন্ধে জ্ঞান হয়, তখন তার দুটি অংশ থাকে—একটি হল বস্তুটি ঘট এবং অপরটি হল ঘটটি পীতবর্ণ। ‘ঘট’ এখানে বিশেষ্য এবং ‘পীতবর্ণ’ হল বিশেষণ। এই বিশেষ্য বা বিশেষণই হল ঘটের প্রকার। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ হল বিশেষ্য-বিশেষণ সম্পর্ক বর্জিত প্রত্যক্ষ। অর্থাৎ, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র বস্তুটির অস্তিত্বের দিকটিই প্রকাশিত হয়। সুতরাং, যে লৌকিক প্রত্যক্ষে কেবলমাত্র কোনো বস্তুকে একটি বস্তুরূপেই প্রত্যক্ষ করা হয়, তার কোনো গুণকে বা ধর্মকে নয়, সেই প্রত্যক্ষকেই বলা হয় নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। যেমন—আলো-আঁধারে কিছু একটা দেখা গেলেও সেটি ঠিক কী, তা প্রত্যক্ষ করা যায় না।
প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ
নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর যথার্থ জ্ঞানের অভাব:
নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে বস্তুর প্রকার বা নাম সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণাই থাকে না। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র আমরা বস্তুটিকেই নিছক প্রত্যক্ষ করি। বস্তুটির স্বরূপ কী? অথবা অপরাপর বস্তু থেকে এর পার্থক্য কোথায়? এই ধরনের প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার মতো নির্দিষ্ট গুণ-সম্পন্ন প্রত্যক্ষ জ্ঞান নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের ক্ষেত্রে হয় না। নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞানে বস্তু ও ধর্মের সম্বন্ধ তথা বিশেষ্য ও প্রকারের সম্বন্ধ প্রকাশিত হয় না। এটি শুধুমাত্র এক সহজ উপলব্ধির (simple apprehension) ব্যাপার। এই ধরনের জ্ঞানে বিশেষ্যটি বিশেষণ যুক্ত নয় বা বিশিষ্টরূপে চিহ্নিত নয়। সেকারণেই বলা যায় যে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বক্তার যথার্থ জ্ঞানের অভাব থাকে। কারণ, এক্ষেত্রে বক্তার নাম বা স্বরূপ সম্পর্কে আমাদের কোনো ধারণাই থাকে না। আমরা শুধুমাত্র বস্তুটিকেই প্রত্যক্ষ করি।
নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বচনে প্রকাশযোগ্য নয়:
নির্বিকল্প প্রত্যক্ষে বস্তুর প্রত্যক্ষ হয় ঠিকই কিন্তু বস্তুর স্বরূপ প্রত্যক্ষ না হওয়াতে, তাকে বাচনিক আকারে প্রকাশ করা যায় না। অর্থাৎ, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ বচনে প্রকাশযোগ্য নয় । একারণেই নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ অব্যপদেশ্য রূপে অভিহিত হয়। অব্যপদেশ্য শব্দের অর্থই হল বচনে অপ্রকাশযোগ্য। নির্বিকল্প নিঃ + বিকল্প। ‘বিকল্প’ শব্দের অর্থ হল বিশেষ্য-বিশেষণ ভাব, আর নিঃ উপসর্গের অর্থ হল নেই। সুতরাং, যে প্রত্যক্ষে বিশেষ্য-বিশেষণ ভাব নেই, তাকেই বলা হয় নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। এই নির্বিকল্প প্রত্যক্ষকেই ন্যায় দার্শনিকেরা প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রথম সোপান বলে অভিহিত করেন।
সবিকল্প প্রত্যক্ষ (Savikalpa Pratyaksha)
ন্যায়দর্শনে সবিকল্প প্রত্যক্ষের লক্ষণটিকে এইভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে—“সপ্রকারকং জ্ঞানং সবিকল্পকম্”। অর্থাৎ যে প্রত্যক্ষ জ্ঞান প্রকারযুক্ত, সেই প্রত্যক্ষ জ্ঞানকেই বলা হয় সবিকল্প।
প্রকারযুক্ত জ্ঞান:
সবিকল্প প্রত্যক্ষ জ্ঞান হল মূলত বস্তুর প্রকারযুক্ত জ্ঞান। অর্থাৎ, যে প্রত্যক্ষজ্ঞানে আমরা কোনো বস্তুকে বিশেষণযুক্তরূপে প্রত্যক্ষ করি, তাকেই বলে সবিকল্প। ‘বিকল্প’ শব্দের অর্থ হল বিশেষ্য-বিশেষণ ভাবসমৃদ্ধ। সবিকল্প = স + বিকল্প, অর্থাৎ, যে প্রত্যক্ষ বিকল্পযুক্ত তাকেই বলে সবিকল্প। এই সবিকল্প প্রত্যক্ষ কিন্তু প্রত্যক্ষ জ্ঞানের প্রথম সোপান নয়। এটা হল প্রত্যক্ষ জ্ঞানের দ্বিতীয় স্তর। কারণ, প্রথম স্তর হল নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ। প্রথমে নির্বিকল্প প্রত্যক্ষের দ্বারা কোনো অস্তিত্বশীল বস্তু যদি না দেখি, তবে দ্বিতীয় স্তরে কখনোই বলা সম্ভব নয় যে, বস্তুটি ‘ঘট’ বা অন্য কিছু। সুতরাং এই দাবি করা সংগত যে, নির্বিকল্প প্রত্যক্ষ ছাড়া সবিকল্প প্রত্যক্ষ আদৌ সম্ভব নয়।
● বিশেষণযুক্ত জ্ঞান:
ন্যায় সূত্রে প্রত্যক্ষের যে সংজ্ঞা প্রদান করা হয়েছে, সেখানে বলা হয়েছে যে, প্রত্যক্ষ হল ব্যবসায়ত্মক। ব্যবসায়ত্মক শব্দের অর্থই হল সবিকল্প। তাই যে জ্ঞানকে বিশেষণযুক্ত বা বিশিষ্টরূপে উল্লেখ করা হয়, তাকে বলে সবিকল্প। এই ধরনের প্রত্যক্ষজ্ঞানে একটি জ্ঞেয় বস্তু প্রকার বা বিশেষণ যুক্ত হয়। একটি বস্তুকে যখন ‘ঘট প্রত্যক্ষ করছি’ বলে দাবি করা হয়, তখন তা সবিকল্প প্রত্যক্ষরূপেই স্বীকৃত হয়। আবার যদি বলা হয়, “আমি একটি পীত বর্ণের ঘট প্রত্যক্ষ করছি”, তাহলেও তা প্রকার বা বিশেষণযুক্ত হওয়ায় সবিকল্প রূপে গৃহীত হয়। সবিকল্প প্রত্যক্ষকে বচনের মাধ্যমে প্রকাশ করা সম্ভব।
প্রত্যক্ষ কাকে বলে ? প্রত্যক্ষের লক্ষণ