সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু আলোচনা কর teacj sanjib
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু আলোচনা কর teacj sanjib
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু: সাজাহান নাটকের বিভিন্ন অঙ্ক ও দৃশ্যের সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা
‘সাজাহান’ নাটকের মােট পাঁচটি অঙ্ক। প্রথম অঙ্কে সাতটি, দ্বিতীয় অঙ্কে পাঁচটি, তৃতীয় অঙ্কে ছ’টি, চতুর্থ অঙ্কে সাতটি এবং পঞ্চম অঙ্কে ছ’টি দৃশ্যের অবতারণা করা হয়েছে। নাটকটিতে মােট একত্রিশটি দৃশ্য সন্নিবদ্ধ হয়েছে।
॥ প্রথম অঙ্ক ॥
সাজাহান’ নাটকের প্রথম অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে নাট্যকার নাটকের মূল বিষয়বস্তুর প্রতি ইঙ্গিত করেছে। সেই উদ্দেশ্যে নাটকীয় ঘটনার দ্বন্দ্বটিরও আভাস দিয়েছে মুখ্য চরিত্রগুলির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়ে। সেই কারণে নাটকের প্রথম দৃশ্যটির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অবশ্যই লক্ষ্য করার মত।
এখানে আগ্রার প্রাসাদ দুর্গে অসুস্থ সম্রাট সাজাহানের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। আর তারই পটভূমিকায় পুত্রদের কলহ-বিবাদের সম্ভাবনা ব্যাঞ্জিত হয়েছে প্রথম দৃশ্যেই। সম্রাটের অসুস্থতার সংবাদ পেয়ে বাংলাদেশে সাজাহানের দ্বিতীয় পুত্র সুজা এবং গুর্জরে কনিষ্ঠ পুত্র মােরাদ বিদ্রোহ ঘােষণা করেছেন আর দাক্ষিণাত্য থেকে তৃতীয় পুত্র ঔরংজীব সমর্থন জানিয়েছেন মােরাদকে। এই সমস্ত সংবাদ পেয়ে আগ্রায় সম্রাট সাজাহান খুবই বিচলিত হয়ে পড়েছেন। জ্যেষ্ঠ পুত্র দারা এই বিদ্রোহী ভ্রানদের দমন করতে চান। এরূপ অবস্থায় সাজাহান কি করবেন ভেবে ঠিক করতে পারছেন না। অবশেষে সম্রাট তার কন্যা জাহানারার পরামর্শে সম্রাটের কর্তব্য পালনে সম্মত হন এবং দারাকে বিদ্রোহীদের দমনে আদেশ দেন। একদিকে স্নেহের পুত্রদের পারস্পরিক শক্তি পরীক্ষার বিষময় পরিণতির কথা ভেবে উদ্বিগ্ন না হয়ে পারেন না তিনি। অপরদিকে পিতৃহৃদয়ের স্নেহ বাৎসল্যকেও উপেক্ষা করতে পারেন না। ফলে নাটকীয় সংঘাতের সূচনা প্রথম দৃশ্যেই উপস্থাপিত হয়েছে, যার পরিণাম সম্পর্কে দর্শকদের কৌতূহল বৃদ্ধি পেয়েছে। এখানে নাট্যকার তাঁর নাট্যকৌশলের প্রথম স্তর কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হতে পেরেছেন।
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু:
প্রথম অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্য ঃ নর্মদাতীরে স্থাপিত মােরাদের যুদ্ধ শিবিরে ঔরংজীবের উপস্থিতি লক্ষণীয়। যশােবন্ত সিংহের সঙ্গে যুদ্ধে জয়লাভ করে মােরাদের শিবির আনন্দে উল্লসিত। সেই আনন্দে অংশগ্রহণ করেছে সকলের সঙ্গে মােরাদের বিদূষক দিলদার। এখানে নাট্যকার সুকৌশলে মােরাদ ও ঔরংজীবের চরিত্রের স্বরূপ সম্পর্কে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। মােরাদের বিলাসপরায়ণতা ও ঔরংজীবের কূটকৌশল সম্পর্কে ধারণাটিও স্পষ্ট হয়। এই যুদ্ধ জয়ের জন্য বিশেষ উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়েই মােরাদকে অভিনন্দন জানান ঔরংজীব। ধর্মাটের যুদ্ধে যশােবন্ত সিংহের চল্লিশ হাজার সৈন্য ঔরংজীবের শঠনীতির কাছে পরাস্ত হয় ; ফলে ঔরংজীবের রণকৌশল ও চাতুর্য এখানে সম্যকভাবে পরিস্ফুটিত হয়েছে।
সাজাহান নাটকের কাহিনী
তৃতীয় দৃশ্যঃ কাশীতে সুজার শিবির। এখানে দারার পুত্র সুলেমান কর্তৃক সুজার গতিরােধ ও পরিশেষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সুজার পলায়নই এই দৃশ্যের মুখ্য ঘটনা। সুজাপত্নী পিয়ারা স্বামীকে যুদ্ধোন্মাদনা থেকে বিরত করতে চায় ও সংগীত রসের আনন্দ ধারায় সিক্ত করতে চায়। বাংলাদেশে দীর্ঘকাল থাকার ফলে সুজা বাঙালীর মতাে কোমল স্বভাবের অধিকারী হয়েছিলেন এবং নৃত্য-গীত ও চারুশিল্পের প্রতি তার আকর্ষণ তাকে মেরুদণ্ডহীন করে তুলেছিল, সুজা চরিত্রের সে পরিচয়ও এখানে উদ্ঘাটিত। এখানে দারার পুত্র সুলেমান ও রাজপুত্র জয়সিংহের আংশিক পরিচয়ও পাওয়া যায়।
চতুর্থ দৃশ্য : নাটকের পক্ষে অপরিহার্য বলে মনে হয় না। কারণ মূল নাট্যদ্বন্দ্বের সঙ্গে এর কোন যােগ নেই। তবে নাট্যকারের স্বদেশপ্রেম রাজপুত রমণী যশােবন্ত সিংহের পত্নী মহামায়াকে আশ্রয় করে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠেছে। তাই যুদ্ধে পরাজিত যশােবন্ত সিংহের যােধপুরের প্রত্যাবর্তনে মহামায়া অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে প্রবেশের দুর্গদ্বার বন্ধ করে দেন। রাজপুত রমণীর তেজস্বিতার পরিচয়ও আলােচ্য দৃশ্যে পরিস্ফুট।
পঞ্চম দৃশ্যে ঔরংজীবের কূটকৌশলের আর একটি পরিচয় পাওয়া যায়। যখন তিনি মােরাদের কাছে শুনলেন দারা প্রায় এক লক্ষ্য সৈন্য নিয়ে যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা করছে। তখন তিনি সম্মুখ সংগ্রামে অবতীর্ণ না হয়ে রাতের অন্ধকারে অন্যপথে অরক্ষিত আগ্রার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। একাজে বিশ্বাসঘাতক শায়েস্তা খাঁর সহযােগিতা লাভেও তিনি সমর্থ হয়েছেন।
ষষ্ঠ দৃশ্য : সােলেমানের শিবির। দিলীর খাঁ সংবাদ দেয় শায়েস্তা খাঁর বিশ্বাসঘাতকতায় দারা পরাজিত হয়ে মাত্র একশত সঙ্গী নিয়ে দোয়াবের দিকে পালিয়েছেন। মােরাদ এবং ঔরংজীব বিনা বাধায় আগ্রায় প্রবেশ করেছেন। পরাজিত দারার দুর্ভাগ্য ঔরংজীবের সৌভাগ্যকে সূচিত করেছে। এ অবস্থায় সােলেমানের জয়সিংহ ও দিলীর খাঁকে তার সঙ্গে সহযােগিতার কাতর আবেদনে দিলীর খাঁ সাড়া দিলেও জয়সিংহ দ্বিধাগ্রস্ত। তিনি এ লড়াইয়ে পাল্লা কোন্ দিকে ভারী হয় তা দেখার জন্য আগ্রহে অপেক্ষা করতে থাকেন।
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু:
সপ্তম দৃশ্য : আগ্রা-প্রাসাদ দুর্গ। সাজাহান ঔরংজীবের আগ্রা প্রবেশের খবর পেয়ে আগ্রহে তার আগমনের প্রতীক্ষায় থাকেন। কারণ তিনি উদ্ধত পুত্র ঔরংজীবকে স্নেহের দ্বারা বশ করতে চান। কিন্তু ঔরংজীবের পরিবর্তে প্রবেশ করেন তাঁর পুত্র মহম্মদ। মহম্মদ পিতার আদেশ অনুযায়ী সাজাহানের বন্দীত্বের কথা ঘােষণা করে। সাজাহান পৌত্র মহম্মদের কথায় বিস্মিত। অবশেষে তার মুক্তির জন্য মহম্মদকে অনেক অনুনয় বিনয় করেন এবং পরিশেষে তাকে সিংহাসনে বসাবার প্রতিশ্রুতি দেন। কিন্তু মহম্মদ তার কর্তব্যকর্মে অবিচল। জাহানারা ঔরংজীবের এই কপটতায় যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও বিস্মিত। এখানে সাজাহান পুত্র ঔরংজীব ও পৌত্র মহম্মদের কর্তব্যবােধের তুলনা করে ভেবে অবাক হয়ে যান।
॥ দ্বিতীয় অঙ্ক ॥
প্রথম দৃশ্য : মথুরায় ঔরংজীবের শিবির। ঔরংজীব তার দাবার খুঁটি সাজাতে থাকেন। একদিকে আত্মরক্ষা ও অন্যদিকে আত্মপ্রতিষ্ঠার দৃঢ় সংকল্প গ্রহণ করেন। তার পথের কাঁটাগুলিকে এক এক করে সমূলে উৎপাটিত করতে চান। দারার পশ্চাদ্ধাবনের উদ্দেশ্যে মপুরায় শিবির স্থাপন করেছেন। মােরাদকে সুরা ও নর্তকীর দ্বারা মােহাচ্ছন্ন করে অবশেষে বন্দী করে গােয়ালিয়র দুর্গে পাঠিয়ে দেন। বিদূষক দিলদার মােরাদের আসন্ন সর্বনাশের চিত্র চোখের সামনে দেখতে পান।
দ্বিতীয় দৃশ্য : আগ্রা দুর্গে বৃদ্ধ সাজাহান নজরবন্দী। জাহানারা সম্রাটের কর্ণগােচর করেন। যে, ঔরংজীব ভারতসম্রাট হিসেবে অভিষিক্ত হচ্ছেন। দেশজুড়ে সেই অভিষেকের উৎসব
সাজাহান নাটকের বিষয়বস্তু:
সাজাহান নাটকের সারমর্ম
আয়ােজন চলেছে। এ কথা শুনে সম্রাট সাজাহান অত্যন্ত ক্রুদ্ধ ও অস্থির হয়ে ওঠেন। বিকৃত মস্তিষ্কের মত উন্মত্ত আচরণ প্রকাশ করতে থাকেন। কপট ঔরংজীবের প্রতি সকলের আনুগত্য দেখেই তিনি হতবুদ্ধি হয়ে পড়েন।
তৃতীয় দৃশ্যের পটভূমি রাজপুতানার মরুভূমি। সামুগড়ের যুদ্ধে দারার শােচনীয় পরাজয়ের ফলে আজ তিনি স্ত্রী নাদিরা, পুত্র সিপার ও কন্যা মহরৎকে নিয়ে রাজপুতানার মরুপ্রান্তরে জীবনৃত। তার বুভুক্ষু পরিবারের দিকে চেয়ে ঈশ্বরে বিশ্বাস আর অটুট থাকতে চায় না। সকলে মৃত্যুর মুখােমুখি।
চতুর্থ দৃশ্য ও মুঙ্গেরের দুর্গ প্রাসাদ। এখানে সুজার অবস্থা বর্ণিত হয়েছে। দারাকে তবু স্বীকার করে নেওয়া গেলেও ক্রু, শঠ ঔরংজীবের অভ্যুত্থানকে তিনি মােটেই সহ্য করতে পারছে না। তাই ঔরংজীবের বশ্যতা স্বীকারের আশঙ্কায় তিনি অত্যন্ত বিচলিত বােধ করেন।
পঞ্চম দৃশ্যটি নাটকীয় তাৎপর্যমণ্ডিত। ঔরংজীব দিল্লীর সিংহাসনে আরােহণ করেছে। ঔরংজীব দরবারে বসেছেন। যশােবন্ত সিংহ ও জাহানারা তাকে নানা অভিযােগে অভিযুক্ত করেছে। জাহানারা সভাসদদের ঔরংজীবের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করার প্রয়াস চালান। কিন্তু ঔরংজীবের কপট ধর্মচারিতায় ও ভণ্ডামি তে শেষপর্যন্ত সে প্রচেষ্টা সফল হয় না। নাট্যকার এখানে কূটনীতিজ্ঞ ঔরংজীবের সম্যক পরিচয় প্রদান করেছেন। ঔরংজীব যে শুধু বুদ্ধিবলেই শ্রেষ্ঠ তা নয় বাক্যবলেও তিনি সমান পারদর্শী।
৷ তৃতীয় অঙ্ক ॥
প্রথম দৃশ্য ও খিজুয়ার প্রান্তর। ঔরংজীবের শিবির। এখানে ঔরংজীব সুজার সঙ্গে সম্মুখ লড়াইয়ে অবতীর্ণ। তাই আসন্ন যুদ্ধে সমগ্র পরিকল্পনা সেনাপতিদের বুঝিয়ে দেন। সুজাকে তিনি যত না ভয় করেন তার চেয়ে বেশী ভয় করেন যশােবন্ত সিংহকে। কারণ, ঔরংজীব যশােবন্ত সিংহের ওপর পুরােপুরি আস্থাশীল নন। তাই আলােচ্য দৃশ্যে তার সেই বিচলিত ভাব ফুটে উঠেছে।
দ্বিতীয় দৃশ্যে খিজুয়ার যুদ্ধের অন্য প্রান্তরে সুজার শিবিরের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে। এখানে একদিকে সুজার স্ত্রী পিয়ারা স্বামীকে যুদ্ধের দুর্ভাবনা থেকে মুক্ত করে দুদণ্ড শান্তি দেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালায়। অন্যদিকে সুজা যশােবন্ত সিংহকে নিজের পক্ষে আনার জন্য উদগ্রীব।
তৃতীয় দৃশ্যে পট পরিবর্তন হয়েছে। আমেদাবাদে দারা, ঔরংজীবের শ্বশুর সাহানাবাজের আশ্রয় গ্রহণ করেছে। সাজাহানের প্রতি ঔরংজীবের দুর্ব্যবহারে সাহানাবাজ ক্ষুব্ধ। দারাকে সাহায্য করার আশ্বাস দেন। এই দৃশ্যেই আর একটি চিত্রে দেখা যায় দারার সাহায্যের জন্য আগত সােলেমানকে ঔরংজীবের সৈন্যবাহিনী তাড়িয়ে নিয়ে যাওয়ার ফলে তিনি শ্রীনগরের রাজা পৃথ্বী সিংহের আশ্রয় প্রার্থী।
চতুর্থ দৃশ্যে দেখা যায় সােলেমান যুদ্ধে পরাজিত হয়ে কাশ্মীররাজের প্রমােদোদ্যানে আশ্রয় নিয়েছে। মহারাজ পৃথ্বী সিংহ কিভাবে সােলেমানের প্রতি বিরূপ হলেন সেই ঘটনা আলােচ্য দৃশ্যে ব্যক্ত হয়েছে। শেষপর্যন্ত সােলেমান পৃথ্বী সিংহের আশ্রয়চ্যুত হন।
পঞ্চম দৃশ্য ঃ দিল্লীর দরবার কক্ষ, এটিকে মন্ত্রনা কক্ষ বলাই ভাল। কারণ ঔরংজীব ও জয়সিংহ পরস্পর মতবিনিময় করেন। সেখানেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে ঔরংজীব সাহানাবাজ,দারা
এবং যশােবন্ত সিংহের মিলিত শক্তিকে ভয় পাচ্ছেন। তাই তিনি কৌশলে যশােবন্ত সিংহকে বিচ্ছিন্ন করতে চান। তিনি জয়সিংহের মারফৎ যশােবন্ত সিংহকে জানান যশােবন্ত যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকলে তার পূর্বকৃত সমস্ত অপরাধ ক্ষমা করা হবে উপরন্তু গুজরাট প্রদেশ উপঢৌকন দেওয়া হবে। এখানে আর একটি চিত্র উল্লেখযােগ্য। পুত্র মহম্মদ ঔরংজীবের প্রতি পূর্বের মত বিশ্বাসে অবিচল নয় একথা ঔরংজীব উপলব্ধি করেছে। তাই কখনও তাকে ভবিষ্যৎ সাম্রাজ্যের অধিকারী বলে আশান্বিত করতে চান, আবার কখনও বা তার এই পিতৃদ্রোহিতার জন্য উপযুক্ত শাস্তির কথাও চিন্তা করেন।
ষষ্ঠ দৃশ্যে যােধপুরের প্রাসাদে জয়সিংহকে দেখা গেল। তিনি ঔরংজীবের পরিকল্পনা অনুযায়ী তার বার্তাবহ হয়ে যােধপুর অধিপতি যশােবন্ত সিংহের কাছে এসেছে। এখানে জয়সিংহ কূটবুদ্ধি দ্বারা যশােবন্ত সিংহকে আসন্ন যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার আবেদন জানান এবং আখেরে তাতে লাভ ছাড়া লােকসান হবে না একথাও বােঝাতে কসুর করেন না। যশােবন্ত। সিংহ বীর হলেও দুর্বল চিত্ত, তাই দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েন। কিন্তু তার স্ত্রী মহামায়া রাজপুত রমণীর তেজস্বিতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বামীকে দ্বিধামুক্ত করেন। এখানে রাজপুত চরিত্রের দুই প্রান্ত, জয়সিংহ ও মহামায়ার মধ্য দিয়ে আলােকিত হয়েছে।
॥ চতুর্থ অঙ্ক ॥
প্রথম দৃশ্যঃ সুজার শিবির। যুদ্ধে যশােবন্ত সিংহের নিরপেক্ষ থাকা নিয়ে সুজা ও পিয়ারার আলােচনা চলে। যশােবন্ত সিংহ যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার সুবাদে পুরস্কার স্বরূপ পেয়েছেন। গুর্জর প্রদেশ। এদিকে সুজার জামাতা মহম্মদ তার পক্ষে যােগ দেওয়ায় বাদশাহী বাহিনী প্রাজিত হয়। কিন্তু ঔরংজীবের কূটনৈতিক চালে শেষপর্যন্ত মহম্মদ সুজার বিশ্বাস হারান। দিলদারের বয়ে নিয়ে যাওয়া একটি প্রতারণা পত্রের মাধ্যমে এই অঘটন ঘটে।
সাজাহান নাটকের ট্রাজেডি
দ্বিতীয় ও তৃতীয় দৃশ্যে করুণ রসের সৃষ্টি হয়েছে। দারা অসুস্থ নাদিরাকে নিয়ে জিহন বর বাড়িতে আশ্রয় নিলে দারার কাছে উপকৃত জিহন খাই বিশ্বাসঘাতকতা করে দারাকে ঔরংজীবের হাতে তুলে দেবার ষড়যন্ত্র করে। এখানেই নাদিরার মৃত্যু ঘটে। উপরন্তু বাদশাহী সৈন্য আসে ওদের বন্দী করতে। অকৃতজ্ঞ মা চরিত্রের দুৰ্জেয় রহস্যকেই এখানে তুলে রা হয়েছে জিহন খা চরিত্রটির মধ্য দিয়ে।
চতুর্থ দৃশ্যে মূল নাট্যদ্বন্দ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনার সমাবেশ ঘটানাে হয়েছে। ঔরংজীৱে সঙ্গে হাত মিলানােয় যশােবন্ত সিংহের পত্নী মহামায়া স্বামীর প্রতি ধিক্কার জানিয়েছে। এখানে নাট্যকার জনরুচির সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে এটিকে নাট্যপরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত করেছেন বলে মনে হয়।
পঞ্চম দৃশ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্বের ঘাতপ্রতিঘাত বন্দী সাজাহানের মধ্যে মূর্ত হয়ে উঠেছে। ঔরংজীবের হাতে দর ও সুর শােচনীয় পরিস্থিতিতে সাজাহানের পিতৃহৃদয় হাহাকার করে উঠছে, আবার অপরদিকে ঔরংজীবের খলতা, নৃশংসতায় তিনি হতচকিত, উন্মাদগ্রস্ত। নাটকের বিবদঘন পরিবেশ ঘনীভূত হয়েছে সাজাহান ও জাহানারার নিষ্ফল আর্তনাদে।
ষষ্ঠ দৃশ্যের মূল ঘটনা ঔরংজীবের বিবেক দংশনকে কেন্দ্র করে আবর্তিত হলেও শেষ পর্যন্ত দরর মৃত্যুদণ্ডে তিনি স্বাক্ষর করেন। এখানে ঔরংজীবের বিবেক দ্বন্দ্ব সাময়িক এবং অস্থায়ী হলেও ঔরংজীবের চরিত্রে নাট্যদ্বন্দ্ব সৃষ্টিতে তা সহায়ক হয়ে উঠেছে।
সপ্তম দৃশ্যে দারার মৃত্যুজনিত করুশ ঘটনার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। এই দৃশ্যে নিজের প্রাণের বিনিময়ে দারাকে বাঁচানাের সাধু সংকল্পে দিলদার চরিত্রের মহানুভবতা প্রকাশ পেয়েছে। আর শেষ মুহূর্তে ঘুমন্ত সিপারের কাছ থেকে দারার বিদায় নেওয়ার দৃশ্য অত্যন্ত মর্মবিদারক হয়ে উঠেছে।
॥ পঞ্চম অঙ্ক ॥
প্রথম দৃশ্য : দিল্লীর দরবার কক্ষে বিজয়ী সম্রাট ঔরংজীব পারিষদসহ সিংহাসনে উপবিষ্ট। যশােবন্ত সিংহ সম্রাটের সম্পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করেছেন। ভ্রাতা মােরাদ এবং বিদ্রোহী পুত্র মহম্মদ দুজনেই গােয়ালিয়র দুর্গে বন্দী। দারার পুত্র সােলেমানকে বন্দী অবস্থায় আনীত হলে সম্রাট প্রথমে তার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দেন। কিন্তু সেই মুহূর্তে দারার কন্যা জহরৎ বালক বেশে দরবার কক্ষে উপস্থিত হয়ে সম্রাটকে বধ করতে উদ্যত হলে সােলেমান তাকে বাধা দেন। ফলে সম্রাট পূর্বে দেওয়া সােলেমানের মৃত্যুদণ্ড প্রত্যাহার করে বন্দীত্বের আদেশ প্রদান করেন। ঘটনায় আরাে জানা যায় দারার মৃত্যুতে প্রজারা ক্ষিপ্ত হয়ে জিহন আলিকে হত্যা করে। সেই সংবাদ শুনে ঔরংজীব খুশী হন।
দ্বিতীয় দৃশ্য ও আরাকানের রাজপ্রাসাদ। এখানেই আশ্রয় পেয়েছেন সুজা ও পিয়ারা। কিন্তু আরাকান রাজ পিয়ারাকে দাবী করলে উভয়েই এ প্রস্তাবে অসম্মত হয়ে অবশিষ্ট চল্লিশজন দেহরক্ষী নিয়েই আরাকান রাজকে প্রতিরােধ করবার সংকল্প গ্রহণ করেন। পিয়ারা স্বামীর অনুগামিনী হয়ে যথার্থ সহধর্মিনীর কর্তব্য পালনে আগ্রহী হন।
সাজাহান নাটক
তৃতীয় দৃশ্যে এক দুর্যোগপূর্ণ রাত্রিকালে আগ্রার দুর্গে বন্দী সাজাহানের উন্মত্ত অবস্থা আবেগপূর্ণ সংলাপের মধ্য দিয়ে বর্ণিত হয়েছে। মৃত দারার জন্য অসহ্য শােকে সাজাহান ভেঙে পড়েছে। হৃতসর্বস্ব, ক্ষমতাচ্যুত পিতৃত্বের সাক্ষী জাহানারা ও জহরতের অসহায় বিলাপ ও হৃদয়হীন নিষ্ঠুর ঔরংজীবের প্রতি বিদ্বেষ এবং বিষােদ্গার সমস্ত পরিবেশকে শােকে ও দীর্ঘশ্বাসের কারুণ্যে মূর্ত করে তুলেছে।
চতুর্থ দৃশ্যে মােরাদের জীবন নাট্যের পরিসমাপ্তি দেখানাে হয়েছে। অপরদিকে গােয়ালিয়র দুর্গে মহম্মদ ও সােলেমান আশ্চর্য প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে।
নাটকটির পঞ্চম দৃশ্যে কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত ঔরংজীবের আত্মদহনের চিত্র উপস্থিত করা হয়েছে। এখানে ঔরংজীবের চরিত্রের মর্মবেদনাকে পাপের প্রায়শ্চিত করার সঙ্গে সমার্থক করে দেখানাে হয়েছে। ছদ্মবেশী বিদূষক দিলদারের কথার মধ্যে এই সুরই প্রতিধ্বনিত, আসলে যিনি এশিয়ার বিজ্ঞতম সুধী মির্জা মহম্মদ নিয়ামত খাঁ বলে পরিচিত।
নাটকটির শেষ দৃশ্যে অনুতপ্ত ঔরংজীব সাজাহানের নিকট ক্ষমাপ্রার্থী। তাঁর প্রার্থনা অপূর্ণ থাকে না। সাজাহান চরিত্রের মধ্যে যে সম্রাটসত্তা ও পিতৃসত্তার দ্বন্দ্ব চলছিল, পরিণামে পিতৃসত্তারই জয় ঘােষিত হয়েছে।