মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি নির্ণয় কর।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণগুলি নির্ণয় কর।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ গুলি নির্ণয় কর। এই পতনের জন্য অশোককে দায়ী করা যায় কি?
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের মূলে কি কি অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক কারণ পরিলক্ষিত হয়?
অথবা,
মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের মূল কারণগুলি সংক্ষেপে লিখ। “ব্রাহ্মণদের অসন্তোষ” এই পতনের জন্য কতটা গ্রহণযোগ্য?
উত্তর।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতন :
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ: চন্দ্রগুপ্ত, চাণক্য ও অশোকের অক্লান্ত প্রচেষ্টায় প্রায় সমগ্র ভারত জুড়িয়া এক বিশাল সাম্রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল। কিন্তু সম্রাট অশোকের মৃত্যুর কিছুদিন পর হইতে মৌর্য সাম্রাজ্য হীনবল হইয়া পড়ে এবং প্রায় পঞ্চাশ বৎসরের মধ্যেই এই সাম্রাজ্যের পরিসমাপ্তি ঘটে।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ: অশোকের বংশধরগণের সম্বন্ধে তথ্যের অভাব :
খ্রীষ্টপূর্ব ২৩৩ অব্দের কাছাকাছি কোন এক সময়ে সম্রাট অশোকের মৃত্যু হয়। তাঁহার বংশধরগণ সম্বন্ধে কোন সুনিশ্চিত বিবরণ পাওয়া যায় না। পুরাণ, রাজতরঙ্গিনী, বৌদ্ধগ্রন্থ প্রভৃতির পরস্পর-বিরোধী তথ্যের উপর নির্ভর করিয়া অশোকের উত্তরাধিকারীগণের রাজত্বকাল সম্বন্ধে কোন স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায় না। সম্ভবত অশোকের এক পুত্র জলৌক কাশ্মীররাজ্যের কর্তৃত্ব লাভ করেন এবং মৌর্বসাম্রাজ্যের অখণ্ডত! ধীরে ধীরে বিনষ্ট হইয়া পড়ে।
সাম্রাজ্য দ্বিধাবিভক্ত;
মগধের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত পরবর্তী মৌর্যরাজগণ ছিলেন অযোগ্য, অক্ষম ও অধার্মিক। ব্যাক্ট্রিয় আক্রমণকে প্রতিরোধ করিতে না পারার ফলে রাজ্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে দশম সম্রাট বৃহদ্রথকে তাঁহার সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ হত্যা করিয়া মগধের সিংহাসন দখল করেন এবং মৌর্যবংশের অবসান ঘটে (সম্ভবত খ্রীষ্ট পূর্ব ১৮৫ অব্দ)।
মৌর্বসাম্রাজ্যের পতনের কারণ :
ব্রাহ্মণদের অসন্তোষ:
মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের কারণ বিশ্লেষণ করিতে যাইয়া ঐতিহাসিকগণ একমত হইতে পারেন নাই। পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর মতে অশোক ও মৌর্য সম্রাটগণের প্রতি ব্রাহ্মণশ্রেণীর অসন্তোষই হইতেছে মৌর্যবংশের পতনের মূল কারণ। তাঁহার মতে জীবহত্যা নিবেধ, ধর্মমহামাত্র নিয়োগ, দণ্ডসমতা প্রবর্তন প্রভৃতি এই অসন্তোষ সৃষ্টি করিয়াছিল। কিন্তু ডক্টর রায়চৌধুরী ও রমেশ মজুমদার প্রমুখ ঐতিহাসিকগণ শাস্ত্রীর মত সমর্থন করেন না। তাঁহারা বলেন যে, অশোক মোটেই পরধর্ম সম্বন্ধে অসহিষ্ণু ছিলেন না, ব্রাহ্মণদিগকেও তিনি কোন সময় অশ্রদ্ধা প্রদর্শন করিতেন না। তাহাদের মতে অশোক অহিংসা-নীতি অনুসরণ করিয়াই প্রাণিহত্যা নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন এবং ইহা ব্রাহ্মণ অথবা অন্য কোন বিশেষ সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে আরোপিত হয় নাই। ইহা ভিন্ন বহু প্রাচীন কাল থেকেই ব্রাহ্মণগণও প্রাণিহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ
‘জানাইয়াছিলেন। ধর্মমহামাত্রদের নিয়োগ ও কার্যকলাপ প্রসঙ্গে বলা যায় যে, অশোক সকল সম্প্রদায় থেকেই ধর্মমহামাত্র নিয়োগ করিতেন এবং জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সকল সম্প্রদায়ের মঙ্গল সাধন করাই ধর্মমহামাত্রদের মূল কর্তব্য ছিল। পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ব্রাহ্মণ ছিলেন বলিয়াই ব্রাহ্মণশ্রেণীর উত্থান ঘটিয়াছিল একথা মনে করিবার কোন যুক্তি নাই।
অশোকের দায়িত্ব; সামরিক শক্তি ক্ষুণ্ণ:
সঙ্গে সঙ্গে উপরি-উক্ত ঐতিহাসিকগণ অশোকের দায়িত্ব একেবারে অস্বীকার করেন নাই। অশোক ‘ভেরীঘোষের’ পরিবর্তে ‘ধর্মঘোষের’ যে নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন তাহার ফলে দেশের সামরিক শক্তি ক্ষুণ্ন হইয়া পড়িয়াছিল। এমন কি তিনি তাঁহার বংশধরগণকেও ‘ধর্মবিজয়ের’ নীতি অনুসরণ করার নির্দেশ দেন। সামরিক শক্তির দুর্বলতাহেতু দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা বৃদ্ধি পাইয়াছিল এবং সেইজন্যই বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরোধ করা যায় নাই।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ
অশোকের অন্যান্য ত্রুটি:
ডক্টর রায়চৌধুরী অশোকের আরও দুইটি ত্রুটির কথা উল্লেখ করিয়াছেন। তিনি বলেন যে, দূরবর্তী প্রদেশসমূহে রাজকর্মচারীদের হাতে বেশী মাত্রায় ক্ষমতা তুলিয়া দিয়া তিনি কেন্দ্রে বিরোধীশক্তি পরিপুষ্ট করিয়াছিলেন। তাহা ছাড়া, তিনি অতিরিক্ত দানধ্যান করিয়া জনসাধারণের এবং দেশের অর্থনৈতিক ক্ষতিসাধনও করিয়াছিলেন।
সাম্রাজ্যের বিশালতা:
শুধুমাত্র সামরিক শক্তির দুর্বলতা নয়, আরও কতকগুলি অভ্যন্তরীণ কারণেও মৌর্যসাম্রাজ্যের দ্রুত পতন ঘটিয়াছিল। (১) ইহার মধ্যে একটি হইল সাম্রাজ্যের ভৌগোলিক স্ফীতি। দূরবর্তী প্রদেশগুলির সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের অভাবে কেন্দ্রীয় আধিপত্য বজায় রাখা সব সময় সম্ভব হইত না। (২) তাহা ছাড়া অশোকের বংশধররা ছিলেন দুর্বল এবং অক্ষম। সাম্রাজ্যের গভীর সংকট মুহূর্তে আসন্ন ভাঙ্গন প্রতিরোধ করার মত শক্তি তাহাদের ছিল না ।
মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের অর্থনৈতিক কারণ
অর্থনৈতিক অবনতি:
(৩) অর্থনৈতিক অবনতি মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের অপর একটি কারণ ছিল। এক বিরাট সামরিক বাহিনীর ভরণ-পোষণ, বিশাল সংখ্যক কর্মচারীদের বেতন দান ইহার ফলে রাজকোষের উপর চাপ সৃষ্টি করিয়াছিল। অপর একটি অর্থনৈতিক গলদ হইল সাম্রাজ্যের সর্বত্র অর্থনীতির মান সমতুল ছিল না তাই অর্থনৈতিক ভারসাম্য বিঘ্নিত হয়।
শাসনকর্তাদের অত্যাচার ও ক্ষমতালিপ্সা:
(৪) দূরবর্তী প্রাদেশিক শাসনকর্তাগণ হইয়া উঠিয়াছিল ক্ষমতালিপ্স এবং অত্যাচারী। সুযোগ পাইলেই তাহারা সাম্রাজ্যের সহিত বন্ধন ছিন্ন করিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করিত। কেন্দ্রীয় শাসনের দুর্বলতার সুযোগে অন্ধ্র, কম্বোজ, চোল, পাণ্ড্য, সত্যপুত্র, কেরলপুত্র প্রমুখ স্বতন্ত্র জাতি ও উপজাতিগুলি বিদ্রোহী হইয়া উঠে এবং স্বাধীন রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করে।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ
(৫) অশোকের বংশধরগণের দুর্বলতার সুযোগে রাজসভাতেও উচ্চপদস্থ রাজকর্মচারীগণের মধ্যে স্বার্থের সংঘাত ও হানাহানির সূত্রপাত হইয়াছিল।
(৬) সাম্রাজ্যের এই দুর্বল অবস্থায় বৈদেশিক ব্যাক্ক্ট্রীয়গণের আক্রমণ দেশের অবস্থাকে আরও রাজসভায় স্বার্থের সংঘাত বৈদেশিক আক্রমণ জটিল করিয়া তোলে।
মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের প্রত্যক্ষ কারণ :
শেষ মৌর্যসম্রাট বৃহদ্রথকে হত্যা করিয়া সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্যযুগের অবসান ঘটাইলেন (১৮৫ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দ)। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে, তথাকথিত
ব্রাহ্মণশ্রেণীর ষড়যন্ত্রের ফলে পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ক্ষমতা দখল করেন নাই। মোৰ্যসাম্রাজ্যের দুর্বলতার সুযােগে তিনি ব্যক্তিগত ক্ষমতালিপ্সা চরিতার্থ করেন। যাহা হউক, পুষ্যমিত্র শুঙ্গের বিদ্রোহকে মৌর্যসাম্রাজ্যের পতনের আসন্ন কারণ বলা যায়।
অনেক ঐতিহাসিক বলেন যে, সাম্রাজ্য মাত্রেরই উত্থান ও পতন ঘটিয়া থাকে এবং সেই অমােঘ নীতি অনুসারেই মৌর্যসাম্রাজ্যেরও পতন হইয়াছিল। সম্রাট অশােক যদি সামরিক শক্তিতে দিগ্বিজয়ের নীতি অনুসরণ করিয়া যাইতেন তাহা হইলেও এই সাম্রাজ্যের একদিন-না-একদিন পতন হইত। কিন্তু তিনি যে ধর্ম বিজয়ের মহান্ নীতি অনুসরণ করিয়াছিলেন তাহার আদর্শ ও কীর্তি আজও ম্লান হয় নাই।
প্রশ্ন । চলগু-মৌর্য এবং অশােকের সঙ্গে গ্রীকদের সম্পর্ক পর্যালােচনা কর।
মৌর্ষসাম্রাজ্যের পতনের কারণ
উত্তর।
মৌর্যযুগে ভারতের সঙ্গে বিদেশের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। এই সময়ে পশ্চিম-এশিয়া ও দক্ষিণের দেশগুলির সঙ্গে যােগাযােগ গড়িয়া ওঠে।
সিংহাসন আরােহণ করিবার পরই চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্য পাঞ্জাব ও সিন্ধু অঞ্চলের গ্রীক শাসকদেব সঙ্গে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হইলেন। আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর তাহার সেনাপতি সেলুকাস সাম্রাজ্যের পূর্বাংশের অধিপতি হন এবং ভারতে গ্রীক আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য তিনি খ্রীষ্ট পূর্ব ৩০০ অব্দে অগ্রসর হইলেন। এইভাবে চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্যের সঙ্গে সেলুকাসের সংঘর্য দেখা ল। সেলুকাস পরাজিত হইয়া চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্যের সঙ্গে সন্ধি করিতে বাধ্য হন এবং এমনকি বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হন। চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্য কাবুল, কান্দাহার, হীরাট, বেলুচিস্তান লাভ করিয়া উত্তে-পশ্চিম অঞ্চলে সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত করিলেন।
৩০৫ খ্ৰীষ্ট পূর্বাব্দের পর চন্দ্রগুপ্ত-যৌর্য সিরিয়ায় গ্রীকদের সঙ্গে সম্প্রীতির নীতি গ্রহণ করেন ।সিরিয়ার গ্রীক অধিপতি সেলুকাসের দূত মেগাস্থিনিস কিছুদিন চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্যের দরবারে অবস্থান কনে। মৌর্য শাসন-পদ্ধতি ও ভারতীয় জনসমাজ সম্পর্কে এক মনােজ্ঞ বিবরণ তাহার রচিত “ইন্ডিকা” গ্রন্থে পাওয়া যায় । যেগাস্থিনিসের বিব্রণ হইতে জানা যায় যে, রাজধানী পর্টিলিপুত্রের যে পূর্বসংস্থা ছিল তাহার অন্যতম দায়িত্ব ছিল বিদেশীদের তত্ত্ববধান করা।
চন্দ্রগুপ্তের উত্তরাধিকারী বিন্দুসারও গ্রীকদের সঙ্গে শান্তি ও সদ্ভাব বজায় রাখিয়াছিলেন। সিরিয়ার অধিপতি অ্যান্টিকোস ভাইমেকস নামে এক গ্রীককে রাষ্ট্রদূত রূপে মৌর্য দরবারে পইয়াছিলেন। এক রাজাদের সৌজন্যের প্রতিদানে বিন্দুসারও সিবিয়া ও মিশরে রাষ্ট্রদূত বিনিময় করেন।
পরবর্তী মৌর্য সম্রাট অশােক বহির্জগতে শান্তি ও মৈত্রীর নীতি অনুসরণ করেন। প্রথমত, তিন পিতা ও পিতামহের ন্যায় গ্রীক নৃপতিদের সঙ্গে সম্প্রীতি ও সদ্ভাব বজায় রাখিতে সচেষ্ট ।
দ্বিতীয়তঃ, ধর্ম বিজয় নীতি রূপায়ণের জন্যও অশােক বহু ধর্মপ্রচারক গ্রীক শাসিত দেশগুলিতে পাঠাইয়াছিলেন। এয়ােদশ শিলালিপি (Rock Edict XIII) হইতে জানা যায়, অশােঙ্গে প্রকাশ সিরিয়া, মিশর, সাইরিন, এপিরাস, ম্যাসিড এই পাচটি শ্রীক রাজ্যে ধর্মের বাণী প্রচার করেন এবং সাফল্য অর্জন করে। অশােকেব এই দাবি সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ যোগ্য, মনে না ইলেও ইহা অনস্বীকার্য যে, খ্রীষ্টীয় দ্বিতীয় শতকের পূর্বে গ্রীক রাজ্যগুলিতে বৌদ্ধধর্ম সম্পূর্ণ অজ্ঞাত ছিল। আশােকের প্রচেষ্টায় এই সব রাজ্যে প্রথম বৌদ্ধধর্মের বাণী সম্প্রসারিত হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য, যদিও গ্রীক রাজ্যগুলি অশােকের ধর্ম চিরস্থায়ীভাবে গ্রহণ করেন, কিন্তু ডঃ ভাণ্ডারকর ও অধ্যাপক ম্যাক্সমুলার মনে করেন যে, পশ্চিম-এশিয়া আলােতে উদার ও শান্তিকামী মতের প্রভাব সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করিতে পারে নাই এবং পরবর্তী কালে এই অঞ্চলে উদ্ভূত খ্রীষ্টান ধর্মের উপর বৌদ্ধধর্মের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
পশ্চিম এশিয়ায় ধর্মপ্রচারের ফলে সাংস্কৃতিক ও তার্থনৈতিক দিক দিয়া ভারত ও গ্রীক রাজ্যগুলির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পশ্চিম এশিয়ার গ্রীক রাজ্যগুলির সঙ্গে ভারতের গভীর বাণিজ্য-সম্পর্ক গড়িয়া উঠে। মিশরের অধিপতি টলেমি ফিলাডেলকাস ভারতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বাণিজ্যিক-সম্পর্ক বৃদ্ধি করিবার উদ্দেশ্যে মিশরে নূতন নূতন বাণিজ্য বন্দর স্থাপন করেন। সাংস্কৃতিক দিক হইতেও ভারতের সঙ্গে গ্রীক রাজ্যগুলির ঘনিষ্ঠ যােগসূত্র দেখা যায়। অশােকের সময়ে নির্মিত বিভিন্ন সৌধস্কৃপের মধ্যে গ্রীক শিল্পকলার সাদৃশ্য রহিয়াছে। প্রখ্যাত গবেষক স্যার জন মার্শালের মতে মৌর্য শিল্পকলায় পারসীক ও গ্রীক রীতিনীতির সংমিশ্রণ ঘটিয়াছিল। সারনাথের স্তম্ভের কারুকার্যে গ্রীকপ্রভাব পরিলক্ষিত হয়।
এইভাবে দেখা যায়, মৌর্যযুগে বিশেষত চন্দ্রগুপ্ত, বিন্দুসার ও অশােকের সময় ভারত ও গ্রীক রাজ্যগুলির মধ্যে রাজনৈতিক, ধর্মীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক যােগসূত্র গড়িয়া উঠিয়াছিল এবং দুইটি সভ্যতা সমৃদ্ধ হইয়াছিল।
লক্ষামূলক প্রশ্ন ও উত্তর
প্রশ্ন () আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন কে মগধের রাজা ছিলেন? তিনি কেন ও কিভাবে সিংহাসনচ্যুত হন?
উত্তর। ম্যাসিডনরাজ আলেকজান্ডার যখন ভারত আক্রমণ করেন তখন মগধের রাজা ছিলেন ধননন্দ
। তিনি অত্যন্ত ধনলিঙ্গু ও অত্যাচারী হওয়ার জন্য জনপ্রিয়তা হারান। প্রজাবর্গের আসন্তোষের সুযােগ লইয়া চন্দ্রগুপ্ত-সৌর্য ঢাণক্য নামক এক ব্রাহ্মণ পরামর্শ দাতার সহায়তায় নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধন করেন।
(প্রশ্নঃ) কোন প্ৰসিদ্ধ সম্রাট “দেবানাং প্রিয় প্রিয়দর্শী অভিধা গ্রহণ করেন? তার সম্পর্কে সবচেয়ে নির্ভরযােগ্য ঐতিহাসিক উপাদান কি?
উত্তর। ভারতের শ্রেষ্ঠ সম্রাট মহান অশোক এই অভিধা গ্রহণ করিয়াছিলেন। তাহার সময়কালের সর্বাপেক্ষা নির্ভরযােগ্য ও উল্লেখযােগ্য ঐতিহাসিক উপাদান হইল তাহার বিভিন্ন শিলালিপিগুলি।
(প্রশ্নঃ) মৌর্য রাজাদের মধ্যে কে অমিত্রঘাত’ উপাধি গ্রহণ করেন? তার সাথে মিশর ও সিরিয়ার গ্রীক রাজাদের সম্পর্ক কেমন ছিল?
উত্তর। চন্দ্রগুপ্ত-মৌর্যের পুত্র বিন্দুসার ‘অমিত্রঘাত’ বা শনিধনকারী উপাধি গ্রহণ করেন। তিনি পিতার নীতি ও সাম্রাজ্য অক্ষুন্ন রাখিয়াছিলেন। তাহার সহিত মিশর ও সিরিয়ার গ্রীক রাজাদের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ ছিল। মিশর রাজ দ্বিতীয় টলেমি ও সিরিয়ার অধিপতি এন্টিমিেকস যথাক্রমে ডেইমেকস্ ও ডায়ােনিসাসকে বিন্দুসারের রাজসভায় রাজপূত হিসাবে পাঠান।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র।
উত্তর। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র মৌর্যযুগের ইতিহাস রচনায় অবশ্য প্রধান ঐতিহাসিক উপাদান; বিশেষত মৌর্য শাসনব্যবস্থার সম্পর্কে নির্ভরযােগ্য তথ্যাদি এই গ্রন্থে পাওয়া যায়। অর্থশাস্ত্রের লেখক ও ইহার রচনাকাল সম্পর্কে বিভিন্ন মতামত প্ৰচালত আছে। কিথ, উইন্টারনি প্রমুখের মতে কৌটিল্য ও চাণক্য ইহার প্রণেতা নহেন এবং গ্রন্থটি পরবর্তী কোন সময়ে রচিত হইয়াছিল। ধ্যাপক ব্যাসাম মনে করেন যে, গ্রন্থটি নিশ্চিত ভাবে গুগুপূর্ব যুগে প্রণীত হয়। কিন্তু ফ্লিট, জয়সােয়াল প্রমুখের মতে অর্থশাস্ত্র চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য কর্তৃক রচিত হইয়াছিল। কিন্তু পরবর্তী যুগে ইহাতে কিছু নৃতন তথ্য সংযােজিত হয়।
(প্রশ্নঃ) ধর্মমহামাত্র কে ও কেন নিয়ােগ করেন?
উত্তর। অশােক ধর্মনীতি প্রয়ােগ করিবার জন্য ধর্মমহামাত্র নামক এক শ্রেণীর রাজকর্মচারী ‘নিয়ােগ করেন। ধর্মমহামাত্রগণের প্রধান দায়িত্ব ছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থান পরিভ্রমণ করিয়া জনসাধারণের নিকট ধর্মীয় আচরণ ও নৈতিক জীবনের উৎকর্ষ ব্যাখ্যা করা। নারীদের মধ্যেও অনুরূপ ধর্মীয় চেতনা সৃষ্টির জন্য ও তাহাদের নৈতিক সাধনের জন্য স্ত্রী-অধ্যক্ষ মহামাত্রদের নিয়ােগ করা হইত।
(প্রশ্নঃ) তৃতীয় বৌদ্ধ-সংগীতি কে, কোথায় ও কেন আহ্বান করেন?
উত্তর। বৌদ্ধধর্মের বিশুদ্ধতা ও বৌদ্ধ সংগঠনের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখিবার উদ্দেশ্যে সম্রাট অশোেক আনুমানিক ২৫১ খ্রীষ্টপূর্বাব্দে এই বৌদ্ধ মহাসভা আহ্বান করেন। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন মােগালিপুত্ত। এই সভার সিদ্ধান্ত সারনাথ, স্তম্ভলিপিতে উৎকীর্ণ করা হইয়াছিল।
মৌর্যসাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে ছিলেন
(প্রশ্নঃ) মৌর্যসাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট কে ছিলেন? তিনি কি ভাবে ক্ষমতাচ্যুত হন?
উত্তর। পুরাণ ও বাণভট্ট রচিত ‘হর্ষচরিত’ হইতে জানা যায় যে, বৃহদ্রথ ছিলেন মৌর্য বংশের শেষ সম্রাট।
তিনি ১৮৫ খ্রীষ্ট পূর্বাব্দে সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ কর্তৃক নিহত হন। এইভাবে মৌর্যসাম্রাজ্যের অবসান ঘটে।