সোনার তরী কবিতার প্রশ্ন উত্তর Teacj Sanjib
সোনার তরী কবিতার প্রশ্ন উত্তর Teacj Sanjib
সোনার তরী কাব্য
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)
সােনার তরী কবিতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
সোনার তরী কবিতার মূলভাব এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নোত্তর আলোচনা করা হয়েছে।
প্রশ্ন ও উত্তর
সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা
সােনার তরী
প্রশ্ন ।। তোমার পঠিত কবিতা অবলম্বনে ‘সোনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা বিচার কর।
অথবা, ‘সােনার তরী’ কাব্যগ্রন্থের পাঠ্য কবিতাগুলি অবলম্বনে ‘সোনার তরী কাব্যগ্রন্থের নামকরণের সার্থকতা প্রতিপন্ন করে।
উত্তর : রবীন্দ্রনাথের গ্রন্থগুলির নামকরণ বিচার করলে দেখা যাবে যে কবি এবিষয়ে বিশেষ কোনাে একটি পদ্ধতি অবলম্বন করেন নি। কি তাঁর গল্প উপন্যাসে, কি তাঁর কাব্যগ্রন্থে সহজে তার মনে যখন যে নাম এসেছে—তাই দিয়ে তিনি সেই বই চিহ্নিত করেছেন; ফলে কোনাে গ্রন্থের নাম বাড়তি তাৎপর্য এসেছে, রূপক আশ্রিত হরেছে, কখনাে একেবারে সাধাসিধে শীর্ষমান হয়েছে। রূপক নাটকের নামকরণে কবি যে সতর্কতা নিয়েছিলেন, কাব্যগ্রন্থের ক্ষেত্রে তেমন কোনাে মনােভাবের পরিচয় পাওয়া যায় না তাঁর।
‘সেনার তরী’ নামকরণের মধ্যে যথার্থ কিছুর কারণ আছে কিনা তা দেখা আমাদের উচিত। মনে হয় তরণী কখনাে সােনা দিয়ে তৈরী হয় না। আর তা হলেও, তাকে জলে ভাসানাে চলে না, কারণ সােনার তরণী জলে ভাসে না; অচিরেই তা ডুবে বাবে। সুতরাং সােনার তরীর আক্ষরিক অর্থ বাস্তব সত্যের সঙ্গে কখােনােই সাযুজ্য রক্ষা করছে না। বস্তুসত্তায় যখন স্বর্ণনির্মিত তরী নেই, তখন ‘সােনার তরী বলার একটা ব্যঞ্জিত অর্থের সুচনা হয়েছে। কবির রােমান্টিক মানসপ্রবণতার প্রকাশ ঘটেছে এই নামে। কবি কল্পনায় সৌন্দর্যের অনুসন্ধানে এক মায়াময় অলৌকিক জগতের আভাস ফুটে উঠেছে ; কবির কাছে আধাে-চেনা আধাে-অচেনা বিদেশিনী এসেছে, সৌন্দর্বের দেশে কবি ছুটেছেন; মাটির সঙ্গে এক রহস্যময় আত্মীয়তা অনুভব
করেছেন কবি। সবই তাঁর রােমান্টিক মানসিকতার ফসল। বিদেশিনী নাবিকের তরণীর বর্ণও হিরণ। এই গ্রন্থের প্রথম কবিতার নাম ‘সােনার তরী কিংবা ঐ ‘সোনার তরী’ নামের কবিতার জন্যেই গ্রন্থের এই নামকরণ হয়েছে কিনা তা সঠিক ভাবে নির্ণয় করা কঠিন।
কৈশােরে রবীন্দ্রনাথ একদা বিহারীলাল চক্রবতীর ভাবনার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন বলে শােনা যায়। প্রেম-সৌন্দর্যের উপাসক কবি ছিলেন বিহারীলাল । তার একটি গানের দুটি পঙক্তির কথা এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, সেই দুটি পঙক্তি হলাে—‘সােনার তরী নয়নে নাচে নাচে, পা না দিতে ডুবে আচম্বিতে। এই দুই পঙক্তির মধ্যে একটা সৌন্দর্য-কল্পনার কথা রয়েছে। সােনার তরীতে পা দিতে পারা যায় না, পা দিলেই তৎক্ষণাৎ তা ডুবে যায়। অর্থাৎ আদর্শলােকের এই সুন্দর কল্পনা তরণী—যা হিরণ-নিমিত—তাতে পার্থিব বস্তুর কোনাে ভার চাপানাে যাবে না। এই আদর্শ লোকের ব্যাখ্যা হিসেবে আমরা রহস্যময় প্রেম ও সৌন্দর্যের বিষয়কে ধরতে পারি, অন্তত, রবীন্দ্রনাথের মনে এই রকম একটা আদর্শ সোনার তরীর কল্পনা গড়ে তুলতে পারে। বাস্তবের সংস্পর্শে এলে সৌন্দর্যের জগৎ নষ্ট হয়, প্রেমের অলৌকিকত্ব যায় হারিয়ে। এই বােধের পরিপােষকতা রয়েছে ‘নিরুদ্দেশ যাত্রা’ কবিতায় —সেটিকে আমরা ‘সােনার তরী’ কবিতার পরিপুরক হিসাবে গণ্য করতে পারি। সােনার তরী এমনই যে, বাস্তব জগতের আঘাত সে সহ্য করতে পারে না। এই কাব্যে প্রেম ও সৌন্দর্য কল্পনায় রবীন্দ্রনাথ এমনই একটি আদর্শের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত-ও নিয়েছেন যেদিক থেকে এই গ্রন্থের নামকরণে এই ব্যাঙ্গার্থ দ্যোতিত হচ্ছে।
সােনার তরী
এ ছাড়া ‘সােনার তরী’ গ্রন্থের অনেক কবিতাতেই স্বর্ণবর্ণের কল্পনা রয়েছে। এই সময়ে কবির মনে সোনার রঙের বর্ণাঢ্যতা অপূর্ব আমেজর সষ্টি করেছিল। স্বর্ণবর্নকে তিনি বিশিষ্ট সৌন্দর্য-কল্পনার দ্যোতক বলে ভেবেছেন, কাব্যখানির নাম রেখেছেন ‘সােনার তরী’। এমন কি ধানও হয়েছে সােনার (তামারই সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’)।
দ্বিতীয় কবিতা ‘বিম্ববতী’তেও দেখি রাণী কোলের ওপর ‘সূবর্ণমুকুট’ রেখেছেন। সোনার বাধান’ কবিতাতেও সােনার উল্লেখ। পরশপাথর’ কবিতাতেও ‘নিকষে সােনার রেখা রয়েছে। সন্ধ্যার বর্ণনাতেও স্বর্ণেরর উপমান ।
আকাশ সােনার বর্ণ, সমুদ্র গলিত স্বর্ণ,
পশ্চিমদিগ্বধু দেখে সােনার স্বপন।
‘দুই পাখি’ কবিতায় সােনার খাঁচায় থাকা পাখিকেও আমরা দেখতে পেয়েছি। আকাশের চাঁদ’ কবিতাতেও রয়েছে সােনার ক্ষেত্রে কৃষাণ বসিয়া কাটিতেছে পাকা ধান’। এই কবিতায় আরাে একটি পঙক্তি হলাে ‘অত রবির সোনার কিরণে নটুন বরণে লেখা।’…‘সােনার জীবন রহিল পড়িয়া, কোথা যে চলিল ভেসে। ‘মানস সুন্দরী কবিতার মদিরাটুকু পর্যন্ত সূবর্ণ মদিরা হয়েছে। সন্ধ্যার রঙ স্বর্ণবর্ণ উষারও তাই :
সন্ধ্যার কনকবর্ণে রাঙিহ অঞ্চল ; উষার গলিত স্বর্ণে গড়িছ মেখলা;
প্রভাতের বর্ণনা বা সন্ধ্যার বর্ণনায় সােনার উল্লেখ প্রায় সব কবিতাতেই স্বর্ণ এই সময়ে রবীন্দ্রনাথের মনকে আপ্লুত করে রেখেছে, যা-কিছু বস্তু—তাতে কল্পনার খর-কিরণপাত হওয়ায় তা স্বর্ণবর্ণের রােমান্টিক চেতনায় উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই প্রেম ও সৌন্দর্যের স্বপ্নকে, কবি বর্ণ রঙীন ঔজ্জ্বল্যে ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। তাই তরী সােনার, প্রেমের অভিজ্ঞানও হিরণবর্ণের ঔজ্জ্বল্যে ঝলােমলো। এই জন্যে বলা যায় যে বহিরঙ্গের অর্থে ‘সোনার তরী’র যতটুকু; মুল্য থাক, অন্তরঙ্গে ‘সােনার তরী একটি ব্যগিত অর্থ বহন করেছে। এদিক থেকে দেখলে ‘সােনার তরী’ কাব্যটির নামকরণ সার্থক হয়েছে বলা চলে।
সোনার তরী কবিতার সৃজনশীল প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্ন ৩। সােনার তরী’ কবিতাটির রূপকার্থ বিশ্লেষণ করিয়া উক্ত কবিতাটির অন্তনিহিত তাৎপর্য আলােচনা কর।
অথবা ‘সােনার তরী’ কবিতাটিকে রূপক কবিতা বলা হয়ে থাকে। তোমার মত কী ? কবিতাটিকে ব্যাখ্যা কর।
উত্তর : কবির মনােজগতে অনেক সময় এমন সব ভাবনা-চিন্তার উদয় হয় সেগুলিকে সহজ ভাষায় প্রকাশ করা যায় না; করার চেষ্টা করলে, সেগুলি পাঠক-পাঠিকাদের কাছেই যে কেবল দুর্বোধ্য বলে মনে হয় তা নয়, কবি নিজেও কেমন যেন একটা অস্বস্তি বােধ করেন। নিজের চিন্তাকে বহুমনের কাছে পৌছিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে গিয়েই কবিকে রূপকের আশ্রয় নিতে হয়। সেই চেষ্টারই ফসল রবীন্দ্রনাথের ‘সােনার তরী’ কবিতা।
এখানে রবীন্দ্রনাথ যে রূপকটি গ্রহণ করেছেন সেটি হচ্ছে একটি কৃষক আর একটি মাঝির রূপক। কঠোর পরিশ্রম করে চাষীটি মাঠে চাষ করছে । সোনার ধানে ভরে গিয়েছে তার মাঠ, সেই ধান কেটে নদীর ধারে চাষীটি চুপ করে বসে রয়েছে নৌকার আশায়। সেই নৌকাতে চাপিয়ে তার সােনার ধানগুলিকে সে ঘরে বয়ে নিয়ে গিয়ে তার নিজের মরাই-এর মধ্যে রেখে দেবে। এতেই তার আনন্দ।
নৌকার অাশায় নির্জন নদীর কুলে একা বসে-বসে চাষীটি যখন হতাশ হয়ে পড়েছে এমন সময় হঠাৎ তার চমক ভাঙলো। সে দেখলো একজন মাঝী মনের আনন্দে গান গাইতে গাইতে সোনার তরী বেয়ে তারই দিকে এগিয়ে আসছে। চাষীটির মনে হলে নাবিকটিকে সে চেনে; কিন্তু মাঝির চোখ মুখে তাকে চেনার কোনাে চিহ্নই ফুটে ওঠনি। তবু তার কাতর আহবানে সে তীরে নৌকা ভিড়ালো; গভীর আনন্দে চাষীটি তার সব ধান সেই নৌকায় তুলে দিল। আশা ছিল মাঝিটি তাকেও তুলে নিয়ে যাবে। কিন্ত মাঝির সাফ জবাব এলাে; ঠাই নাই, ঠাঁই নাই, ছোট সে তরী। আর হতভাগ্য চাষী? তার সমস্ত পরিশ্রমের ফসল নৌকার ওপর তুলে দিয়ে শুন্য নদীর চরে একালা রইলো পড়ে। চাষীটির আর্তনাদ শুন্য নদীর তীরে নিজেকে কেন্দ্র করেই মূর্ছাহত হয়ে পড়লাে।
এখানে কবিই হচ্ছেন সেই চাষী যিনি সমস্ত জীবন ধরে তার কাব্যক্ষেতে ফসল ফলান। আর মাঝিটি হচ্ছে মহাকাল। মানুষ কাজ করে ; সে ভাবে সুকর্মের জোরে বিশ্বের মধ্যে সে একটা নাম রেখে যাবে। কিন্তু তা হয় না। মানুষের কাজটাই জগত গ্রহণ করে, মানুষকে নয়। রবীন্দ্রনাথ নিজেই বলেছেন : সংসার আমাদের জীবনের সমস্ত কাজ গ্রহণ করে না। আমাদের চিরজীবনের ফসল যখন সংসারের নৌকায় বােঝাই করিয়া দিই তখন মনে আশা থাকে যে আমারও এই সঙ্গে স্থান হইবে; কিন্তু সংসার আমাদিগকে দুই দিনেই ভুলিয়া যায়। ভুলে না গিয়ে উপায় কী? সংসারে এত স্থান কোথায় যে শত লক্ষ কোটি মানুষকে তার স্মৃতির যাদুঘরে স্থান দেবে ? সুতরাং সােনার তরীতে কবির জন্যে যে স্থান হবে না তা তাে জানা কথা। কিন্তু, কবির মনতো তা বোঝে না। মহাকালরূপক মাঝি তাকে প্রত্যাখান করলাে দেখে কবির আত্মা আর্তনাদ করে উঠলাে। তিনি বিমষ চিত্তে বলে উঠলেন।
শ্রাবণগগন ঘিরে/ঘনমেঘ ঘরে ফিরে শুন্য নদীর তীরে/রহিনু পড়ি
যাহা ছিল নিয়ে গেল সোনার তরী।
সোনার তরী কাব্য
এ শুধ; কেবল কবিরই নিজস্ব আর্তনাদ নয়; এ হচ্ছে মানবাত্মার আর্তনাদ। মানুষের ব্যর্থ দম্ভের আর্তনাদ। ফসল আমার ; আমাকে বাদ দিয়ে আমার ফসল নেওয়া চলবে না; কিন্ত, মহাকাল উদাসীন। মানুষের ওপরে তার বিন্দুমাত্র লােভ নেই; লােভ তার মানুষের কর্মের ওপরে। গীতাতেও এই কথাটাই বলা হয়েছে । তুমি কাজ করে যাও; ফলের প্রত্যাশা করাে না। এই নিরাসক্তিই কর্মীকে কর্ম করার প্রেরণা যােগায়।
‘সােনার তরী’ কবিতাতে রবীন্দ্রনাথ একটি রূপকের মাধ্যমে সেই কথাটিই ব্যক্ত করতে চেয়েছেন। শুন্য নদীর চর’। বিপুল তার নিঃসঙ্গতা ; কাঁধের ওপরে সােনার ফসলের বোঝা ; ‘আধাে চেনা মাঝি’ আর ‘সােনার তরী’। কিন্তু বােঝা হালকা করলে তো মানুষের চলে না। যদিও কবিতাটির মধ্যে কবিমনের একটি করুণ অর্তিই প্রকাশ পেয়েছে, তবু তার বােঝা হালকা হওয়ার জন্যে একটা স্বস্তির নিঃশ্বাসও যে পড়েছে সেটা বুঝতেও আমাদের অসুবিধে হয় না। কবি বুঝেছেন তার ফসল বিশ্ববাসীর মহাকাল যার রূপক। তার শ্রমের ফসল তার নয়। তার রােদন বৃথা, হাহাকার তার ব্যর্থ।
সোনার তরী কবিতার জ্ঞানমূলক প্রশ্ন
প্রশ্নঃ।। সােনার তরী’ কবিতাটির অন্তর্নিহিত তত্ত্ব নানাভাবে ব্যাখ্যাত হয়েছে সে বিষয়ে সংক্ষেপে আলােচনা কর। তত্বকে অতিক্রম করে এই কবিতাটি কতখানি রসোতীর্ণ হয়েছে সে বিষয়ে তোমার মতামত ব্যক্ত কর।
অথবা,‘সোনার তরী’ কবিতাটি একটি তত্ত্বৰাশ্রয়ী কবিতা’-আলােচনা কর।
উত্তর : রবীন্দ্রজীবনীকার শ্রদ্ধেয় প্রভাতকুমার মুখােপাধ্যায় বলেছেন, মানসী কব্যি গুচ্ছের শেষ কবিতা রচনার প্রায় পনেরাে মাস পরে শিলাইদহে কবি লিখিলেন ‘সােনার তরী’ (১২৯৮ ফাল্গুন) যদিও উহা লােকচক্ষুর গোচর হয় প্রায় দেড় বৎসর পরে। কী কুক্ষণে তিনি যে কবিতাটি লিখিয়াছিলেন তাহা তাহার ভাগ্য-বিধাতা জানেন। নইলে এই কবিতা লিখিত হইবার পর প্রায় চৌদ্দ বৎসর পরে ইহাকে কেন্দ্র করিয়া বাংলার সাময়িক-সাহিত্য যে পরিমাণে রস ও বিষ সাধিত হইয়াছিল, তাহা রবীন্দ্রনাথের কোনাে একটি কবিতা সম্বন্ধে পুর্বে বা পরে কখনাে হয় নাই।”
রবীন্দ্রনাথ কবিতাটি রচনার প্রায় সতের বৎসর পরে অর্থাৎ বিতর্ক আরম্ভ হওয়ারও থেকে কিছু পরে নিজেও একটা ব্যাখ্যা দেন। তাতে তিনি বলেছেন, “মানুষ সমস্ত জীবন ধরে ফসল চাষ করছে। তার জীবনের ক্ষেতটুকু, দ্বীপের মতো, চারদিকেই অব্যক্তের দ্বারা সে বেষ্টিত, ঐ একটুখানিই তার কাছে ব্যর্থ হয়ে আছে | যখন কাল ঘনিয়ে আসছে, যখন চারিদিকের জল বেড়ে উঠছে, যখন আবার অব্যক্তের মধ্যে তার ঐ চরটুকু, তলিয়ে যাবার সময় হ’ল, তখন তার সমস্ত জীবনের কর্মের যাকিছু নিত্য ফল তা সে ঐ সংসারের তরণীতে বােঝাই করে দিতে পারে। সংসার সমস্তই নেবে, একটি কণাও ফেলে দেবেনা—কিন্তু যখন মানুষ বলে ‘ঐ সঙ্গে আমাকেও নাও’, ‘আমাকেও রাখাে’, তখন সংসার বলে, তােমার জন্য জায়গা কোথায় ? তােমাকে নিয়ে আমার হবে কি ? তোমার জীবনের ফসল যা-কিছ; রাখবার তা সমস্তই রাখব, কিন্তু তুমি’ত রাখার যােগ্য নও।”
কবি-সমালােচক মোহিতলাল মজুমদার ‘সােনার তরী’ কবিতার কোন কোন সমালোচকের কিছ, কিছ, মন্তব্য আংশিক ভাবে উদ্ধৃত করে দেখিয়েছেন। কারও কারও মতে কবিতাটি শুধ, দুর্বধ্য নয়, অর্থহীনও। শ্রাবণ মাসে কোথাও ধান পাকে না, কেউ সে-সময়ে ধান কাটেও না। সােনার ধান নেই, সােনার তরীতে কোন চাষী ধান কাটতে যায় না। পালে ভর করে যখন নৌকা চলে তখন দাঁড়টানা হয় না। তাই সে সমর ‘তরী বাওয়া’ কথাটা অবান্তর। আবার কোন কোন সমর্থক সমালােচক ‘সােনা মুখী চালের কথা শুনিয়ে বললেন যে, ধান এরপ সময়েই কাটা হয়। সাহিত্য সমালােচনা সমর্থকও বিরােধীদলের দ্বন্দ্বে পরিণত হয়েছিল।
মােহিতলাল বলেন যে, কবিতাটিতে শুধু রস সৃষ্টি নয়—একটা অর্থও আছে। কবিহৃদয়ের একটা বিশেষ অনুভতি কবিতাটিতে প্রকাশ পেয়েছে। তিনি আরও বলেন
রচনার দোষ বা গুণ এই যে, উহাতে একটা রপকের ঠাট আছে—অথচ সেই রূপক সর্বাংশে একটা রূপ হইয়া উঠে নাই। কবি মানসের একটা ভাবাময় situation বা অন্তর সঙ্কট। বাহিরের কবির ভাষায় নাটটিকৃত হইতে চাহিয়াছে কিন্তু, সেই ছবিও ছবি না হইয়া ইঙ্গিতময় হইয়াছে—ছবির দিক দিয়াও একটা পৃথক অর্থ’ সম্পূর্ণতা উহাতে নাই।”
কবি একটা চরের মধ্যে একদা পদ্মার জল ঢুকতে দেখিলেন। দেখেছিলেন সে সময় বিষন্ন মুখে কৃষকের কাঁচা ধান কেটে নিয়ে যাচ্ছে নৌকা ভরে। চাষীদের সেই ট্রাজেডির কথা কবির মনে ছিল। এই ঘটনাকে ভিত্তিমুলে রেখে অধ্যাপক প্রমথনাথ বিশী সোনার তরী’ কবিতাটি বুঝবার চেষ্টা করেছেন। তার মতে, “সােনার তরী প্রারম্ভে অবস্থিত হইয়া কবির মানব-প্রীতির সুরটি ধরাইয়া দেয়।”
অধ্যাপক বিশী কবিতাটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলেছেন : কবি তার এক আঁটি সােনার ধন লইয়া নিজের জীবনের ক্ষুদ্র ঘাটটিতে ক্ষুদ্রতর অভিজ্ঞতার দ্বারা বেষ্টিত হইয়া বসিয়া আছেন। সম্মুখের কালস্রোতে জগতের বৃহৎ জীবনযাত্রার প্রতি ধাবিত,–কবি এই বৃহৎ জীবনের জন্য উৎসুক। মাঝি নৌকা তীরে ভিড়ইল । কবির ধান, তাঁহার সাধারণ ফসল—একাত্ম হইয়া যাহা তাঁহার গণ্ডিবদ্ধ করিয়া রাখিয়াছিল। মাঝি তাহা তুলিয়া লইল। কিন্ত; সাধকের স্থান আর হইল না। কবিতাটির প্রাণ এই করুণ রসের। কবির দুঃখ কিসের! এতদিন নদীকুলে যাহা লইয়া তিনি ভুলিয়া ছিলেন তার সমস্তই সােনার তরীর মাঝি তুলিয়া লইয়া গেল। এই প্রিয়বস্ত; বিচ্ছেদের দুঃখ কবির।
সোনার তরী কবিতার মূলভাব
ভাবসংক্ষেপ : শ্রাবণ আকাশে ঘন ঘন মেঘ ডাকছে, নদীকুলে শুন্য মন নিয়ে নিঃসঙ্গ কবি বর্ষার দৃশ্য দেখছেন, মনে কোন ভরসার চিহ্ন নেই ; রাশি রাশি ধান কাটা হলো, ধান কাটতে কাটতে নামল বর্ষা। নদী কানায় কানায় পূর্ণ হলাে, নদীতীরে ক্ষুদ্র এক ভূমিখণ্ডে একটি ছােট ক্ষেত; নদী তাকে বেষ্ঠন করে বয়ে যাচ্ছে। কবি একলা ওই ক্ষেতের ধারে বসে আছেন। চারিদিকে বাঁকা জল সর্পিল গতিতে ছুটছে। ফুর পরপারে তরুছায়া বেষ্টিত একখানি গ্রাম অস্পষ্টভাবে চোখে পড়েছে।
এমন সময় কবি যেন দেখলেন–তরী বেয়ে গান গাইতে গাইতে কে যেন এ পারে
আসছে। আগন্তককে কবির অপরিচিত বলে মনে হলাে। সে কোনো দিকে না তাকিয়ে পালতােলা নৌকায় ভেসে যাচ্ছে। কবি তাকে ব্যাকুল কণ্ঠে ডাকলেন—সে
যেন একবার কবির কাছে এসে তীরে নৌকা ভেড়ায়। ‘অচেনা সেই মাঝি কবির ডাকে সাড়া দিয়ে কবির কাছে এল ; কবি অনুরােধ করলেন, মাঝি যেন কবির সঞ্চিত সােনার ধান তার নৌকায় তুলে নেয়। কবি এতকাল নদী তীরে বসে যত সােনার ধান আহরণ করেছেন এই বিদেশী মাঝির নৌকাতে সব তুলে দিলেন, এবং সব শেষে প্রার্থনা জানালেন যেন নৌকাতে কবিকেও তুলে নেওয়া হয়, যেন একটা জায়গা করে দেওয়া হয় কবির জন্যে।
কিন্তু কবির প্রার্থনা পূর্ণ হলো না। কবির সোনার ধানেই নৌকা বােঝাই হয়ে
গেলো, আর জায়গা নেই। শূন্য নদীর তীরে একলা পড়ে রইলেন কবি। তাঁর সােনার ফসল তুলে নিয়ে মাঝি নৌকা নিয়ে চলে গেল কবিকে পিছনে ফেলে রেখে।
সোনার তরী কাব্যের মূলভাব
সোনার তরী কবিতার আবেদন
কবিতাটিতে বর্ষার পটভূমি সর্বাগ্রে আমাদের মনকে নাড়া দেয়। পদ্মাতীরে শ্রাবণ আকাশ ঘিরে যখন নিবিড় মেঘ জমে, ধারাবর্ষণ শরু হয় নির্জন নদীতীরে, জলে ডুবু ডুবু ক্ষেতের ছােট ভুমিখণ্ডে ব্যাকুল কৃষকের পরপারে যাওয়ার জন্যে প্রতীক্ষা, দুরে পরপারে তর ছায়া বেষ্ঠিত মসীমাখা গ্রামের ছবি —সব মিলিয়ে কবিতাটিকে অপরুপ সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে। এর সঙ্গে মিলেছে কবি-হৃদয়ের বেদনাময় ব্যাকুলতা, কবি একলা বসে আছেন, কোনাে ভরসা নেই তাঁর মনে। চেনা-অচেনার মধ্যবর্তিনি এক মূর্তির আবিভাব কবির এই ব্যাকুল অর্তিকে আরও করুণ করে তুললো। কবির মনে জাগলাে মিলন পিপাসা, সৌন্দর্যলোকে যাবার বাসনা। তাই সোনার তরীর নেয়ের কাছে আকুল প্রার্থনা এখন আমাকে লহ করুণা করে। কিন্তু কল্পনার সৌন্দর্যের যে অধিলক্ষীকে আমরা , দেখি তার সঙ্গে মিলিত সম্ভব নয় ; তাই বিরহ মর্মান্তিকভাবে উপস্থিত হতে বাধ্য। ফলে কবিকেই ব্যর্থ ও নিরাশ হতে হয়েছে। সুতরাং কবিতাটির মধ্যে চিত্ররস ও গীতধনির মধযে অপূর্ববতা লাভ করেছে এর কারুণ্যের মধ্যে।