বহুরূপী গল্পের প্রশ্ন উত্তর দশম শ্রেণীর বাংলা Teacj Sanjib
বহুরূপী গল্পের প্রশ্ন উত্তর দশম শ্রেণীর বাংলা Teacj Sanjib
বহুরূপী
সুবোধ ঘোষ
বহুরূপী গল্পের উৎস, বিষয়বস্তু এবং কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্তর আলোচনা করা হয়েছে।
বহুরূপী গল্পের প্রশ্ন উত্তর দশম শ্রেণীর বাংলা Teacj Sanjib
বহুরূপী গল্পের উৎস
সুবােধ ঘােষের রচিত ‘বহুরূপী’ গল্পটি লেখকের ‘গল্পসমগ্র’ গ্রন্থ থেকে সংকলিত।
বহুরূপী গল্পের বিষয়বস্তু
বিষয়-সংক্ষেপ
শহরের সবচেয়ে সরু গলির সবচেয়ে ছােট্ট একটি ঘরে বহুরূপী হরিদার আবাস। তার সংসার বলতে সে একা। চাকরি-বাকরি করার যােগ্যতা ও সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও তা করেন না। গতানুগতিক জীবনযাপন, বাঁধাধরা নিয়মের বাঁধনে জীবনাচরণ তার স্বভাববিরুদ্ধ। মাঝে মাঝে বহুরূপী সেজে যৎসামান্য আয়ে দিন চালানােয় অভ্যস্ত হরিদা। তিনি কখনও বাউল, কখনও কাপালিক, কখনও বোঁচকা কাধে বুড়াে কাবুলিওয়ালা, একবার তাে পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর বাগানে চার স্কুলপড়ুয়া লিচু চোরকে ধরে হেডমাস্টারের কাছ থেকে সামান্য কিছু পয়সা পেয়েছিলেন। একবার তাে রূপবতী বাইজি সেজে অপূর্ব নাচের ভঙ্গিমায় শহরের পথচলতি মানুষজনকে মুগ্ধ করেছিলেন। সেবার বেশ কিছু আয়ও হয়েছিল তার। আর-একবার কোট-প্যান্ট-পরা ফিরিঙ্গি সাহেব সেজে সকলকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন।
কয়েকটি কমবয়সি যুবক বহুরূপী হরিদার ঘরে সকাল-সন্ধেয় আড্ডা দিত। তারাই বহুরূপী গল্পের কথক। তারাই গল্পের ছলে ধনী জগদীশবাবুর বাড়িতে হিমালয় থেকে আগত এক সন্ন্যাসীর কথা শুনিয়েছিল হরিদাকে। সেই সন্ন্যাসী নাকি একটিমাত্র হরিতকী খেয়ে সারাবছর কাটিয়ে দেন। তার বয়স নাকি হাজার বছরের। হরিদা তার ২ পায়ের ধুলাে নেওয়ার প্রত্যাশী হতে, কথকরা শুনিয়েছে তার পায়ের ধুলাে নাকি খুবই দুর্লভ। তার পায়ে সােনার বােল লাগানাে খড়ম পরাতে গিয়ে জগদীশবাবু কোনােরকমে পায়ের ধুলাের অধিকারী হন। সন্ন্যাসীর বিদায়ের সময় ভক্ত জগদীশবাবু কৃপণ হওয়া সত্ত্বেও একশাে টাকা সন্ন্যাসী ঠাকুরের ব্যাগের মধ্যে দিয়ে দেন।
গল্প শােনার পর উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হরিদা গল্পকথক যুবকদের সন্ধ্যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে হাজির থাকার কথা বলেন। আরও জানান যে, বহুরুপীর সাজে হাজির হয়ে তিনি এমন কিছু করবেন, যাতে তাঁর সারা বছর চলার মতাে অর্থ উপার্জিত হবে। যুবকেরা হরিদার কথা মতাে স্পাের্টসের চাদা আদায়ের অছিলায় জগদীশবাবুর বাড়ির বারান্দায় হাজির। জগদীশবাবু চেয়ারে উপবিষ্ট। হঠাৎ সিড়ির দিকে তাকিয়ে জগদীশবাবু বিস্মিত।
উপস্থিত কথক যুবকেরাও হতবাক। সিঁড়ির কাছে এসে যে দাঁড়িয়েছে সে ঠিক পরিচিত সন্ন্যাসীর মতাে বেশভূষায় নেই। তার জটাজুট নেই, কমণ্ডলু নেই, মৃগচর্ম নেই, গৈরিক পােশাক নেই। আদুড় গা, তার ওপর একটি সাদা উত্তরীয়, পরনে ছােটো সাদা থান, ধুলােমাখা পা, মাথায় ফুরফুর করে উড়ছে শুকনাে সাদা চুল। কথকরাও তাদের অতিপরিচিত হরিদাকে ছদ্মবেশী বলে মনে করতে পারছে না। এমন সুন্দর ও নিখুঁত সন্ন্যাসীর বেশে হরিদা হাজির। তার ঝােলায় একটি গীতা। তা ঝােলা থেকে বের করে হাতে নিয়েছেন। শান্ত-সমাহিত মূর্তির যােগী মানুষ যেন। যেন জগতের সীমার ওপর থেকে তিনি সমাগত।
সন্ন্যাসীবেশী হরিদার উপস্থিতিতে জগদীশবাবুর বারান্দায় এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ বিরাজ করছে। তার দু-চোখের শান্ত-সমাহিত দৃষ্টি, জ্ঞানগর্ভ কথা, সর্বোপরি তার নির্লোভ আচরণতার চরিত্রকে এক উন্নত মাত্রায় উন্নীত করেছে। তিনি জগদীশবাবুর দেওয়া প্রণামীর অর্থ গ্রহণ করেননি। তিনি পরে কথকদের বলেছেন জগদীশবাবুর কাছে একদিন গিয়ে বকশিশের টাকা চেয়ে আনবেন। সন্ন্যাসীর প্রণামী নয়, বহুরূপীর যেটুকু প্রাপ্য সেটুকুই।
বহুরূপী গল্পের নামকরণের সার্থকতা
নামকরণ
সাহিত্যেনামকরণগভীরশিল্পবােধকেতুলেধরে। চরিত্রকেন্দ্রিক, কাহিনিনির্ভর, রূপকধর্মী বা ব্যঞ্জনাময় নামকরণ মূলত সাহিত্যে লক্ষ করা যায়। সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পে বহুরূপী হরিদার কথাই আদ্যন্ত পরিবেশিত হয়েছে। শহরের সবচেয়ে সরু গলির ছােট্ট একটা ঘরে থাকা বহুরূপী সাজা হরিদার ঘরেই গল্পের সূচনা।
কথাপ্রসঙ্গে কথকেরা জগদীশবাবুর বাড়িতে আসা এক সন্ন্যাসীর চমকপ্রদ কথা উত্থাপন করেন। সেই সন্ন্যাসীর প্রতি ধনী ভক্ত জগদীশবাবুর মহার্ঘ উপহার প্রদানের কথা শুনে হরিদাও কিছু বেশি প্রাপ্তির আশায় তার বাড়িতে বহুরূপী সেজে যেতে চান। এর আগে শহরে কখনও উন্মাদ সেজে, কখনও বা রূপবতী বাইজি, আবার কখনও বাউল, কাপালিক, কাবুলিওয়ালা ইত্যাদি সেজে হরিদা যৎসামান্য উপার্জন করতেন।
বিরাগী সেজে হরিদা জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হয়ে অদ্ভুত এক ভাবগম্ভীর পরিবেশ সৃষ্টি করেন। বহুরূপী হরিদার শান্ত সমাহিত দৃষ্টি, জ্ঞানগর্ভ কথাবার্তা, নির্লোভ আচরণ গল্পে এক অন্য মাত্রা আনে। জগদীশবাবুর প্রদেয় একশাে এক টাকার প্রণামীকে উপেক্ষা করেন দরিদ্র বহুরূপী হরিদা। গল্পের কথকেরাও বিরাগীর মধ্যে হরিদাকে আবিষ্কার করে চমৎকৃত হন। হরিদাও বহুরূপী সাজে বিরাগীর মধ্যে নিজের নির্লোভ মানসিকতাকে আবিষ্কার করেন।
কাহিনির শুরু হয়েছিল বহুরূপীর এক চিলতে ঘরে, সমাপ্তিও সেখানেই। সমস্ত কাহিনিতে বহুরূপী হরিদার বিচিত্র কার্যকলাপ পরিবেশিত হয়েছে। তাকে কেন্দ্র করে কাহিনির সূচনা, অগ্রগতি ও সমাপ্তি। তাই বহুরূপী এই চরিত্রনির্ভর নামকরণ সার্থক ও যথাযথ।
বহুরূপী গল্পের বড় প্রশ্ন উত্তর
প্রশ্নঃ ।। “খাটি মানুষ তাে নয়, এই বহুরুপীর জীবন এর বেশি কী আশা করতে পারে?” –বহুরুপী জীবনের এই ট্র্যাজেডি পাঠ্য বহুরূপী’ গল্প অবলম্বনে আলােচনা করাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ ছছাটোগল্পে বহুরূপীর পেশা নেওয়া হরিদার দারিদ্র্যপূর্ণ জীবনের কথা আছে। শহরের সবচেয়ে সরু গলির মধ্যে ছােট্ট একটি ঘরে হরিদা বাস করেন। দরিদ্র এই মানুষটি প্রথাগত কোনাে পেশাকে আঁকড়ে ধরেন না। নিয়ম মেনে কাজ করা সম্ভব হয় না বলে দারিদ্র্য হরিদার নিত্যসঙ্গী। তবে বহুরূপী সেজে হরিদা জীবনে কিছু বৈচিত্র্যও আনেন। উন্মাদ, কাপালিক, ফিরিঙ্গি বা রূপসিবাইজি সেজে কায়ক্লেশেদিনতার অতিবাহিত হয়। এই হরিদাই কথকদের মুখে ধনী মানুষ জগদীশবাবুর সন্ন্যাসীপ্রীতি ও সেইসূত্রে মহার্ঘ উপহার প্রদানের কথা জানতে পেরে তার বাড়িতে এক সন্ধ্যায় যন বিরাগী সেজে।
বিরাগী সাজা হরিদার অদ্ভুত সাজপােশাক, আচরণ দেখে মনে হয় চেনা পৃথিবীর পরিচিত মানুষ নন তিনি। তার শান্ত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি, উচ্চস্তরের কথাবার্তায় মােহিত হয়ে জগদীশবাবু একশাে এক টাকা তীর্থযাত্রার পাথেয় হিসেবে দিতে চাইলে বিরাগী অনায়াসে তা উপেক্ষা করে চলে যান।
কথকের পরে তাকে এ বিষয়ে অনুযােগ করলে হরিদা জানান বিরাগী স্যজার বকশিশ তিনি জগদীশবাবুর কাছ থেকে নিয়ে আসবেন একদিন। এই সময় বিড়ি ধরিয়ে সলজ্জ হরিদা বলেন যে যেহেতু তিনি খাটি মানুষ নন, নিতান্ত এক সাধারণ হুরূপী; তাই এর বেশি আশা করেন না। তথাকথিত উচ্চমানের পেশ না হওয়ার যন্ত্রণা বহুরুপী সাজা হরিদাকে কষ্ট দেয়। বহুরুপীর মতাে নিতান্ত সাধারণ জীবিকা হরিদাদের কখনােই স্বপ্ন দেখায় না, সমাজে উচ্চ মর্যাদা দেয় না। কঠিন জীবন সংগ্রামে অভ্যস্ত দরিদ্র হরিদা এই বাস্তব সত্যকে বােঝেন বলেই যন্ত্রণাদায় কথাগুলি বলেন।
বহুরূপী গল্প
প্র) “অদৃষ্ট কখনও হরিদার এই ভুল ক্ষমা করবে ।”—হরিদা কী ভুল করেছিলেন? অদৃষ্ট ক্ষমা না করার পরিণাম কী?
উওর : বহুরূপী হরিদাকে বিরাগী ছদ্মবেশে দেখে, তাকে যথার্থ { বিরাগী ভেবে জগদীশবাবু তীর্থভ্রমণের জন্য যে একশাে এক টাকা দিয়েছিলেন হরিদা তা প্রত্যাখ্যান করেছেন। তাঁর এই কাজ ক্ষমার অযােগ্য ভুল বলেছেন গল্পকথক।
অদৃষ্টহরিদারএইভুলকেকখনওক্ষমাকরবেনা।কারণএইভুলটাই হরিদার জীবনদর্শন। ভুলের সংশােধন আছে, কিন্তু জীবনদর্শনের পরিবর্তন সহজে ঘটে না। হরিদা স্বভাবশিল্পী মানুষ। তাই তাে কাজের একঘেয়েমি, ঘড়ির কাঁটার শাসন মেনে চলেত তাঁর প্রবল আপত্তি। পাখির গানে যেমন কোনাে অনুশাসন থাকে না, মেঘের কারুকাজ যেমন অনুশাসনমানেনা, তেমনিহরিদামুক্তপ্রাণ মানুষ। অর্থসওয়ের স্বার্থবুদ্ধি তার মােটেই নেই। বহুরূপীর সাজগ্রহণ তাঁর পেশা হলেও মূলত নেশা।শুধুঅর্থউপার্জনের জন্য তিনি সাজগ্রহণকরেননা।এই সাজগ্রহণ তার জীবনের শিল্প। এই শিল্পের মূল্যায়নের মধ্যেই তার জীবনের স্বার্থকতা নিহিত আছে। দারিদ্রতাকে কোনাে দিন দীন করতে পারেনি। তার সততা, ন্যায়-নিষ্ঠাকে নষ্ট করতে পারেনি। বস্তুত দারিদ্র্য তার খুব একটা সহ্যাতীত কিছু নয়। যার ফলে জগদীশবাবুর বাড়িতে যে ভুল ঘটে গেল সে ভুল তার বার বার ঘটবে। অর্থউপার্জনের পথগুলি চিরকাল অবরুদ্ধ থাকবেতার কাছে। সম্পদলক্ষ্মী কোনােদিন সুপ্রসন্না হবেন না। কোনাে দিন শেষ হবেনা তার দারিদ্র্যে ভরা জীবন। অদৃষ্ট ফিরবে না কখনও।
প্রশ্নঃ) জগদীশবাবুর-বাড়িতে হরিদা বিরাগী সেজে যাওয়ার পর যে ঘটনা ঘটেছিল তা সংক্ষেপে লেখাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা বিশেষ উদ্দেশ্যে বিরাগীর ছদ্মবেশে জগদীশবাবুর বাড়িতে হাজির হয়েছিলেন। আদুড় গায়ে একটি ধবধবে সাদা উত্তরীয়। পরনে ছােটো বহরের একটি গান। মাথায় ফুরফুরে শুকনাে সাদা চুল। ধুলাে মাখা পা। হাতের ঝোলায় একটি গীতা। একেবারে পুরােদস্তুর বিরাগী। তাঁকে দেখে জগদীশবাবু চমকে ওঠেন। চমকে ওঠেন সেখানে হাজির হরিদার বন্দুরাও। হরিদাকে দেখে মনে হচ্ছিল তিনি যেন এই জগতের সীমার ওপার থেকে হেঁটে আসছেন। কিংকর্তব্যবিমূঢ় জগদীশবাবু নেমে না এসেই আহ্বান জানালে হরিদা তাকে ভৎসনা করেন। তাঁর সম্পত্তির অহংকারকে কটাক্ষ করেন। জগদীশবাবুপরাধ স্বীকার করে নিয়ে বিরাগীবেশী হরিদাকে রাগ করতে বারণ করেন। হরিদা জানান । যে, তাঁর রাগ নামে কোনাে রিপু নেই। জগদীশবাবু তার সেবা করতে ? চাইলে তিনি এক গ্লাস ঠান্ডা জল শুধু পান করেন। তার গৃহে কয়েকটা দিন থেকে যেতে বললে তিনি হেসে সে অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করেন।
ভাবাবেগবিহ্বল জগদীশবাবু যেনতেনপ্রকারের্তাকে কিছু দিতে চেয়ে ব্যর্থ হন। জগদীশবাবুর মনের শান্তির জন্য উপদেশ হিসেবে বিক বলেন যে, ধন-জন-যৌবন আসলে কিছুই নয়, ওগুলি এক-একটি সুন্দর সুন্দর বঞ্চনা। যাকে পেলে সব পাওয়া হয়ে যায় সেই ঈশ্বরের আপন হওয়া প্রয়ােজন।
বিরাগী ব্যক্তিতে, জ্ঞানের গভীরতায় মহত্ত্বে আবেগের চরম সীমায় পৌঁছে গিয়ে একশাে এক টাকার প্রণামী দিতে চেয়েছিলেন। জগদীশবাবু, কিন্তু বিরাগীর কাছে টাকা আর মাটিতে তফাত নেই। মাটি মাড়িয়ে যাওয়ার মতাে করে একশাে এক টাকার থলিটা সিড়ির ওপরে রেখে নানান সংশয় আর বিস্ময়ের মধ্যে সবাইকে রেখে হরিদা বেরিয়ে আসেন।
প্রশ্ন) “হরিদার উনানের হাঁড়িতে অনেকসময় শুধু জল ফোটে, ভাত ফোটে না।’-অংশটির তাৎপর্য লেখাে।
উত্তর : শহরের সরু গলির মধ্যে থাকা অতিশয় ছােটো একটি ঘরে থাকেন বহুরূপী হরিদা। অতিশয় দরিদ্র হলেও কোনাে ধরাবাঁধা কাজে নিজেকে জড়িয়ে রাখেন না। কোনাে অফিস কিংবা দোকানে কাজ করার সুযােগ থাকলেও তিনি তা করেন না।
বহুরূপী হরিদার মধ্যে শিল্পীসত্তা প্রবলভাবে উপস্থিত। বহুরূপী সেজে সকালে কিংবা সন্ধ্যার সময় শহরের পথে বেরিয়ে পড়েন। কিছু রােজগারের আশায়। কখনও উন্মাদ সেজে বাসযাত্রীদের ভয় দেখান, কখনওবা অন্য কিছু সাজেন। একবার এক রূপবতী বাঈজী সেজে প্রায় নাচতে নাচতেশহরের পথেযখন হেঁটে যান, তখনশহরে আসা নতুন লােকেরামুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। বাউল, কাপালিক, বোঁচকা কাধে বুড়াে কাবুলিওয়ালা, কোট-প্যান্ট পরা ফিরিঙ্গি সাহেব সাজেন বহুরূপী হরিদা। একবার পুলিশ সেজে দয়ালবাবুর লিচু বাগানের ভিতরে দাঁড়িয়ে স্কুল পালানাে চারটে ছেলেকে ধরে মাস্টারমশাইয়ের কাছ থেকে সামান্য টাকাও নিয়েছিলেন হরিদা। এক ধরনের সৎ মনােবৃত্তি তার মধ্যে রয়েছে। তাই জগদীশবাবুর বাড়িতে ‘জবর খেলা দেখিয়েও বিপুল অর্থপ্রাপ্তির সুযােগকে দারিদ্র্য। তার উনুনে চাপানাে হাঁড়িতে অনেক সময় চাল থাকে না, হেলায় তুচ্ছ করেন। তাই বহুরূপী সাজা হরিদার জীবনে শুধুই শুধু গরম জলই ফোটে।
বহুরূপী গল্প
প্রশ্নঃ।। “হরিদার জীবনে সত্যিই একটা নাটকীয় বৈচিত্র্য আছে।’—হরিদার পরিচয় দাও। তার জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্যের দিকটি ব্যাখ্যা করাে।
অথবা, খুব গরীব মানুষ হরিদা।’—হরিদা কে ছিলেন? তার জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্য কী ছিল?
উত্তর : প্রখ্যাত লেখক সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পের প্রধান চরিত্র হরিদা। তিনি নেশা এবং পেশায় বহুরূপী। শহরের সবচেয়ে সরু গলির ভিতরে ছােট্ট একটি ঘরে হরিদার বসবাস। তিনি এতটাই দরিদ্র যে অন্নাভাবে মাঝে মাঝেই উপােষ করেন। একঘেয়ে অভাবটাকে। তিনি সহ্য করতে পারেন তবুও একঘেয়ে কাজ করায় তাঁর প্রবল আপত্তি। হরিদা ইচ্ছে করলে কোনাে অফিসের কাজ কিংবা কোনাে দোকানে বিক্রিওয়ালার কাজ পেয়ে যেতে পারেন। কিন্তু এই ধরনের কাজ তাঁর পছন্দ নয়। ঘড়ির কাঁটার শাসন মেনে, রােজই একই কাজ করে যাওয়া স্বভাবশিল্পী হরিদার পক্ষে সম্ভব নয়।
অভাবের নিদারুণ দংশন হরিদার হৃদয়ের শিল্পীটাকে মােটেই আহত করতে পারে না। বিচিত্র শিল্পভাবনায় তিনি তাঁর মুক্ত বিহঙ্গ হৃদয়টিকে বৈচিত্র্যের সন্ধানে বর্ণময় করে রাখেন। বহুরূপী হিসেবে সাজ এবং অভিনয়ে একদম নিখুঁত শিল্পী তিনি। দুপুরবেলা চকের বাসস্ট্যান্ডে উন্মাদ পাগলের বেশে তিনি একেবারে আতঙ্কের হল্লা বাজিয়ে দেন। ভয়ে যাত্রীরা চেঁচিয়ে ওঠে নতুবা পয়সা ছুড়ে দেয়। লাস্যময়ী বাইজির ছদ্মবেশে শহরে নতুন আসা মানুষদের বুকে ঢেউ তুলে ঘুঙুরে মিষ্টি রুমঝুম শব্দ তুলে নাচতে নাচতে চলে যান। পুলিশের ছদ্মবেশে দয়ালবাবুর লিচু বাগানে দাঁড়িয়ে থেকে চারটি ছাত্রকে ধরে স্কুলের মাস্টারের কাছ থেকে ঘুষ আদায় করে নেন। হরিদার জীবনের নাটকীয় বৈচিত্র্যের চরমতম রূপটি দেখা যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে। বিরাগীর ছদ্মবেশে ধনবান জগদীশবাবুকে তিনি মুগ্ধ করে ফেলেন, কিন্তু তাকে প্রকৃত বৈরাগী ভেবে আবেগাপ্লুত জগদীশবাবুকে একশাে এক টাকা তীর্থভ্রমণের জন্য দিলে তিনি স্পর্শ করেও দেখেননি। কারণ বিরাগী ছদ্মবেশে তিনি অর্থ স্পর্শ করতে পারেন না। এতে তার ঢং নষ্ট হয়ে যায়। তবে বকাশিশ তিনি অবশ্যই নেবেন।
প্রশ্নঃ) এই শহরের জীবনে মাঝে মাঝেই অদ্ভুত ঘটনা সৃষ্টি করেন হরিদা।’-হরিদা যে অদ্ভুত ঘটনাগুলি সৃষ্টি করেছিলেন তার বর্ণনা দাও।
উত্ত: সুবােধ ঘােষের ‘বহুরূপী’ গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র হরিদা বর্ণময় চরিত্রের একজন ভাবশিল্পী মানুষ। বহুরূপীর ছদ্মবেশ ধারণ তার নেশা এবং পেশা। যে-কোনো ছদ্মবেশে তিনি এতাে স্বাভাবিক ” বাস্তবসম্মত হয়ে ওঠেন যে তাকে কেন্দ্র করে অদ্ভুত অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটে যায়।
চকের বাসস্ট্যান্ডের কাছে একদিন দুপুরবেলা উন্মাদ পাগলের ছদ্মবেশে একটা আতঙ্কের হল্লা তুলেছিলেন। মুখ থেকে লালা ঝরছে, চোখ দুটি কটকটে লাল, কোমরে একটা ছেড়া কল। জড়ানাে। গলায় টিনের কৌটোর একটা মালা। একটা থান ইট তুলে বাসের যাত্রীদের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন। যাত্রীরা তাকে দেখে কেউ ভয়ে চেঁচিয়ে উঠছে, কেউবা দুটো-একটা পয়সা ফেলে দিচ্ছে।
একদিন সন্ধ্যায় ঘুঙুরের মিষ্টি রুমঝুম শব্দ তুলে এক বুক বাইজির ছদ্মবেশে দোকানে দোকানে ব্যস্ত লােকজনকে বিস্মিত করে নাচতে নাচতে হেঁটে যান। শহরে নতুন আসা মানুষগুলি চোখ বলে করে চেয়ে থাকে। তারপর তাকে একটা বহুরূপী জেনে হতাশ হয় হরিদা দোকানে দোকানে মুচকি হেসে চোখ টিপে ফুলসাজি এগিয়ে দিয়ে পয়সা তােলেন।
তার সাজের শেষ নেই। বাউল, কাপালিক, বুড়াে কাবুলিওয়ালা, ফিরিঙ্গি কেরামিন সাহেব ইত্যাদি যে-কোনাে ছদ্মবেশে শহরের মানুষকে মাৎ করে দেন তিনি। পুলিশ সেজে একবার দয়ালবাবুর লি বাগানে দাঁড়িয়ে থেকে স্কুলের চারটা ছেলেকে তিনি ধরেছিলেন। ভয়ে ছেলেগুলি কেঁদে ফেলেছিল। স্কুলের মাস্টার এসে নকল পুলিশ হরিদার কাছে ক্ষমা চেয়ে, আট আনা ঘুষ দিয়ে ছেলেগুলিকে ছাড়িয়ে নিয়ে যান। পরে প্রকৃত ঘটনা জানতে পেরে ক্রুদ্ধ না হয়ে বহুরূপী হরিদার প্রশংসাই করেন।
বহুরূপী গল্পের প্ৰশ্ন উত্তর 2023
প্রশ্নঃ) পরম সুখ কাকে বলে জানেন? সব সুখের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যাওয়া।–বক্তা কখন এই উক্তি করেন? তার জীবনেও কী এই বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা যায় যুক্তিসহ লেখাে।
উত্তর : সুবােধ ঘােষের বহুরূপী’ গল্পে হরিদা বিরাগীর ছদ্মবেশে জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত হলে তার সাজ-পােশাক, ভাবমূর্তি দেখে জগদীশবাবু চমকে যান। চমকে যান স্বয়ং গল্পকথক ও তাঁর বন্ধুরাও। বিরাগীবেশী হরিদার ভাষাও তার ভূমিকাকে উজ্জ্বল করে তােলে। মুগ্ধ জগদীশবাবু এই বিরাগীকে সেবাদানের ইচ্ছা প্রকাশ করেন। গল্পকথকের বন্ধু ভবতােষও তাকে প্রকৃত বিরাগী হিসাবেই গণ্য করেন। মােট কথা সেই সন্ধ্যায় জগদীশবাবুর বাড়িতে উপস্থিত সকলেই তাকে শান্ত-সৌম্যকান্তি, সংসারত্যাগী, সর্বত্যাগী, জ্ঞান, বিরাগী বলেই মনে করেন। এই অবস্থায় হরিদা এই উক্তি করেন।
হরিদার এই উক্তি ছদ্মবেশী বিরাগীর চরিত্রের মুখের মানানসই একটি উক্তি হলেও তাঁর জীবনদর্শনে এর প্রতিফলন দেখা যায়। হরি স্বভাবশিল্পী মানুষ। কাজের একঘেয়েমি, আর ঘড়ির কাঁটার শাসন মানতে পারেন না বলে দারি) নিত্যসঙ্গী। বহুরূপীর সাজ দেখিয়ে যে সামান্য উপার্জন হয় তাতে তাঁর হাঁড়ির দাবি মেতে । মাঝে মাঝে উপােষ করতে হয় তাকে। তবে সংসারের দৈন তার অন্তরকে দীন করতে পারেনি। বহুরূপী হিসেবে তার সাজের
প্রতিটা চরিত্রের মর্যাদা তিনি অক্ষুন্ন রেখে চলেন। কোনাে ধরনের প্রতারণা করেন না। তার বিরাগীর ছদ্মবেশে জগদীশবাবু যথার্থই বিভ্রান্ত হয়েছিলেন। তাকে তীর্থভ্রমণের জন্য একশাে এক টাকা দিতে চেয়েছিলেন। বিরাগীর সাজের মর্যাদা রাখতে গিয়ে সে টাকা তিনি গ্রহণ করেননি। যথার্থ বিরাগীর মতাে অর্থের মােহকে অগ্রাহ্য এভাবে একজন বহুরূপী থেকে তিনি উন্নীত হয়েছেন পরমজ্ঞানী বিরাগীর পর্যায়ে।