History class ix

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ আলোচনা

 

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ আলোচনা

● ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণগুলি আলােচনা করাে। অথবা, ফ্রান্সকে ‘ভ্রান্ত অর্থনীতির এক বিশাল জাদুঘর বলা হয় কেন আলােচনা করাে।

উত্তরঃ

ফরাসি বিপ্লব (১৭৮৯ খ্রি.) আধুনিক বিশ্বের ইতিহাসে একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ঐতিহাসিক কোবান ফরাসি বিপ্লবকে অসংখ্য ছােটোবড়াে খরস্রোতানদীর সমন্বয়ে ছড়িয়ে-পড়াভয়ানক বন্যার সঙ্গেতুলনা করেছেন।

ফরাসি বিপ্লবের অর্থনৈতিক কারণ

 

বিভিন্ন অর্থনৈতিক কারণ ফরাসি বিপ্লবের জন্য বিশেষভাবে দায়ী ছিল। যেমন—

১) সরকারি অপব্যয় : ফরাসি রাজপরিবার অকাতরে অর্থব্যয় করে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক শক্তিকে দুর্বল করে দেন। চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-১৭১৫ খ্রি.), পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-৭৪ খ্রি.) ও ষােড়শ লুই-এর (১৭৭৪-৯৩ খ্রি.) আমলে সম্রাটসহ রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা ও বিলাসিতা চরমে পৌছােয়। ফলে ফরাসি রাজকোশ শূন্য হয়ে যায়।

ফরাসি-বিপ্লবের-অর্থনৈতিক-রাজনৈতি-প্রত্যক্ষ-ও-পরোক্ষ-কারণ-আলোচনা

 

২) বায়বহুল যুদ্ধ: চতুর্দশ ও পঞ্চদশ লুই বিভিন্ন ব্যয়বহুল যুদ্ধে অংশ নিয়ে বিপুল অর্থব্যয় করেন। যােড়শ লুই আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধে যােগ দিয়ে বিপুল অর্থ ব্যয় করেন। ফলে দেশে অর্থনৈতিক সংকট দেখা দেয়।

৩)মধ্যবিত্তদের দুরবস্থা : অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ মনে করেন যে, বিপ্লবের আগে ফ্রান্স ছিল “ভ্রান্ত অর্থনীতির জাদুঘর”। ত্রুটিপূর্ণ অর্থনীতির জন্য দেশে দ্রব্যমূল্য ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেলে দরিদ্র মানুষ সীমাহীন দুর্দশার মুখে পড়ে। খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের মূল্য গরিব মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যায়। অন্যদিকে ধনী বুর্জোয়া, ব্যবসায়ী, শিল্পপতিরা স্বাধীন ও অবাধ বাণিজ্যের জন্য শুল্ক ও নিয়ন্ত্রণ লােপের দাবি জানায়।

 

৪) অধিকারভােগীদের আয় :

ফ্রান্সের প্রায় অর্ধেক কৃষিজমিই ছিল যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে। জমি থেকে বিপুল আয় সত্ত্বেও তারা সরকারকে টাইলে বা ভূমিকর, ক্যাপিটেশন বা উৎপাদন কর, ভিটিংয়েমে বা আয়কর প্রভৃতি কর দিত না। তা সত্ত্বেও তারা রাষ্ট্রে বিভিন্ন ধরনের সুযােগসুবিধা ভােগ করত।

৫) তৃতীয় শ্রেণির করের বােঝা : রাষ্ট্র, গির্জা ও জমিদাররা তৃতীয় শ্রেণির কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করত। টাইলে, ক্যাপিটেশন, ভিটিংয়েমে প্রভৃতি প্রত্যক্ষ কর ছাড়াও তারা সরকারকে গ্যাবেলা বা লবণ কর, ভােগ্য পণ্যের ওপর কর, যাজকদের টাইদ বা ধর্মকর, এইডস বা মদ, তামাক প্রভৃতির ওপর কর, করভিবা প্রভুর জমিতে বেগার শ্রমদান, সামন্তপ্রভুদের পথঘাট ব্যবহার, শস্য ভাঙানাে ও জমি হস্তান্তরের জন্য কর, অন্যান্য অতিরিক্ত কর প্রভৃতি দিতে বাধ্য হত। এত রকম কর মিটিয়ে কৃষকের হাতে উৎপন্ন ফসলের মাত্র ২০ শতাংশ অবশিষ্ট থাকত।

উপসংহার: ঐতিহাসিক মার্সেল রাইনার বলেছেন যে, “ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক ও অর্থনৈতিক পটভূমি বাদ দিয়ে এই বিপ্লবের প্রকৃত কারণ বােঝা যায় না।” ঐতিহাসিক মর্স স্টিফেন্স বিপ্লবের জন্য অর্থনৈতিক কারণের ওপর বেশি গুরুত্ব দিয়ে বলেছেন যে, “এই বিপ্লবের প্রধান কারণ ছিল অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক-দার্শনিক ও সামাজিক নয়।”

●  ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণগুলি আলােচনা করাে। অথবা, ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টিতে রাজতন্ত্র কতটা দায়ী ছিল ?

উত্তর

অষ্টাদশ শতকে ফ্রান্সে বুরবো বংশের নেতৃত্বে কেন্দ্রীভূত স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত ছিল। ঐশ্বরিক ক্ষমতায় বিশ্বাসী এই রাজতন্ত্রে রাজা ছিলেন দেশের সর্বোচ্চ শাসক, আইন প্রণয়নকারী এবং প্রধান বিচারক। শাসনব্যবস্থায় জনগণের মতামতের কোনাে মূল্য ছিল না।

ফরাসি বিপ্লবের রাজনৈতিক কারণ : রাজতন্ত্রের দায়িত্ব

১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি বিপ্লব সৃষ্টিতে রাজতন্ত্রের বিভিন্ন ত্রুটিবিচ্যুতি ও রাজতন্ত্রের দায়িত্ব বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল।

১) রাজাদের দুর্বলতা: ফরাসি রাজা চতুর্দশ লুই (১৬৪৩-  ১৭১৫ খ্রি.) ছিলেন চরম স্বৈরাচারী। তিনি বলতেন “আমিই
রাষ্ট্র”। অলস ও বিলাসী রাজা পঞ্চদশ লুই (১৭১৫-৭৪ খ্রি.) তার উপপত্নী মাদাম দ্য পম্পাদুর-এর দ্বারা প্রভাবিত হয়ে শাসন পরিচালনা করলে প্রশাসন দুর্নীতি ও স্বজনপােষণে ছেয়ে যায়। এরপর অযােগ্য রাজা ষােড়শ লুই (১৭৭৪-৯৩ খ্রি.) রাজতন্ত্রকে অবক্ষয়ের শেষ সীমায় নিয়ে যান।

২)ত্রুটিপূর্ণ আইন: অষ্টাদশ শতকে ফরাসি আইন ছিল অত্যন্ত ত্রুটিপূর্ণ, জটিল ও দুর্বোধ্য। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন ধরনের আইন ও দণ্ডবিধি প্রচলিত ছিল। আইনগুলি ছিল অত্যন্ত নির্মম। সাধারণ অপরাধের জন্যও অনেকসময় মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হত।

৩) অভিজাতদের আধিপত্য : প্রশাসনে অভিজাত সম্প্রদায়ের আধিপত্য শাসনব্যবস্থায় চরম বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে। প্রশাসন প্রচণ্ড দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ইনটেনডেন্ট’ নামে দুর্নীতিপরায়ণ কর্মচারীরা খুবই ক্ষমতাশালী হয়ে ওঠে। অভিজাত রাজপুরুষরা ‘লেতর দ্য ক্যাশে’ নামে এক রাজকীয় পরােয়ানার দ্বারা যেকোনাে ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে বিনা বিচারে কারারুদ্ধ করে রাখার অধিকার পায়।

৪) বিচারব্যবস্থায় ত্রুটি : ফরাসি বিচারব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত জটিল, ব্যয়বহুল ও দুর্নীতিগ্রস্ত। অধিকাংশ বিচারক ছিলেন অসৎ ও দুর্নীতিপরায়ণ। অপরাধীদের কাছ থেকে ঘুষ গ্রহণ, জরিমানা আদায় প্রভৃতির দ্বারা দুর্নীতিপরায়ণ বিচারকরা বিপুল অর্থ উপার্জন করতেন।

৫) ত্রুটিপূর্ণ রাজস্বব্যবস্থা : ফ্রান্সের ৯৫ শতাংশ সম্পদ যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায়ের হাতে থাকলেও এর জন্য তাদের কাছ। থেকে কোনাে কর আদায় করা হত না। ফলে যাবতীয় করের বােঝা বহন করতে হত দেশের মাত্র ৫ শতাংশ সম্পদের মালিক তৃতীয় সম্প্রদায়কে। রাজকীয় কর ছাড়াও সামন্তপ্রভু ও গির্জা তৃতীয় সম্প্রদায়ের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের কর আদায় করত।

৬) অমিতব্যয়িতা : ফরাসি রাজপরিবার ছিল সীমাহীন অমিতব্যয়ী। রাজপরিবারের সেবাকার্যের উদ্দেশ্যে ভার্সাই রাজপ্রাসাদে ১৮ হাজার কর্মচারী নিযুক্ত ছিল। রানি মারি আঁতােয়ানেতের ব্যক্তিগত কর্মচারীর সংখ্যাই ছিল ৫০০ জন। রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা দেশের অর্থসংকট তীব্রতর করলে দেশবাসীর মনে এর বিরূপ প্রভাব পড়ে।

৭) ষােড়শ লুই-এর ভূমিকা: দেশের অর্থনৈতিক সংকট অত্যন্ত তীব্র হয়ে উঠলে রাজা ষােড়শ লুই-এর উচিত ছিল যাজক ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকার খর্ব করে এবং তাদের ওপর করের বােঝা চাপিয়ে পরিস্থিতির সামাল দেওয়া। কিন্তু ষােড়শ লুই একাজে জোরালাে পদক্ষেপ না নেওয়ায় জনগণ অত্যন্ত ক্ষুদ্ধ হয়।

উপসংহার: ফরাসি বিপ্লবের জন্য রাজতন্ত্রের দায়িত্বকে কোনােভাবে অস্বীকার করা যায় না। ঐতিহাসিক ফিশার বিপ্লবের জন্য ফরাসি রাজতন্ত্রকে দায়ী করেছেন। ঐতিহাসিক মাদেলা-ও বলেছেন যে, “ফরাসি রাজতন্ত্রই বিপ্লব সৃষ্টি করেছে।”

● প্রাকৃবিপ্লব ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ কারণ গুলি কী ছিল? প্রা-বিপ্লব ফ্রান্সে কীভাবে অর্থনৈতিক সংকটের সূচনা হয়েছিল?

উত্তর

প্রাক বিপ্লব ফ্রান্সে প্রত্যক্ষ করগুলি ছিল—টাইলে, ভিংটিয়েমে, ক্যাপিটেশন, করভি বা বেগার শ্রম, প্রভৃতি। পরােক্ষ করগুলি ছিল— টাইদ বা ধর্ম কর, গ্যাবেল বা লবণ কর, তামাক কর, এইডি, ট্রেইট, স্ট্যাম্প কর, পণ্য শুল্ক, আবগারি শুল্ক, পরিবহণ শুল্ক (অকট্রই) প্রভৃতি।

 

ফরাসি বিপ্লবের প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষ কারণ 

প্রাকবিপ্লব ফ্রান্সে ভ্রান্ত অর্থনীতির ফলে ফরাসি রাজকোশে তীব্র সংকট

১) রাজপরিবারের অমিতব্যয়িতা: রাজপরিবারের সীমাহীন বিলাসিতা, অমিতব্যয়িতা, ভার্সাই রাজপ্রাসাদের বিপুল সংখ্যক কর্মচারী ও রানিদের অসংখ্য ব্যক্তিগত চাকরের ব্যয় বহন প্রভৃতির ফলে অষ্টাদশ শতকের শেষদিকে ফরাসি রাজকোশ প্রায় শূন্য হয়ে পড়ে।

২) বৈদেশিক যুদ্ধ : ফ্রান্সের বুরবো বংশের রাজাদের একের পর এক বৈদেশিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। চতুর্দশ লুই একের পর এক যুদ্ধে জড়িয়ে আগেই অর্থসংকট সৃষ্টি করে যান। এরপর পঞদশ ও যােড়শ লুইও বৈদেশিক যুদ্ধে জড়িয়ে রাজকোশের প্রভূত অর্থ ব্যয় করে ফেলেন।

৩) আর্থিক বিপর্যয় : দেশের আর্থিক সংকটের মধ্যেই ক্রমাগত জনসংখ্যা বৃদ্ধি, মূদ্রাস্ফীতি, বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রাজকর্মচারীদের আর্থিক দুর্নীতি প্রভৃতি ঘটনা অর্থসংকটকে আরও জটিল করে তােলে।

৪) ঋণ গ্রহণ : ব্যয় সংকোচের চেষ্টা না করে বুরবো রাজারা বাজার থেকে ঋণ নিয়ে অর্থসংকট দূর করার উদ্যোগ নেন। এই ঋণের সুদ হিসেবে প্রতি বছর প্রচুর অর্থ চলে যেতে থাকে। ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে বার্ষিক ব্যয়ের প্রায় অর্ধাংশই চলে যায় সুদ বাবদ।

ফরাসি বিপ্লবের বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা

৫) বৈষম্যমূলক করব্যবস্থা : ফরাসি সমাজব্যবস্থার প্রথম দুটি শ্রেণি—যাজক ও অভিজাতরা সমাজ ও রাষ্ট্রের নানা সুযােগসুবিধা ভােগ করত। তাদের হাতেই ছিল দেশের সম্পদের সিংহভাগ। অথচ তারা রাষ্ট্রকে কোনােরূপ কর দিত না। ফলে রাষ্ট্র বিপুল পরিমাণ কর থেকে বঞ্চিত হয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *