সম্রাট অশোক ও মৌর্য শাসন ব্যবস্থা

 

সম্রাট অশোক ও মৌর্য শাসন ব্যবস্থা

সম্রাট-অশোক-ও-মৌর্য-শাসন-ব্যবস্থা

 

সম্রাট অশোক 

 

বিন্দুসারের মৃত্যুর পর খ্রিস্টপূর্ব ২৭৩ অব্দে তাঁর পুত্র অশােক মগধের রাজা হন। আরােহণের চার বছর পর ২৬৯ তাঁর রাজ্যাভিষেক হয়। সম্ভবত সিংহাসন নিয়ে ভ্রাতৃবিরােধের জন্যই তাঁর রাজ্যাভিষেকের বিলম্ব হয়। 

 

রাজ্যবিস্তার 

 

 কলিঙ্গ যুদ্ধের কারণ :

রাজ্যাভিষেকের পর অশােক রাজ্য বিস্তার নীতি গ্রহণ করেন। প্রতিবেশী রাজ্য কলিঙ্গনন্দ বংশের শাসনকালে মগধের অন্তর্গত ছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে কলিঙ্গ স্বাধীনতা ঘােষণা করে। দক্ষিণ ভারতে চোল ও পান্ড্য রাজাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার ফলে কলিঙ্গের শক্তি বৃদ্ধি হয়। এতে মগধ ভীত হয়। কলিঙ্গ রাজ্য দক্ষিণ ভারতে স্থলপথ ও জলপথকে নিয়ন্ত্রিত করত এবং বঙ্গোপসাগরের তীরে বন্দর দিয়ে কলিঙ্গ সমুদ্র বাণিজ্য বৃদ্ধি করায় মগধের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে। তাই অশােক কলিগ জয়ে আগ্রহী হয়েছিলেন।

 

 

 

কলিঙ্গ যুদ্ধ ও প্রভাব 

 

 রাজ্যাভিষেকের আট বছর পর অশােক কলিঙ্গ রাজ্য আক্রমণ করেন (২৬১ খ্রিঃ পূঃ)। অশােক তার শিলালিপিতে উল্লেখ করেছেন যে, এই যুদ্ধে এক লক্ষ সৈন্য নিহত, দেড় লক্ষ সৈন্য বন্দী ও বিপুল সম্পত্তির অপচয় হয়। এইজন্য অশােককে চড়াশােক বলা হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের মৃত্যু, রক্তপাত ও ক্রন্দন অশােকের হৃদয়ে বেদনা ও অনুশােচনার সৃষ্টি করে। এই ঘটনা অশােকের মানসিক পরিবর্তন আনে এবং তিনি হিংসার পথ ও রাজ্য জয় নীতি পরিত্যাগ করে অহিংসা ধর্মের নীতির দ্বারা মানুষের হৃদয় জয়ের নীতি গ্রহণ করেন। তিনি বৌদ্ধধর্মের পথ গ্রহণ করে। ক অহিংসা, সাম্য, মৈত্রী, প্রেম ও ভ্রাতৃত্বের নীতি প্রচার করতে থাকেন।

 

সম্রাট অশোকের রাজ্যসীমা : 

 ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত অশােকের শিলালিপি, হিউয়েন সাঙ ও কলহণের রাজতরঙ্গিণী থেকে অশােকের সাম্রাজ্যের আয়তন সম্বন্ধে জানা যায়। ভারতের উত্তর-পশ্চিমে পূর্ব আফগানিস্তান, বেলুচিস্তান, পেশােয়ার, সিন্ধু ও উত্তরে নেপাল থেকে দক্ষিণে মহীশূর পর্যন্ত বিভিন্ন স্থানে অশােকের শিলালিপি পাওয়া গেছে। শিলালিপিতে প্রাপ্ত স্থানগুলি অশােকের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল বলে মনে করা হয়। বিভিন্ন উপাদান থেকে বলা যায় যে, উত্তরে হিমালয় থেকে দক্ষিণে মহিশূর, পূর্বে ব্রহ্লাদেশ থেকে পশ্চিমে আরবসাগর এবং উত্তর পশ্চিমে সিরিয়ার। সীমান্ত পর্যন্ত অশােকের সাম্রাজ্য সীমা ছিল।

 

 অশােকের ধর্ম বিজয় নীতি :

 কলিঙ্গ যুদ্ধের পর অশােক বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষা গ্রহণ করেন এবং বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। তিনি বৌদ্ধধর্মকে বিশ্বধর্মে রূপান্তরিত করেন। দেশের অভ্যন্তরে বৌদ্ধ ধর্ম প্রচারের জন্য যেসব কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন তা হল প্রথমত, শিলালিপি স্তম্ভলিপির মাধ্যমে বৌদ্ধ ধর্মের সারকথা সহজ ও সরলভাবে বর্ণনা করা। দ্বিতীয়ত, অর্থাৎ শিকার ও প্রমােদ ভ্রমণ বন্ধ করে ধর্ম যাত্রা শুরু করা। ধর্ম যাত্রা হল বুদ্ধদেবের স্মৃতির সঙ্গে জড়িত বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন। তৃতীয়ত, প্রজাদের মধ্যে ধর্মভাব জাগরণের জন্য নানা অলৌকিক দৃশ্য, প্রদর্শনের ব্যবস্থা করা। চতুর্থত, ধর্ম প্রচারের জন্য যুত, রাজুক, ধর্মমহামাত্র নামে বিশেষ কর্মচারি নিযুক্ত করা, যাদের কাজ ছিল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বুদ্ধদেবের বাণী প্রচার করা এবং প্রজাদের ইহলৌকিক ও পারলৌকিক মঙ্গল সাধন করা। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধনের জন্য তিনি রাস্তার পাশে বৃক্ষরােপণ, কূপ খনন, বিশ্রামাগার স্থাপন, মানুষ ও পশুর জন্য চিকিৎসালয় স্থাপন ও ওষধি বৃক্ষের চারা রােপণ ইত্যাদি জনহিতকর ব্যবস্থা করেছিলেন। পঞ্চমত, বৌদ্ধ ধর্মের ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য তিনি পাটলিপুত্রে তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতির অধিবেশন আহ্বান করেন। ষষ্ঠত, সুদূর দক্ষিণ ভারতে সত্যপুত্র, কেরলপুত্র, চোল, পান্ড্য প্রভৃতি রাজ্যে তিনি ধর্মদূত পাঠিয়েছিলেন |

 

অশােকের বৈদেশিক সম্পর্ক ঃ 

ভারতের বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রের সঙ্গে অশােক ঘনিষ্ঠ সুসম্পর্ক থাপন করেছিলেন। বিদেশে তিনি বৌদ্ধধর্ম, অহিংসা ও সৌভ্রাত্রিত্বের বাণী প্রচারের ব্যবস্থা করেছিলেন। এই উদ্দেশ্যে অশােক তাঁর পুত্র মহেন্দ্র ও কন্যা সংঘমিত্রাকে শ্রীলঙ্কায় পাঠিয়েছিলেন। ব্ৰহ্বদেশে শােন ও উত্তর নামে দু’জন ধর্মদূতকে তিনি পাঠান। নেপালে বহু বৌদ্ধ মঠ নির্মাণ করেছিলেন। এছাড়া তিনি সিরিয়া, মিশর, গ্রিস প্রভৃতি দেশে ধর্ম প্রচারক পাঠিয়েছিলেন। চীন দেশেও তিনি ধর্মপ্রচারক পাঠিয়েছিলেন বলে প্রাচীন চীনদেশের গ্রন্থে উল্লেখ আছে। এই সব দেশগুলির সঙ্গে ধর্ম প্রচার ছাড়াও ভারতের সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক সম্পর্ক ছিল।

 

অশােকের ধর্মঃ 

অশােক বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী হলেও তার রাজধর্ম ছিল মানব ধর্ম। তিনি বৌদ্ধ ধর্ম ও অন্যান্য ধর্মের মূল কথা অনুসারে প্রজাদের জন্য যে আচার আচরণ ও উপদেশাবলি তার লিপিতে উল্লেখ করেছেন যা প্রজাদের পালনীয় তা ছিল অশােকের ধম্ম বা মানবধর্ম। তার ধম বলতে তিনি বুঝিয়েছেন – নীতিবােধ, ব্যক্তি জীবনের শুদ্ধি, সত্যবাদিতা, পবিত্রতা, নম্রতা প্রভৃতি সদগুণের আচরণ। এছাড়া তার ধমমের নির্দেশ ছিল সকল প্রাণীর প্রতি দয়া, পিতামাতার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, হিংসা বর্জন, জৈন ও বৌদ্ধ ভিক্ষুদের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, দাস দাসীদের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়া, মিতব্যয়িতা ইত্যাদি। অশােক নিজেকে দেবানা পিয় পিয়দশী অর্থাৎ দেবতাদের প্রিয়দর্শী প্রিয় বলে পরিচয় দিতেন।

 

 সম্রাট অশোকের জনহিতকর কাজ ঃ 

 অশােক ঘােষণা করেছিলেন সব মানুষই আমার সন্তান। তিনি বলেছেন এজাদের ইহলােক ও পরলােকের সুখ প্রদান করা তার কর্তব্য। পশু হত্যা বন্ধ করার জন্য তিনি মাংসাহার ত্যাগ করেছিলেন। প্রজাহিতৈষী রাজ কর্তব্যের আদর্শ স্থাপন করার জন্য তাকে রাজর্ষি বলা যায়।

 

 মূল্যায়ন:

  উদারতা, পরধর্মমত সহিষ্ণুতা যদি রাজা মহারাজাদের মহত্ব ও খ্যাতির মাপকাঠি হয় তা হলে ইতিহাসে অশােকের স্থান যে শ্রেষ্ঠ সে বিষয়ে কোনাে দ্বিমতের অবকাশ নেই। সম্রাট অশােক মৌর্য সম্রাটদের মধ্যে সর্ববৃহৎ সাম্রাজ্যের অধীশ্বর ছিলেন। সাম্রাজ্য রক্ষার জন্য তিনি সামরিক শক্তি প্রয়ােগ করেন নি। বিভিন্ন ঐতিহাসিক জুলিয়াস সিজার, কনস্টানটাইন, শার্লামেন, নেপােলিয়ান ও আকবরের সঙ্গে তুলনা করে অশােককে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্রাট বলেছেন। তিনি যুদ্ধনীতি ত্যাগ করে ধর্মবিজয় নীতির দ্বারা শান্তি, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্বের আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। তিনি রাজপদকে বিলাস ও স্বার্থ সিদ্ধির উপায় বলে মনে করতেন না। তিনি মানব কল্যাণের আদর্শ স্থাপন করেছিলেন। তিনি ঘােষণা করেছিলেন – সব মুনিষে পজা-মমা। প্রজাদের কাছে। তিনি নিজেকে ঋণী মনে করতেন। তিনি ভগবান বুদ্ধের প্রেম, শান্তি, সৌহার্দ, অহিংসার আদর্শের বিস্তার করেছিলেন। ধর্মীয় সংকীর্ণতার উর্ধ্বে তিনি মানব ধর্মকে স্থান দিয়েছিলেন। তাঁর আমলে বিশেষ ধরনের চৈত্য, স্থূপ, স্তম্ভ নির্মাণ দ্বারা ভারতীয় শিল্পে নতুন ধারা প্রবর্তিত হয়। সমগ্র বিশ্বের রাজতন্ত্রের ইতিহাসে শাসক ও মানুষ হিসাবে অশােকের তুলনা চলে না। 

 

মৌর্য শাসন ব্যবস্থা : অশোক

 

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মৌর্যশাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করেছিলেন। সম্রাট অশােকের শাসনকালে ঐ শাসন ব্যবস্থায় কিছু পরিবর্তন হয়েছিল। গ্রিক দূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ, কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বিশাখ দত্তের, মুদ্রারাক্ষস, সােমদেবের কথাসরিৎসাগর’ ও গ্রিক লেখক জাস্টিন, প্লিনি ও এ্যরিয়ান প্রভৃতির রচনা থেকে মৌর্য শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে জানা যায়। 

 

অশোকের কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা:

  কেন্দ্রে রাজাই ছিলেন রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার অধিকারী। রাজা ছিলেন প্রধান শাসক, প্রধান আইন প্রণেতা, প্রধান সেনাপতি ও প্রধান বিচারক। রাজার নিরঙ্কুশ ক্ষমতা ছিল না। মন্ত্রি, অমাত্য, মন্ত্রি পরিষদ ও প্রচলিত রীতিনীতির দ্বারা রাজা দেশ শাসন করতেন। এইজন্য রাজার ক্ষমতা ছিল সীমাবদ্ধ। রাজপদ ছিল বংশানুক্রমিক।

 

• মন্ত্রি, অমাত্য, মন্ত্রি পরিষদ ও অন্যান্য কর্মচারী :

  ‘কোটিল্যের অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, মন্ত্রি ও অমাত্য নামে দুই শ্রেণির কর্মচারী শাসন কার্যে রাজাকে সাহায্য করতেন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারী ছিলেন অমাত্য বা সচিব। অমাত্যদের মধ্যে থেকে কঠোর পরীক্ষা ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে মন্ত্রি নিযুক্ত করা হত। মন্ত্রিরা শাসন ও পররাষ্ট্র নীতি প্রভৃতি বিষয়ে রাজাকে পরামর্শ দিতেন। অমাত্য নামে কর্মচারীদের উপর রাজস্ব, অর্থ, বিচার ও প্রশাসন প্রভৃতি বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হত। এছাড়া অধ্যক্ষ নামে কর্মচারীরা শাসন বিভাগের দায়িত্ব প্রাপ্ত হতেন। এই অধ্যক্ষরা হলেন নগরাধ্যক্ষ, বলাধ্যক্ষ, খনি বিভাগের প্রধান, গাে-অধ্যক্ষ, অশ্বাধ্যক্ষ, হস্তীঅধ্যক্ষ, রথাধ্যক্ষ, নৌ-অধ্যক্ষ, এছাড়া শুল্কাধ্যক্ষ, সুত্রাধ্যক্ষ, মন্দিরাধ্যক্ষ, গুপ্তচরাধ্যক্ষ, দুর্গপাল ইত্যাদি। 

 

প্রাদেশিক প্রশাসন :

 মৌর্যদের শাসনকালে সমগ্র সাম্রাজ্যকে পাঁচটি প্রদেশে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই প্রদেশগুলি হল উত্তরপথ – রাজধানী তক্ষশিলা, অবন্তীপথ – রাজধানী উজ্জয়িনী, কলিঙ্গ রাজধানী তােসালী, দক্ষিণাপথ – রাজধানী সুবর্ণগিরি এবং প্রাচ্য – রাজধানী পাটলিপুত্র। প্রদেশগুলির শাসন ভার থাকত রাজকুমারদের উপর। এদের কুমারামাত্য ও প্রাদেশিক বলা হত। এছাড়া স্বয়ং-শাসিত জনগােষ্ঠী রাজ্য এবং গণতন্ত্র শাসিত নগর ছিল। প্রদেশগুলি কয়েকটি বিষয়ে বা। (জেলায়) বিভক্ত ছিল। জনপদের শাসনকর্তা ছিলেন স্থানিক নামে কর্মচারী। সর্বনিম্ন প্রশাসনিক স্তর ছিল গ্রাম। গ্রামের শাসন ভার থাকত গ্রামিক-এর উপর। প্রত্যেক প্রদেশকে বলা হত দেশ প্রদেশ শাসন কর্তা মন্ত্রি পরিষদ ও অন্যান্য কর্মচারীদের সাহায্যে শাসন করতেন। জেলা বিষয়ের শাসন কর্তা ছিলেন সমাহর্তা। পাঁচ-দশটি গ্রামের প্রধান ছিলেন গােপ নামে কর্মচারী।

 

সামরিক বিভাগ ঃ 

 মেগাস্থিনিসের বিবরণ হতে চন্দ্রগুপ্তের সামরিক বাহিনীর সংগঠন সম্বন্ধে বিবরণ পাওয়া যায়। মৌর্য সাম্রাজ্যের সামরিক বাহিনী ছিল সুশিক্ষিত ও সুসজ্জিত। সামরিক বিভাগের দায়িত্ব ছিল ৩০ জনকে নিয়ে একটি সমিতির উপর। এই সমিতি ৬টি উপ-সমিতিতে বিভক্ত ছিল। এক একটি উপসমিতিতে ৫ জন সদস্য থাকত। পদাতিক, অশ্বারােহী, হস্তীবাহিনী, রথি, নৌবাহিনী এবং রসদ সরবরাহ বিভাগের দায়িত্ব এক একটি উপ-সমিতির উপর থাকত। মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায় চন্দ্রগুপ্তের সৈন্যবাহিনীতে ৬ লক্ষ পদাতিক, ৩০ হাজার অশ্বারােহী, ৮ হাজার রথারােহী এবং ৯ হাজার হস্তী ছিল।

 

নগর পরিষদ:

মেগাস্থিনিসের বিবরণ থেকে জানা যায়, পাটলিপুত্র নগরের শাসনভার ছিল ৩০ জন সদস্য বিশিষ্ট একটি নগর পরিষদের উপর। এই নগর পরিষদ ৫ জন সদস্য নিয়ে এক একটি করে ৬টি শাখা সমিতিতে বিভক্ত ছিল। এক একটি শাখাসমিতির উপর এক একটি বিভাগের দায়িত্ব ছিল। যেমন – (১) কারিগরী শিল্পের নিয়ন্ত্রণ, (২) জন্ম মৃত্যুর হিসাব রক্ষা, (৩) বিদেশি আগন্তুকদের তত্ত্বাবধান, (৪) ব্যাবসা-বাণিজ্য পরিচালনা, (৫) শিল্পজাত দ্রব্যের ক্রয় বিক্রয়, (৬) বিক্রীত পণ্যের উপর দশ শতাংশ শুল্ক আদায়।

 

বিচার ব্যবস্থা:

 মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় রাজা ছিলেন সর্বোচ্চ বিচারক। রাজা অভিজ্ঞ মন্ত্রি ও পণ্ডিতদের সাহায্য নিয়ে বিচার কার্য করতেন। রাজার বিচারালয় ছাড়া শহর ও গ্রামে দুই ধরনের বিচারালয় ছিল। শহরের বিচারক ছিলেন নগর ব্যবহারিকগণ। গ্রামের বিচার করতেন “রাজুকগণ। গ্রিক লেখকদের মতে বিদেশিদের জন্য পৃথক বিচারালয় ছিল। অর্থশাস্ত্রে উল্লেখ আছে যে, ধর্মীয়, দেওয়ানী বিচারালয়কে বলা হত ধর্মস্থির। ফৌজদারি বিচারালয়কে বলা হত কন্টকশােধন। এই বিচারালয় গুলিতে অমাত্যগণ বিচার করতেন। গ্রামের ছােটো ছােটো সাধারণ মামলাগুলি গ্রামের বৃদ্ধরা বিচার করতেন। কৌটিল্য ও মেগাস্থিনিস উভয়ই কঠোর দণ্ডবিধির কথা উল্লেখ করেছেন। বিচারে শাস্তি হিসাবে জরিমানা, কারাবাস, অঙ্গচ্ছেদ, শূলে চড়ানাে, মৃত্যুদণ্ড প্রভৃতি শাস্তি দেওয়া হত। অশােকের শাসনকালে দণ্ডবিধির কঠোরতা হ্রাস করা হয়েছিল।

 

রাজস্ব ব্যবস্থা:

 রাজকোষের প্রধান আয়ের উৎস ছিল ভূমি রাজস্ব। উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ বা এক চতুর্থাংশ ভাগ বা কর হিসাবে দিতে হত। উপকর ছিল বলি। এছাড়া আমদানিরপ্তানি শুল্ক, বিক্রয়কর, জলকর, পথকর, খনিকর এবং জরিমানা থেকে রাজকোষে অর্থাগম হত। মৌর্যযুগে পর্যাপ্ত রৌপ্য মুদ্রার প্রচলন ছিল। 

 

গুপ্তচর:

  সাম্রাজ্যের সংবাদ সংগ্রহের জন্য একটি পৃথক গুপ্তচর বিভাগ ছিল। বিশেষ বিশেষ স্থানে স্থায়ী গুপ্তচরদের সমথা এবং ভ্রাম্যমাণ গুপ্তচরদের সঞরা বলা হত। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রবর্তিত শাসন ব্যবস্থা গুপ্তযুগে কিছু পরিবর্তন সহ প্রচলিত ছিল। তাই মৌর্য । নি ব্যবস্থা ভারত ইতিহাসে সুদূর প্রসারী প্রভাব রেখে ছিল। 

 

||মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন ||

 

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের উত্তরাধিকারী সম্রাট অশােকের মৃত্যুর ৫০ বছরের মধ্যেই বিশাল মৌর্য সাম্রাজ্যের পতন হয়। মৌর্য সাম্রাজ্যের শেষ সম্রাট ছিলেন বৃহদ্রথ। বৃহদ্রথের সেনাপতি পুষ্যমিত্র শুঙ্গ ১৮৭ খ্রিস্ট পূর্বাব্দে বৃহদ্রথকে হত্যা করে মৌর্য বংশের অবসান ঘটান। মৌর্য সাম্রাজ্যের পতনের নানা কারণ রয়েছে। প্রথমত, অশােকের বৌদ্ধ ধর্মদর্শন অনুযায়ী শাসন ব্রাত্মণদের 

ক্ষুদ্ধ করে। ব্রাক্ষ্মণদের মর্যাদা ও ক্ষমতা হ্রাস, পশুবলি নিষিদ্ধকরণ প্রভৃতি কারণে ব্রাত্মণদের প্ররােচনায় পুষ্যমিত্র শুঙ্গ মৌর্যশাসনের অবসান ঘটান। দ্বিতীয়ত, অশােক যুদ্ধনীতি ত্যাগ করায় ভারতে উত্তর পশ্চিম সীমান্তে বৈদেশিক আক্রমণ হওয়ায় তা প্রতিহত করার ক্ষমতা শেষ দুর্বল মৌর্য সম্রাটের ছিল না। তৃতীয়ত, যে মৌর্য সাম্রাজ্যের আর্থিক সমৃদ্ধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তা অশােকের দেশ বিদেশে ধর্ম প্রচারের জন্য নানা কর্মচারী নিয়ােগের কারণে হয়। ফলে পরবর্তী সম্রাটরা দুর্বল হয়ে পড়ে। চতুর্থত, কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার কারণে প্রাদেশিক শাসনকর্তারা বিদ্রোহ করে স্বাধীন হয়ে যায়। পঞমত, অশােকের উত্তরাধিকারীদের মধ্যে বিরােধের কারণে বিশৃংখলা দেখা দেয়। এই বিশৃংখলার কারণে এই সাম্রাজ্যে পতন দ্রুত নেমে আসে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *