History Class X

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা ও বিকাশ | পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতি|

 ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা ও বিকাশ | পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রসার এবং ব্রিটিশ শিক্ষানীতি|

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা ও বিকাশ

 

ইউরােপে-জাতীয়তাবাদের-সূচনা-ও-বিকাশ-পাশ্চাত্য-শিক্ষার-প্রসার-এবং-ব্রিটিশ-শিক্ষানীতি

 

জাতীয়তাবাদের সূচনা

উনিশ শতকে ইউরােপের অত্যাচারিত জাতিগুলি আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের জন্য সংগ্রাম করার মাধ্যমে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার সঞ্চার হয়েছিল। জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ ইউরােপের বিভিন্ন দেশের জনগণ কোথাও স্বৈরাচারী রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে, আবার কোথাও পরাধীনতা থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে। ইউরােপের জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপের মুখ্য ধারাগুলি ছিল (ক) বৈপ্লবিক কার্যাবলি (খ) গণ আন্দোলন, (গ) স্বাধীনতা যুদ্ধ (ঘ) রাষ্ট্রীয় ঐক্য সাধনের সংগ্রাম প্রভৃতি।

আমেরিকাবাসী আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডের ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। ফ্রান্সে বুরবোঁ রাজবংশের স্বৈরাচারী রাজাদের সীমাহীন অত্যাচারের বিরুদ্ধে ফরাসি দেশের জনগণ দার্শনিকদের বক্তব্যে জাতীয়তাবােধে অনুপ্রাণিত হয়ে বৈপ্লবিক গণ আন্দোলনের মাধ্যমে ১৭৮৯ খ্রিস্টাব্দে রাজতন্ত্রকে উচ্ছেদ করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের পর ১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে জুলাই বিপ্লব এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের | মধ্যে দিয়ে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হয়েছিল। গ্রিস দীর্ঘ সংগ্রামের মাধ্যমে তুরস্কের অধীনতা থেকে ১৮২৯ খ্রি : মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা লাভ করেছিল। উনিশ শতকে ইটালি এবং জার্মানির জাতীয়তাবাদী নেতৃবর্গ নিজ দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য গুলিকে বিদেশি কবল থেকে মুক্ত করে ঐক্যবদ্ধ করেছিল।

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা: ভারতের জাতীয়তাবাদী চেতনায় ইউরােপীয় প্রভাব ঃ

উনিশ শতকে ইউরােপের এই জাতীয়তাবাদী চেতনাযুক্ত সংগ্রাম ও আন্দোলনগুলিই ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবােধের অনুপ্রেরণা এবং স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সংগ্রামের প্রবণতা জাগ্রত করেছিল। তাদের মধ্যে আঞ্চলিক স্বার্থের অবসান হয়ে জাতীয় সত্বার বিকাশ ঘটে। এছাড়া পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ভারতে জাতীয় চেতনার জাগরণ হয়েছিল। এই শিক্ষার প্রভাবে সমাজ সংস্কারের মধ্যে দিয়ে মধ্যযুগীয় ধ্যান ধারণা দূর হয় এবং মুক্ত চিন্তার বিকাশ ঘটে। 

ভারতীয় জাতীয়তাবাদের উৎস ঃ

ভারতীয় ও ব্রিটিশ স্বার্থের সংঘাতের ফলেই উনিশ শতকে ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা মনে করেন ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতবাসীর প্রতিক্রিয়ার পরিণতি হল জাতীয়তাবােধের সূচনা। অনেকে মনে করেন, ভারতবাসীর মধ্যে স্বাভিমানবােধ ও আত্মজাগরণের মাধ্যমে জাতীয়তাবাদী চেতনার সৃষ্টি হয়। ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার  জন্মের একাধিক কারণ রয়েছে।।

 (ক) ইংরেজ শাসনের ফল ও দীর্ঘ এক শতাব্দী ধরে ইংরেজ শাসকদের অপশাসনের ফলে। ঔদ্ধত্য এবং ভারতীয়দের প্রতি বিদ্বেষ ও তাচ্ছিল্যপূর্ণ ব্যবহার ভারতীয়দের জাতীয় মর্যাদা বােধে। আঘাত করেছিল। সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থই ছিল ইংরেজ শাসনের উদ্দেশ্য। এসব কারণে ব্রিটিশ বিরােধী। মনােভাব সৃষ্টি হওয়ায় ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয়তাবাদী ভাবনার জাগরণ ঘটে।

 খ)অর্থনৈতিক শােষণ ঃ ইংরেজ শাসনে ভারতের চিরন্তন অর্থনৈতিক কাঠামাে পুরােপুরি। wংস হয়ে যায়। ভারত অর্থনৈতিকভাবে স্বনির্ভর একটি দেশ থেকে ব্রিটিশ শিল্পের জন্য কাচামাল সরবরাহকারী এবং ব্রিটিশ শিল্পজাত পণ্যের খােলাবাজারে রূপান্তরিত হয়েছিল। ভারতের চিরাচLি কুটির শিল্প ধ্বংস হয়ে যায়। ইংরেজ সৃষ্ট জমিদার শ্রেণি কতৃক চড়া হারে রাজস্ব আদায়কালে। অত্যাচারে কৃষকদের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছিল। এছাড়া শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির মধ্যে বেকার। ও চাকরি ক্ষেত্রে বৈষম্যমূলক ব্যবহার, তাদের ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে বিক্ষুদ্ধ করে তােলে। এই সমস্ত অর্থনৈতিক শােষণ, বঞ্চনা ও অসন্তোষের ফলে সর্বস্তরের ভারতীয় জনগণের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনার জন্ম হয়।

গ) পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব ঃ ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি ও প্রসারে পাশ্চাত্য শিক্ষা। প্রভাব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাশ্চাত্য শিক্ষার সংস্পর্শে এসে ভারতীয়রা ইউরােপীয় দার্শনিক ও সমাজ বিজ্ঞানীদের যুক্তিবাদী লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়। রুশাে, ভলতেয়ার, টমাস পেইন, মিল। বেন্থাম প্রভৃতি চিন্তাবিদদের রচনা ভারতবাসীর মধ্যে জাতীয় চেতনা ও আত্মবিশ্বাস জাগ্রত করতে সাহায্য করেছিল। ফরাসি বিপ্লবের সাম্য, মৈত্রী, ও স্বাধীনতার আদর্শ, আমেরিকা ও আয়ারল্যান্ডের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং ইটালি ও জার্মানির ঐক্যবদ্ধ রাষ্ট্র গঠনের সংগ্রামের দৃষ্টা ভারতীয়দের জাতীয়তাবােধকে জাগিয়ে তুলেছিল এবং পরাধীন ভারতকে মুক্ত করতে দেশবাসীকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

(ঘ) রাজনৈতিক ঐক্য : মােগল সাম্রাজ্যের অবক্ষয়ের সময় থেকে ভারতে রাজনৈতিক, ক্ষেত্রে বিচ্ছিন্নতার সূচনা হয়েছিল। ব্রিটিশ শাসনকালে ভারতের অধিকাংশ রাজ্য একই কেন্দ্রীয় শাসনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিল। সর্বত্র একই ধরনের শাসন ব্যবস্থা প্রচলন করে ইংরেজ শাসন ভারতে রাজনৈতিক ঐক্যের পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের ভারতবাসীকে কাছাকাছি আনতে সাহায্য করেছিল। ভারতবাসীর মধ্যে মূলগত ঐক্যের ভাবনা জাগ্রত হয়। এই মূলগত ঐক্য অখন্ড ভারতীয় বােধের জন্ম দিয়েছিল।

(ঙ) উন্নত যােগাযােগ ব্যবস্থা : ঔপনিবেশিক স্বার্থে ইংরেজ সরকার ভারতে যােগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ ঘটিয়েছিল রেলপথ, ডাক ও তার ব্যবস্থা, টেলিগ্রাফ প্রভৃতি যােগাযোগ। ব্যবস্থার দ্বারা। এই যােগাযােগ ব্যবস্থা যত দ্রুততর ও সহজতর হয়েছিল, ভারতীয়দের মধ্যে, বিচ্ছিন্নতাও তত কমে এসেছিল। এর ফলে ভারতে বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের মধ্যে যােগাযােগ আদানপ্রদান, ভাববিনিময় বৃদ্ধি পেয়ে জাতীয়তাবােধ দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছিল। 

জাতীয়তাবাদ ও ব্রিটিশ শিক্ষানীতি

   ব্রিটিশ শিক্ষা নীতি :

উনিশ শতকের আগে ভারতবাসী পাঠশালা, টোল, মক্তব, মাদ্রাসা প্রভৃতি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও আঞ্চলিক ভাষার মাধ্যমে শিক্ষা লাভ করত। এখানে শাস্ত্রগ্রন্থ, সাহিত্য দর্শন, আইন, ব্যাকরণ, ধর্মীয় কাহিনি প্রভৃতি বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হত। ইংরেজ শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশীয় শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামাে ভেঙে পড়ে।

বেসরকারি উদ্যোগে শিক্ষা প্রসার : ইংরেজ কোম্পানি প্রথমে ভারতীয়দের শিক্ষা সম্পর্কে। উদাসীন ছিল। কালক্রমে প্রশাসনিক প্রয়ােজনে ইংরাজি জানা ভারতীয় কর্মীর আবশ্যকতা দেখা, দিলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু ইংরেজি স্কুল শুরু হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে খ্রিস্টান ধর্মযাজকরা ইংরাজি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্থাপন করতে শুরু করেন। ১৭৮১ খ্রিঃ ওয়ারেন হেস্টিস কলকাতা মাদ্রাসা স্থাপন করেন। ১৭৮৪ খ্রিঃ কলকাতায় এশিয়াটিক সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন স্যার উইলিয়া জোনস এবং ১৭৯২ খ্রিঃ জোনাথন ডানকান বেনারসে সংস্কৃত কলেজ স্থাপন করেন।

১৮০০খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।কেরি ১৭৯৯ খ্রিঃ শ্রীরামপুরে ইংরাজি বিদ্যালয় স্থাপন করেন এবং ব্যাপটিস্ট মিশনের প্রচেষ্টায়। খ্রিস্টাব্দে লর্ড ওয়েলেসলির উদ্যোগে কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়। বর্ধমান, মালদা, চুচুড়া ও দক্ষিণ ভারতে বহু বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। রাজা রামমোহন রায়ের। উদ্যোগে ১৮১৫ খ্রিঃ এ্যাংলাে-হিন্দু স্কুল এবং ডেভিড হেয়ার এর চেষ্টায় ১৮১৭ খ্রিঃ হিন্দু কলেজ থাপিত হয়। তার উদ্যোগে পাঠ্যপুস্তক রচনার জন্য ১৮১৭ খ্রিঃ কলকাতা স্কুল বুক সােসাইটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন স্থানে ইংরেজি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য তিনি কলকাতা স্কুল সােসাইটি প্রতিষ্ঠা করেন।

 সরকারি উদ্যোগে শিক্ষা প্রসার :

  ভারতে শিক্ষা বিষয়ে সুস্পষ্ট সরকারি নীতি গ্রহণের জন্য ইংল্যান্ড থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির উপর চাপ আসতে থাকে। অবশেষে ১৮১৩ খ্রিঃ চার্টার আইন অনুসারে ভারতে শিক্ষাখাতে বছরে এক লক্ষ টাকা ব্যয় করার জন্য কোম্পানিকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল।

প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিক্ষা সংক্রান্ত বিতর্ক ; কোম্পানিকে ভারতীয়দের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের দায়িত্ব নিতে বলা সত্বেও শিক্ষানীতি নিয়ে বিতর্ক দেখা দেয়। ইংরেজ সরকারের প্রাচ্য অথবা পাশ্চাত্য কোন্ প্রকার শিক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত তা নিয়ে দুটি মত তৈরি হয়েছিল। ইংরেজ সরকার এ ব্যাপারে কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে পারে নি। ১৮১৩ খ্রিস্টাব্দে কমিটি অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন বা জনশিক্ষা কমিটি গঠিত হয়। কিন্তু কমিটির সদস্যরাও প্রাচ্যবাদী ও পাশ্চাত্যবাদী দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে যায়।

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রবর্তন :

 শেষ পর্যন্ত লর্ড উইলিয়াম বেন্টিঙ্ক-এর শাসনকালে (১৮২৮ – ১৮৩৫) সরকারি শিক্ষানীতিতে এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। বেন্টিঙ্ক, তার আইন সচিব টমাস ব্যাবিংটন মেকলের পরামর্শে ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে ৭ই মার্চ ইংরাজি শিক্ষা প্রবর্তনের সরকারি সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। পাশ্চাত্য জ্ঞান বিজ্ঞান প্রসারের জন্য ১৮৩৫ খ্রিঃ কলিকাতা মেডিকেল কলেজ, কলকাতায় সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ এবং বােম্বাই-এ এলফিনস্টোন ইনস্টিটিউশন স্থাপিত হয়।

 

হার্ডিঞ্চের ঘােষণা ঃ ১৮৪৪ খ্রিস্টাব্দে ভাইপ্রয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘােষণা করেন যে, সরকারি চাকরিতে ইংরাজী ভাষায় দক্ষতাকে তাগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই ঘােষণার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালিদের মধ্যে ইংরেজি শিক্ষা গ্রহণের আগ্রহ বৃদ্ধি পায় এবং ধীরে ধীরে বাঙালি সমাজে একটি ইংরেজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি আত্মপ্রকাশ করে।

 

উডের নির্দেশ নাম : লর্ডবেন্টিঙ্ক-এর শিক্ষানীতি ঘােষণার পরবর্তী দুই দশকে বেশ কিছু স্কুল-কলেজ স্থাপিত হলেও প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষাস্তর পর্যন্ত এক সুষ্ঠু শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়নি। এই ত্রুটি দূর করার জন্য কোম্পানির বাের্ড অফ কন্ট্রোলের সভাপতি চালর্স উড ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দে ১৯ শে জুলাই শিক্ষা বিষয়ক নির্দেশনাম প্রকাশ করেন। এই নির্দেশনামায় চালর্স উড যেসব সুপারিশ করেছিলেন। তার মধ্যে ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে আরও স্কুল ও কলেজ স্থাপন, একটি শিক্ষা বিভাগ গঠন, তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন, ডিরেক্টর অফ পাবলিক ইনস্ট্রাকশন-এর পদ সৃষ্টি, মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দান, নারী শিক্ষা প্রসার ইত্যাদি। ঐ সুপারিশ তানুযায়ী ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে কলিকাতা, বােম্বাই ও মাদ্রাজে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। দেশের বিভিন্ন এলাকায় বহু প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। বিদ্যালয় গুলিকে সরকারি অনুদান দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হয়।

 

হান্টার কমিশনঃ চালর্স উডের নির্দেশনামার কার্যকারিতা অনুসন্ধান করার জন্য স্যার উইলিয়াম হান্টার কমিশন ১৮৮৩ খ্রিঃ সুপারিশ করে যে, (১) দেশি বিদ্যালয়ের উন্নতি সাধন, (২) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকারি নিয়ন্ত্রণের অবসান, (৩) মণী ছাত্রদের বৃত্তি দান, (৪) শিক্ষা খাতে অনুদান,, (৫) স্ত্রী শিক্ষার প্রসার , সরকার এই সুপারিশগুলি গ্রহণ করেছিল।

 

 

ব্যালে কমিশন ঃ বড়লাট লর্ড কাওন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার উন্নতির জন্য১৯০২ খ্রিঃ মাস। বলে নহে বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন নিযুক্ত করেন। এই কমিশনে ভারতীয় সদস্য ছিলেন সারি কাস বন্দোপাধ্যায় এবং সৈয়দ হুসেন বিলগ্রামী। এই কমিশনের সুপারিশে বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রবর্তিত হয়। এতে বলা হয় (১) বিশ্ববিদ্যালয়গুলি সরকারি নিয়ন্ত্রণে আনা, (২) কলেজগুলিলে, নিয়মিত পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা, (৩) স্নাতক স্তরে একাধিক বিভাগ চালু করা।

 

 স্যাডলার কমিশন : উচ্চশিক্ষার উন্নতিকল্পে ১৯১৭ খ্রিস্টাব্দে স্যার মাইকেল স্যাডলার-এর। নতৃত্বে একটি কমিশন নিযুক্ত করা হয়। এই কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয় ১) শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারি নিয়ন্ত্রণ হাস করা, (২) স্কুল শিক্ষার পর প্রাক-স্নাতক শিক্ষা গ্রহণ করা, (৩) তিন বছরের। মত পাঠক্রম প্রবর্তন, (s) বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিতবিজ্ঞান ও কারিগরি বিদ্যার প্রবর্তন করা।

 

| বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা : ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের শিক্ষা বিভাগ প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯২১ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে বারাণসী, দিল্লি, আলিগর, পাটনা ঢাকা, হায়দ্রাবাদ, মহীশূর প্রভৃতি বিশ্ববিদ্যালয় । প্রতিষ্ঠা হয়। কবিগুরু রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।

 

নারী শিক্ষা : উনিশ শতকের প্রথমার্ধে নারী শিক্ষার বিশেষ প্রসার ঘটেনি। কুসংস্কারাচ্ছন্ন। ভারতীয়রা এবিষয়ে বিশেষ সাড়া দেয় নি। নারী শিক্ষা বিস্তারে ড্রি ঙ্ক ওয়াটার বেথুন ও ঈশ্বরচন্দ্র । বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ১৮৪৯ খ্রিস্টাব্দে বেথুন বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হয়। ধন্দ কেশব কার্ভের। উদ্যোগে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে পুণায় প্রথম মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়। এছাড়া কেশব সেনের। উদ্যোগে মহিলাদের জন্য ভিক্টোরিয়া কলেজ এবং ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের প্রচেষ্টায় ৩৫টি বালিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

 

কারিগরি শিক্ষা : ভারতে ব্রিটিশ শাসনে কারিগরি শিক্ষা বিস্তার অতি সামান্যই হয়েছিল। ১৮৪৭ খ্রিঃ রুর কি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ এবং ১৮৫৬ খ্রিঃ কলকাতা (শিবপুর) ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ প্রতিষ্ঠা হয়। পরবর্তীকালে পুণা ও মাদ্রাজে দুটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ খােলা হয়। ১৯০১ সালে সারা ভারতে ৮০টি কারিগরি বিদ্যালয় ছিল।

 

পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাব : 

ব্রিটিশ শিক্ষা ব্যবস্থার দ্রুত প্রসার ঘটলেও এর কিছু কুফল ছিল। (১) শিক্ষার মাধ্যম ইংরেজী ভাষা থাকায় সাধারণ মানুষ এই শিক্ষা থেকে বঞ্চিত ছিল। (২) ভারতীয় ভাষাগুলির যথেষ্ঠ বিকাশ হয়নি। (৩) স্ত্রী শিক্ষার প্রসার ঘটেনি। (৪) মুষ্টিমেয় শহরের মানুষের মধ্যে এই শিক্ষা সীমাবদ্ধ ছিল।

 

এই শিক্ষার সুফলের দিকগুলি ছিল – (১) ভারতীয়দের কাছে জ্ঞান বিজ্ঞানের জগৎ খুলে গিয়েছিল। (২) এই শিক্ষার প্রভাবে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কার দূরীকরনে সচেতনতা বৃদ্ধি পায়। (৩) ইউরােপের ইতিহাস, দর্শন ও সাহিত্যের প্রভাবে ভারতীয়দের মধ্যে জাতীয়তাবােধ জাগ্রত হয়। (৪) ভারতে সংবাদ পত্রের প্রসার ঘটে। (৫) আধুনিক শিক্ষার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে ওঠ। (৬) ভারতবাসীর ঐক্যচেতনা ও সংগ্রামী মনােভাব জাগ্রত হয়।

 

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা: ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব :

 

ইংরেজ শাসনে নানা আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনের ফলে সমাজে এক সম্পন্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির উত্তৰ হয়। প্রখর বাস্তববুদ্ধির জোরে ওই মধ্যবিত্ত শ্রেণি ভারতে পাশ্চাত্য শিক্ষা প্রসারকে স্বাগত হনায়। পরবর্তীকালে ভারতে জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রসারে ওই শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গুরুত্বপূর্ণ।

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা

মধ্যবিত্ত শ্রেণীর উদ্ভব এর কারণ:

 

ইংরেজদের প্রবর্তিত অর্থনীতি ভারতে মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের বিকাশে সাহায্য করেছিল। বাংলাদেশেই প্রথম এই মধ্যবিত্ত শ্রেণি বি’ পূর্ণ হয়ে ওঠে। লর্ড কর্ণওয়ালিস বাংলায় ভূমি। বন্দোবস্তের ক্ষেত্রে চিরস্থায়ী ব্যবস্থা চালু করলে জমিতে ব্যক্তিগত মালিকানা চালু হয়। উনিশ। শতকের শুরু থেকে জমির দাম ও জমি থেকে প্রাপ্ত আয় বাড়তে থাকায় জমিতে তাৰ্থ বিনিয়োগ। লাভজনক হয়ে দাঁড়ায়। ব্যবসা-বাণিজ্যের চেয়ে ভূসম্পত্তিতে বিনিয়ােগের ক্ষেত্রে ঝুকি ছিল অনেক। কম। ফলে শহর ও গ্রামাঞ্চলের সঙ্গতি সম্পন্ন মানুষ জমিতে অর্থ বিনিয়ােগ করে প্রচুর আয়। করতে শুরু করেন। ইংরেজ বণিকদের মতাে ব্যবসা-বাণিজে অংশগ্রহণ করেও অনেকে প্রচুর। আয় করেছিলেন। এইভাবে ধীরে ধীরে বাঙালি তথা ভারতীয় সমাজে একটি ধনা মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়।

 

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা: ইংরাজি শিক্ষার প্রেরণা :

 

এদেশে ইংরাজি শিক্ষা প্রবর্তনের ক্ষেত্রে এই মধ্যবিত্ত সম্প্রদায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন। রাজা রামমােহন রায়ের মতাে ব্যক্তিরা উপলব্ধি করেছিলেন যে যুগ যুগ ধরে অন্ধ-বিশ্বাস আর । কুসংস্কারের যে জগদ্দল পাথর ভারতীয় সমাজের উপরে চেপে বসে রয়েছে, একমাত্র পাশ্চাত্য। শিক্ষার সাহায্যেই তা সরানাে সম্ভব হবে। লর্ড বেন্টিঙ্কের সরকারি শিক্ষানীতি ঘােষিত হলে। যেসব ইংরাজি স্কুল-কলেজ স্থাপিত হয়, মধ্যবিত্ত অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের সেগুলিতে Aঠাতে শুরু করেন। ইংরাজি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তারা ভারতীয় সমাজের দুর্বলতাগুলি উপলব্ধি করতে পারেন। ফ্রান্সের বিপ্লবের ইতিহাস ও আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস পাঠ করে। মরা গভীরভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ইতালি ও জার্মানির ঐক্য সাধনের ইতিহাস তাদের কাছে একথা স্পষ্ট করে দিয়েছিল যে বিদেশিদের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র ভারতকে আগে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি হিসাবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। এই উদ্দেশ্যে শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির নেতারা একদিকে যেমন ধর্মীয় ও সামাজিক সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে ভারতীয় সমাজকে নতুন করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছিলেন, অন্যদিকে তেমন গণতন্ত্র, মানবতা ও জাতীয়তাবাদের দেশের মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

 

 স্বাধীনতা সংগ্রামে মধ্যবিত্তদের ভূমিকা : ব্রিটিশ বিরােধী চেতনা সৃষ্টি এবং জাতীয় আন্দোলন গড়ে তােলার ক্ষেত্রে পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। উনিশ শতকে প্রথম দিকে ইংরাজি শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি ব্রিটিশ শাসনকে স্বাগত জানিয়েছিল। তারা মহাবিদ্রোহের সময় সরকারকে সমর্থন করেছিল। ক্রমশ তাদের ভুল ভাঙল। ইংরেজ শাসনে মধ্যবিত্ত শ্রেণির মধ্যে নানা অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল। উপযুক্ত যােগ্যতা থাকা সত্বেও সরকারি চাকরিতে গুরুত্বপূর্ণ পদে উচ্চ পদে ভারতীয়দের নিয়ােগ করা হতাে না। সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় ভারতীয়দের বয়স কমিয়ে একুশ থেকে উনিশ বছর করা হয়েছিল এবং ৯০০ টি পদের মধ্যে মাত্র ১৬টি পদের জন্য ভারতীয়দের লণ্ডনে পরীক্ষা দিতে যেতে হতাে। এর ফলে (ভারতীয়দের মধ্যে) বেকারত্ব বৃদ্ধি পায় এবং তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ইংরেজরা নিজেদের শ্রেষ্ঠ জাতি মনে করত এবং ভারতীয়দের প্রতি তীব্র ঘৃণা, বিদ্বেষ ও অবজ্ঞা প্রকাশ করত। ব্রিটিশ শিল্পপতিদের স্বার্থে ভারতের বানিজ্য ও শিল্পনীতি নিয়ন্ত্রন করা হয়। ভারতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সেচ প্রভৃতির প্রতি অবহেলা, কৃষি ও কুটির শিল্প ধ্বংস করা, অতিরিক্ত কর চাপানাে, দুর্ভিক্ষের বহু মানুষের প্রানহানি, কৃষকদের উপর নীলকরদের সীমাহীন অত্যাচার, সংবাদপত্র নিয়ন্ত্রন আইন প্রভৃতি কারণে মধ্যবিত্ত শ্রেণি ইংরেজ সরকারের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই সব অসন্তোষ ও হবে এর ফলে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর নেতৃত্বে সংঘটিত রাজনৈতিক শক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠেছিল।

ইউরােপে জাতীয়তাবাদের সূচনা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *