আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সম্পর্কে আলোচনা
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি ;
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্দেশ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা।
■ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কাকে বলে?
উত্তর। একটি স্বতন্ত্র শাস্ত্র হিসাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়টি আজকের দিনে সুপ্রতিষ্ঠিত। কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন বিশেষজ্ঞ ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংজ্ঞা নির্দেশ করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্কের কোন সুনির্দিষ্ট সংজ্ঞা নির্দেশ করা আজ পর্যন্ত সম্ভব হয় নি। কোন কোন বিশেষজ্ঞের মতে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা। কারও কারও মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক শুধু রাষ্ট্রীয় স্তরেই সীমাবদ্ধ থাকবে , বিভিন্ন বেসরকারী ও আধাসরকারী পর্যায়ের সম্পর্ক নিয়েও আলােচনা করবে। অনেকে আবার ক্ষমতার দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টিকে আলােচনা করার পক্ষপাতী।
কে. জে. হলস্টি (K. J. Holsti)-র মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক প্রতিক্রিয়ার প্রক্রিয়াকে বােঝায়। আবার পামার ও পারকিনস (Palmer and Perkins)-এর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্বসমাজের সকল মানুষ ও গােষ্ঠীর সকল সম্পর্ক, মানুষের জীবন, ক্রিয়াকলাপ ও চিন্তার প্রকৃতি নিয়ন্ত্রণকারী শক্তি, চাপ এবং প্রক্রিয়া নিয়ে আলােচনা করে। এন, জি, প্যাডেলফোর্ড এবং জি. এ. লিঙ্কনের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচ্য বিষয় বিভিন্ন ব্যক্তি, ব্যবসায়ী সংস্থা, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এবং বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের আলােচনার সঙ্গে যুক্ত।
অধ্যাপক মর্গেনথাউ (H. J. Morgenthau) আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কথাটির চাইতে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কথাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। কারণ তার মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল মূলতঃ ক্ষমতার লড়াই। নিজ রাষ্ট্রের ক্ষমতা বৃদ্ধি করা ও অক্ষুন্ন রাখা এবং অপরাপর রাষ্ট্রের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ বা হ্রাস করার অবিচ্ছিন্ন প্রচেষ্টাকে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলে অভিহিত করেছেন।
ট্রিগভি ম্যাথিয়েসেন-এর মতানুযায়ী আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনার মধ্যে জাতীয় রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রমকারী সকল সম্পর্ক—অর্থনৈতিক, আইনগত, রাজনৈতিক ও অন্যান্য সম্পর্ক তা ব্যক্তিগত বা সরকারী যাই হােক না কেন, অন্তর্ভুক্ত।
জন হাউস্টন (John Houston)-এর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সঙ্গে বিভিন্ন মানবগােষ্ঠীর ভাবধারা ও মতাদর্শ জড়িত থাকে। তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক হল আন্তর্জাতিক সম্মেলন, কূটনীতিবিদদের আদান-প্রদান, চুক্তি সম্পাদন, সেনাবাহিনী নিয়ােগ, ততর্জাতিক বাণিজ্যের অবাধ প্রসার-সহ বিশাল ও বৈচিত্র্যময় বিষয়সমূহের আলােচনা।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের সংজ্ঞা নির্ণয় প্রসঙ্গে নিকোলাস স্পাইকম্যান বলেছেন যে, অর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের অন্তর্গত ব্যক্তিবর্গের সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে
স্টানলি হ্যান্ (S. H. Hoffmann)-এর মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এমন সব উপাদান ও কার্যাবলী নিয়ে আলােচনা করে যা রাষ্ট্রের বাহ্যিক নীতি ও শক্তিকে প্রভাবিত করে।
উপরােক্ত সংজ্ঞাগুলির সমন্বয় সাধন করে আমরা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের একটি গ্রহণযােগ্য সংজ্ঞা দিতে পাবি এইভাবে ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বলতে এমন একটি শাস্ত্রকে বােঝায় যা বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে অবস্থিত রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামরিক, কূটনৈতিক, আইনগত, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি সকল প্রকার সরকারী ও বেসরকারী সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। সবশেষে একটি কথা স্মরণ রাখতে হবে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের আলােচনা শুধু অত্ত্বিক পর্যায়ে সীমাবদ্ধ থাকে না, বিভিন্ন বিষয়ের প্রায়ােগিক দিকগুলিও এর বিবেচ্য।
■ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে পার্থক্য
উত্তর। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি—এ দুটিকে অনেক সময় একই অর্থে ব্যবহার করা হয়। এর ফলে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি হয়। অধ্যাপক পামার ও পারকি (Palmer and Perkins) মন্তব্য করেছেন যে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতির মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। কিন্তু বহু লেখক এই পার্থক্য অনুধাবন করতে ব্যর্থ হওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক পঠন-পাঠনের ক্ষেত্রে শব্দগত বিভ্রান্তির (semantic confusion) সৃষ্টি হয়েছে।
পামার ও পারকিসের মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনীতির থেকে ব্যাপকতর ধারণা। এঁদের মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি হল ‘আন্তর্জাতিক সমাজের রাজনীতি’ (Politics of the international society)। আন্তর্জাতিক রাজনীতি কূটনীতি এবং বিভিন্ন রাষ্ট্র ও সংগঠনের সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। অপরদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্ব-সমাজের সকল মানুষ ও গােষ্ঠীর সকল প্রকার সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। এই মতবাদ অনুসারে আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অংশ বিশেষ।
পামার ও পারকিসের ন্যায় কে. জে. হলস্টিও (K. J. Holsti) আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে আন্তর্জাতিক রাজনীতির থেকে ব্যাপকতর ধারণা বলে মন্তব্য করেছেন। হলস্টির মতে, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিষয়বস্তুর মধ্যে আছে বিভিন্ন রাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতি ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়াসমূহ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য, যাতায়াত, যােগাযােগ, আন্তর্জাতিক মূল্যবােধ ও নীতিশাস্ত্র, এমনকি আন্তর্জাতিক শ্রমিক ইউনিয়ন সমূহ, আন্তর্জাতিক রেডক্রশ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিক রাজনীতি এসব ধরনের বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত থাকে না। আন্তর্জাতিক রাজনীতি শুধুমাত্র দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রের পারস্পরিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত থাকে।
শ্লেচার (Schleicher) বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি সমার্থক নয়। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক সমাজে ক্ষমতা প্রয়ােগের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার ঘটনা বিরল। বিরোব তথা বিরোধিতামূলক আচরণ আন্তর্জাতিক সমাজে প্রাধান্য অর্জন করেছে। কিন্তু তা সত্ত্বেও সহযােগিতামূলক আচরণ আন্তর্জাতিক রঙ্গমপর ৬ ধাও হয়ে যায় নি। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে বিরােধ ও সহযােগিতা উতর দিক নিয়েই আলােচনা করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত বিরােধ, সংঘর্ষ প্রভৃতির সঙ্গেই যুক্ত থাকে।
এই প্রসঙ্গে সি. এফ. অলজার (C. E. Alger) মন্তব্য করেছেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। অপরপক্ষে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক অর্থনীতি, আইন, যােগাযােগব্যবস্থা, সংগঠন, বিশ্বযুদ্ধ ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকে। এরা প্রত্যেকেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধীনস্থ বিষয় বা তার উপ-আলােচ্যসূচী (Subfields) হিসাবে অবস্থান করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতি
তবে অধ্যাপক মরগেস্থাউ (H. J. Morgenthau) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের পরিবর্তে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কথাটি ব্যবহারের পক্ষপাতী। তাঁর মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবল সাম্প্রতিক ইতিহাস এবং বর্তমান ঘটনাবলী নিয়েই আলােচনা করে না। তার মতে, একটি পাঠ্য-বিষয়রূপে আন্তর্জাতিক রাজনীতি সাম্প্রতিক ইতিহাস, বর্তমান ঘটনাবলী, আন্তর্জাতিক আইন প্রভৃতি থেকে স্বাতন্ত্রের দাবি রাখে।
কারও কারও মতে, আন্তর্জাতিক রাজনীতি মূলত আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ও অরাজনৈতিক—উভয় বিষয় নিয়ে আলােচনা করে। কেউ কেউ বলেন, আন্তর্জাতিক রাজনীতি দুই বা ততােধিক রাষ্ট্রের মধ্যে কেবলমাত্র সরকারী সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে সরকারী ও বেসরকারী—উভয় প্রকার সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। প্যাডেলফোর্ড ও লিঙ্কন (Padelford and Lincon) বলেছেন, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে যখন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের কথা বলা হয়, তখন রাষ্ট্র’ শব্দটিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করা হয়। রাষ্ট্র বলতে কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি রাষ্ট্রকেই বােঝায় না, বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সংগঠন, সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট প্রভৃতিকেও বােঝায়। অপরপক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনীতি বলতে নিছক রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্ককে বােঝায়।
উপসংহার : উপরােক্ত মতামতগুলিকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, অধিকাংশ লেখকই আন্তর্জাতিক রাজনীতি অপেক্ষা আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ধারণাকে ব্যাপকতর ধারণা বলে মেনে নিয়েছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যস্থিত রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, সরকারী ও বেসরকারী, কূটনৈতিক, সামরিক, অর্থনৈতিক, আইনগত, সাংস্কৃতিক ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকার সম্পর্ক নিয়ে আলােচনা করে। তাছাড়া আন্তর্জাতিক সম্পর্ক কেবল বিভিন্ন রাষ্ট্রের সম্পর্কই আলােচনা করে না ; আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে যে বিভিন্ন অরাষ্ট্রীয় অভিনেতা (non-state actors) থাকে, তাদের নিয়েও আলােচনা করে। অপরপক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনীতি কেবলমাত্র রাষ্ট্রের সঙ্গে রাষ্ট্রের সম্পর্কের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। অন্যভাবে বলা যায়, আন্তর্জাতিক রাজনীতি আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অন্তর্গত একটা বিষয় মাত্র। সবশেষে মনে রাখতে হবে, ‘রাজনীতি’ শব্দটির সঙ্গে ক্ষমতা, বিরােধ, সংঘর্ষ প্রভৃতির বারণা যেরূপ যুক্ত থাকে, ‘সম্পর্ক’ শব্দটির মধ্যে সেরূপ থাকে না। সম্পর্ক’ শব্দটি সাধারণভাবে সহযােগিতা ও সংহতির দ্যোতনা করে।
■ আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি কর্মকর্তা হিসাবে রাষ্ট্রের ভূমিকা আলােচনা কর।
উত্তর। ঐতিহ্যবাহী দৃষ্টিভঙ্গিতে সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রকেই শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কর্মকর্তা (actor) হিসাবে ভাবা হত। বস্তুতপক্ষে দীর্ঘদিন যাবৎ আন্তর্জাতিক রাজনীতির মূল বিষয় ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গ্রেটব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি, রাশিয়া প্রভৃতি সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া। কিন্তু বর্তমানে, বিশেষ করে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির বিষয়বস্তু হিসাবে সার্বভৌম রাষ্ট্র ছাড়াও অন্য বহু ধরনের কর্মকর্তার ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন, আঞ্চলিক সংস্থা, সামরিক ও অর্থনৈতিক জোট, বহুজাতিক কর্পোরেশন, গুপ্তচর বৃত্তির কাজে নিযুক্ত আন্তর্জাতিক সংস্থা ইত্যাদি অরাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাগণ সাম্প্রতিককালের আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করে। এই সমস্ত অরাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের আলােচনা বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতির আলােচনা লেডি ম্যাকবেথকে বাদ দিয়ে ম্যাকবেথ নাটক পরিবেশন করার মত অর্থহীন হয়ে দাঁড়াবে। এই বক্তব্যকে অস্বীকার না করেও বলা যায় যে, রাষ্ট্রই হল আন্তর্জাতিক রাজনীতির মুখ্য কর্মকর্তা। আন্তর্জাতিক জীবন ও সম্পর্কের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই এখনও পর্যন্ত প্রাধান্যকারী ভূমিকা পালন করে চলেছে।
বর্তমান লেখকগণ সার্বভৌম রাষ্ট্রকে বিশ্ব সমাজের (World Community) সদস্যরূপে বিশ্লেষণ করেন। রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমিকতা সম্পর্কে আধুনিক ধারণার উৎপত্তি হয় ষােড়শ শতাব্দীতে। মধ্যযুগে ব্যক্তির আনুগত্য সামন্তপ্রভু ও রাজার মধ্যে বিভক্ত হয়ে পড়ায় সার্বভৌম রাষ্ট্রের উদ্ভব হয় নি। মধ্যযুগের শেষের দিকে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতার ধারণা গড়ে উঠতে থাকে এবং ক্রমে তা আন্তর্জাতিক রাজনীতির কেন্দ্রীয় ধারণায় পরিণত হয়। বর্তমানে বিশ্বসমাজ বলতে সার্বভৌম রাষ্ট্রসমূহের সমন্বয়কে বােঝায়। রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপ, আচরণ, সিদ্ধান্ত ও নীতি, আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিক্রিয়া, সংঘর্ষ ও সম্পর্ককে কেন্দ্র করেই বর্তমানের আন্তর্জাতিক রাজনীতি আবর্তিত হয়।
আন্তর্জাতিক আইন ব্যবস্থাতেও সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রাধিকার স্বীকৃত। আন্তর্জাতিক আইনে জাতীয় রাষ্ট্রগুলিই কেবলমাত্র কর্মকর্তার মর্যাদা ভােগ করে। আন্তর্জাতিক আইনের চোখে প্রতিটি জাতীয় রাষ্ট্র পূর্ণ আইনগত ব্যক্তিত্বের (legal personality) অধিকারী। আন্তর্জাতিক আদালতে কেবলমাত্র সার্বভৌম রাষ্ট্রগুলিই বিচারপ্রার্থী হবার অধিকার ভােগ করে। আন্তর্জাতিক আদালতের কাছে কোন ব্যক্তি বা সংস্থা নয়, কেবলমাত্র রাষ্ট্রগুলিরই আইনগত স্বীকৃতি (Locus standi) রয়েছে।
আন্তর্জাতিক আইনের পালনের দিক থেকে রাষ্ট্রগুলির মধ্যে ব্যাপক বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। আন্তর্জাতিক রঙ্গমঞ্চে কোন্ রাষ্ট্র কতখানি ভূমিকা পালন করবে তা নির্ভর করে তার শক্তি বা ক্ষমতার ওপর। অধ্যাপক পামার ও পারকিন্স (Palmer and Perkins) জাতীয় শক্তির দিক থেকে রাষ্ট্রগুলিকে তিনভাগে ভাগ করেছেন—(১) বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্র, (২) মাঝারি শক্তিধর রাষ্ট্র এবং (৩) অনিশ্চিত মর্যাদাসম্পন্ন রাষ্ট্র। বলাবাহুল্য বৃহৎ শক্তিধর রাষ্ট্রগুলিই আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে প্রাধান্যকারী ভূমিকা পালন করে থাকে। তবে অনেক সময় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, রাষ্ট্রের নীতি ও কার্যাবলী, রাষ্ট্রপ্রধানের সফল নেতৃত্ব প্রভৃতির পরিপ্রেক্ষিতে কোন কম শক্তিসম্পন্ন রাষ্ট্রকেও বিশ্বরাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে দেখা যায়। উদাহরণস্বরূপ মেটারনিখের নেতৃত্বে অস্ট্রিয়া একসময় ইউরােপীয় রাজনীতিতে কেন্দ্রীয় ভূমিকা পালন করে। আবার কোন বিশেষ পরিস্থিতিতে কোন একটি রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেও পরবর্তীকালে অপেক্ষাকৃত নিষ্ক্রিয় হয়ে যেতে পারে। এ ব্যাপারে প্রকৃষ্ট উদাহরণ হল জার্মানি ও ইটালি।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বিভিন্ন কর্মকর্তার মধ্যে রাষ্ট্র কেন প্রাধান্যকারী অবস্থানে রয়েছে, এর উত্তরে অধ্যাপক ফ্রাঙ্কে (Joseph Frankel) নিম্নলিখিত কারণগুলি উল্লেখ করেন ?
(ক) সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্রগুলি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় দিক থেকেই তাদের বৈধতা বজায় রেখেছে।
( খ) জাতীয় রাষ্ট্রগুলিই হল সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক সংগঠন এবং তার অধিকাংশ নাগরিকের সর্বোচ্চ আনুগত্য লাভ করে।
(গ) জাতীয় রাষ্ট্রগুলি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডের অধিকারী এবং কেবলমাত্র তাদের অধীনেই বৈং সামরিকবাহিনী রয়েছে।
(ঘ) বহুমুখী উদ্দেশ্যসাধক সংস্থা হিসাবে রাষ্ট্র বিচিত্রমুখী কার্য সম্পাদন করে।
| (ঙ) জাতীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থা এখনও পর্যন্ত কোন তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্মুখীন হয় নি। আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় রাষ্ট্রের ভূমিকা প্রসঙ্গে অধ্যাপক ফ্রাঙ্কে বলেছেন যে, বর্তমানে যে জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থা রয়েছে তাকে অবলুপ্ত করার যে কোন প্রচেষ্টাই বিশ্ব শান্তির পক্ষে ক্ষতিকারক। এই ধরনের প্রচেষ্টা আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার স্থায়িত্ব নষ্ট করবে এবং বিশ্বযুদ্ধ ডেকে আনবে। তাই বিশ্বশান্তি রক্ষার স্বার্থেই বর্তমান জাতীয় ভূখণ্ডকেন্দ্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা বাজায় রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক :- ভুখন্ডকেন্দ্রিক জাতীয় সার্বভৌম রাষ্ট্রের সংকট :
বিগত কয়েক শতাব্দী ধরে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার প্রধান কর্মকর্তা হিসাবে ভূখণ্ডকেন্দ্রিক সার্বভৌম জাতীয় রাষ্ট্র যে প্রাধান্য পেয়ে এসেছে সেই প্রাধান্য সাম্প্রতিককালে অনেক পরিমাণে ক্ষীয়মাণ হয়ে পড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অনেক বিশেষজ্ঞের মতে, বর্তমানে জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থায় ভাঙ্গনের পালা শুরু হয়েছে। বহু অভিজাতীয় শক্তি অত্যন্ত ভেশন হয়ে রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে সঙ্কুচিত করেছে। জন্ হার্জ তাঁর International Politics in the Nuclear Age’ শীর্ষক গ্রন্থে বলেছেন, প্রযুক্তিগত বিপ্লব ভূখন্ড কেন্দ্রিক জাতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অর্থহীন করে তুলেছে।
মর্গেন্থাও অনুরুপভাবে মন্তব্য করেন যে, প্রযুক্তিবিদ্যার ব্যাপক অগ্রগতি এবং সন্তানের বিপরিস্থিতি সাবেকী জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণাকে অর্থহীন করে তুলেছে। হলসটি K. Holsti) বলেছেন, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও ভূখণ্ডগত বৈশিষ্ট্যের গুরুত্ব থাকা সত্বেও নানা করণে বর্তমানে জাতিভিত্তিক রাষ্ট্র বাইরের হস্তক্ষেপের কাছে উন্মুক্ত হয়ে পড়ছে, অনেক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রগুলি বহিঃশক্তির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক জে কে হাত রাষ্ট্রের প্রভাব ও ক্ষমতা হ্রাসের এই পরিস্থিতিকেই ভূখণ্ডকেন্দ্রিক এ জাতীয় রাষ্ট্রের সংকট রূপে অভিহিত করা হয়ে থাকে। ম্যাকলেলা (D. S. ein এতে আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে যদি কোন মৌলিক ধারণার উদ্ভব এ রাব্যবহার ভাঙনের পালা।
জাতীয় রাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাসের কারণ কি- এর উত্তরে বিভিন্ন লেখক বিভিন্ন রকম মন্তব্য করেছেন, আগেই বলা হয়েছে অধ্যাপক মর্গেন্থাও জাতীয় রাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাসের কারণ হিসেবে প্রযুক্তিবিদ্যার অগ্রগতি এবং সাম্প্রতিককালের বিশ্ব পরিস্থিতি- এই দুটি কে দায়ী করেছেন। কুলম্বিস এবং উলফ মনে করেন সামরিক প্রযুক্তি বিদ্যার অগ্রগতি অতি জাতীয় সংগঠনের উদ্ভব অতি জাতীয় মতাদর্শগত ও রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রসার পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রাজনীতি প্রভৃতি বিষয় গুলি জাতীয় রাষ্ট্রের গুরুত্ব দিয়েছে।
ফ্রাঙ্কেলের এর মতে সাম্প্রতিককালের আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিতে রাষ্ট্রপ্রধান রাখতে সক্ষম হলেও নতুন পরিস্থিতিকে
মােকাবিলার জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে। আন্তর্জাতিক সংগঠন, মাের্চা (coalition), জোট (bloc) ইত্যাদি তৈরী করেছে। এর ফলে রাষ্ট্রগুলির সার্বভৌমত্ব সৃদৃঢ় হয়েছে সত্য, কিন্তু আন্তর্জাতিক সমাজের উপাদান ও সদস্য হিসাবে নিজ সার্বভৌমত্ব ক্ষুন্ন হয়েছে।
আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে জাতীয় রাষ্ট্রগুলি চ্যালেঞ্জের মুখে সম্মুখীন
জন্ হার্জ মন্তব্য করেছেন, বিশের জাতীয় রাষ্ট্রগুলি বর্তমানে মূলত তিন ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, যথা-সামরিক, অর্থনৈতিক ও মনস্তাত্ত্বিক। সামরিক ক্ষেত্রে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অকল্পনীয় উন্নতি সামরিক কথাকৌশলের অভাবনীয় উন্নতি ঘটিয়েছে। আণবিক অস্ত্র, আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র জাতীয় রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে ভীষণভাবে বিপন্ন করে তুলেছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, বর্তমানে প্রতিটি রাষ্ট্রই তার অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য বৈদেশিক বাণিজ্যের ওপর নির্ভরশীল। দরিদ্র দেশগুলি শিল্পজাত দ্রব্য, প্রযুক্তি, বৈদেশিক ঋণ প্রভৃতির ব্যাপারে ধনী দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল। পক্ষান্তরে ধনী দেশগুলিও কাচামাল ও বাজারের জন্য দরিদ্র দেশগুলির ওপর নির্ভরশীল। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এই পারস্পরিক নির্ভরশীলতা রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে ক্ষুন্ন করেছে। এছাড়া বর্তমানে রেডিও, টেলিভিশন, ইন্টারনেট এবং অন্য সব প্রচার মাধ্যমের সাহায্যে কোন রাষ্ট্র তার শত্রুপক্ষের বিরুদ্ধে বিশ্বজনমত গড়ে তুলতে পারে এবং একটা মনস্তাত্ত্বিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। হার্জের মতে, এই ত্রিমুখী চ্যালেঞ্জের সামনে দাড়িয়ে আজকের দিনে প্রতিটি রাষ্ট্রই কমবেশি অসহায় বােধ করছে। তাই তিনি ভবিষ্যদ্বাণী করেন, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা ক্রমে প্রতিদ্বন্দ্বী আঞ্চলিক জোটের দ্বারা পরিচালিত হবে।
উপরােক্ত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় রাষ্ট্রের প্রভাব হ্রাসের বা সংকটের মূল কারণগুলিকে নিম্নলিখিতভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে ? আধুনিক যুদ্ধ ও মারণাস্ত্রের প্রসার, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতি, সকল রাষ্ট্রের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতা, আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক সামরিক জোট, অর্থনৈতিক মোর্চা, সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য, রাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বীরূপে অতি-রাষ্ট্রীয় (Supra-national) সংস্থার উদ্ভব, এক-মেরুপ্রবণতা (Uni-polarism), আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় বা অরাষ্ট্রীয় কর্মকর্তাদের আবির্ভাব, প্রযুক্তির হস্তান্তর, সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন, এক রাষ্ট্র কর্তৃক অন্য রাষ্ট্রকে ভীতি প্রদর্শন, আন্তর্জাতিক আইন, আন্তর্জাতিক সংগঠন, মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ, পরিবহণের অগ্রগতি, ইন্টারনেট ব্যবস্থা ইত্যাদি।
পরিশেষে একটি কথা মনে রাখতে হবে, বর্তমান দিনে আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার চরিত্র আমূল পরিবর্তিত হয়েছে ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক রাজনীতির ক্ষেত্রে রাষ্ট্রই যে এখনও কেন্দ্রস্থলে রয়েছে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই। বস্তুতপক্ষে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে আজও রাষ্ট্রই মুখ্য কর্মকর্তার ভূমিকায় অবতীর্ণ।